খ্রিস্টান ধর্মধর্ম

ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের ইতিহাস | খ্রিষ্ট ধর্মের ইতিহাস

Spread the love

ধর্ম ও যীশু খ্রিষ্ট

 

খ্রিষ্ট ধর্ম / খ্রিষ্টান ধর্ম, পৃথিবীতে ধর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম ও সবচেয়ে প্রচারমুখী ধর্ম। ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের ইতিহাস নিয়ে আজকের আর্টিকেল।
খ্রিষ্ট ধর্ম মূলত নাজারাথের যীশু খ্রিষ্টের জীবন এবং শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত করা।
খ্রিষ্ট ধর্মানুলম্বীদের ধারণা, যীশু খ্রিষ্ট ঈশ্বরের পুত্র, এবং তিনি পিতা ছাড়াই মাতা মেরীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। খ্রিষ্ট ধর্মানুলম্বীগণ খ্রিস্টান নামে পরিচিত। বাইবেল এদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ।
যীশু খ্রিষ্টের নামের দুটি হিব্রু উচ্চারণ – ইয়েসুস এবং ইয়েশুয়া।
যীশু খ্রিষ্টের ভাষা ছিল এরামাইক (হিব্রু ও আরবি থেকে এই ভাষার উৎপত্তি)।
জেনেসিস হাস্টন স্মিথ বলেছেন, খ্রিষ্টানদের খ্রিষ্ট ধর্ম মূলত একটি ঐতিহাসিক ধর্ম। 
খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস যীশু খ্রিষ্টের মাধ্যমে ঈশ্বর প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু, পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মগুলোর মধ‍্যে একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে।
বেশিরভাগ ধর্ম সনাতন ধর্মের একটি অংশ থেকে সৃষ্টি!
সম্রাট বিক্রমাদিত‍্য আর্টিকেলে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাচীন ভারতবর্ষের আর্যদের থেকেই পৌত্তলিক ধর্মের সৃষ্টি হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে একেশ্বরবাদের উৎপত্তি হয়েছিল, সেগুলোও ছিল পৌত্তলিক ধর্মের উৎস থেকে সংগৃহীত।
সম্রাট বিক্রমাদিত‍্য তাঁর শাসনামলে শক সহ কয়েকটি নির্মম সহিংস গোষ্ঠীকে পরাজিত করে, তাদের মধ‍্যে সনাতনী ধর্মের ভাবধারা প্রচার করেছিল, যার কারণে আরব দেশে শুরু হয়েছিল পৌত্তলিক ধর্মের বিকাশ!

খ্রিষ্ট ধর্মের ইতিহাস

খ্রিষ্ট ধর্ম, ইসলাম ধর্মের ন‍্যায় মূলত পৌত্তলিক ধর্ম থেকে বিবর্তিত হয়েছে। যীশু খ্রিষ্টের জন্ম সময়ে ইহুদীরা তিনটি গোষ্ঠিতে বিভক্ত ছিল।
ফারিসিজ, এসেনিজ ও সাদুসিজ। এরমধ্যে এই সাদুসিজরা ছিল মুসা নবীর অনুসারী।
ফারিসিজ ও এনেসিজরা ছিল গৌতম বুদ্ধের অনুসারী।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দিতে সেলুসিড ও টলেমী রাজ্যে বুদ্ধবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এটা সম্রাট অশোকের তৈরী শিলাখন্ডের লিপি থেকে জানা যায়।
গবেষকদের কাছে বেশকিছু প্রমাণ রয়েছে, এই এসেনিজ গোষ্ঠী পরবর্তীতে খ্রিষ্ট ধর্মের সূচনা করে।
বৌদ্ধ মতবাদের অহিংস নীতির ছোঁয়া খুজে পাওয়া যায়, যীশু খ্রিষ্টের চরিত্র নির্মাণে।
যীশু খ্রিষ্টের কুমার জীবন, খ্রিস্টান ফাদার / সিস্টারদের বৈরাগ্য এসবই ছিল প্রাচীন এনেসিজদের ধর্মীয় বিশ্বাস। এনেসিজরা বুদ্ধবাদের অনুসারী হলেও, মূলত তারা ইহুদী হিসেবে পরিচিত ছিল।
খ্রিষ্ট ধর্মকে মূলত বিকশিত করেন সাধু পল। এসেনিরা যে ধর্মমত বিশ্বাস করত সেটাই, তিনি থিম হিসেবে ধরে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচার শুরু করেন।
এসেনিজরাই ফেরেশতা, বেহেস্ত / দোজখ, পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, ক্রুশ বিদ্ধ ঈশ্বর পুত্রের পাপমোচন ইত্যাদিতে বিশ্বাস করত।
এসেনিজরা বিশ্বাস করত, গৌতম বুদ্ধ ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন তার মৃত্যুর ১৬০০ বছর পর পৃথিবীতে একজন অবতার আসবে।
পরবর্তীতে সেই সময়কাল অতিক্রম হলে এসনিজ ইহুদীগণ, যারা বুদ্ধের অনুসারী ছিল, তারাই যীশু খ্রিষ্টের আবির্ভাবের ঘোষণা দেন।
তারপরে যীশু খ্রিষ্টের জন্মের ঘটনা আর্যদের সূর্য কিংবদন্তির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়।
সূর্য কিংবদন্তি ছিল, পৌত্তলিক আর্যদের ধর্মের নিউক্লিয়াস।
এই বিশ্বের সমস্ত শক্তির উৎস সূর্যকে ঈশ্বররূপে, ত‍ৎকালীন আর্যরা গণ্য করত।
এসেনিজরাও প্রথমে ক্রাইস্টের যে পুজা করত সেটি ভেড়ার আকৃতি তৈরী করে।
কারণ, ঐ রাশিচক্রের মেষ (ভেড়া) রাশিকে আকৃতি দেয়া।
প্রাচীনকালে এই ভেড়াকে বলা হত ইশ্বরের ভেড়া, যে পৃথিবীর পাপ মোচন করতে এসেছেন।
কনস্ট্যান্টাইন পোগোনেটাস শাসনামলে ষষ্ঠ সিনোড দ্বারা সিদ্ধান্ত হয়, প্রাচীন প্রতীক মেষের পরিবর্তে একটি মানুষ্যাকৃতি ক্রুশ বিদ্ধ অবস্থায় দেখানো হবে।
ষষ্ঠ সিনোডের এই সিদ্ধান্ত পোপ আড্রিয়ান-১ কর্তৃক স্বীকৃত করা হয়
(Quoted is Higgin’s Anacalypsis, vol ii P.3)।
ক্রুশ ছিল তৎকালীন পৌত্তলিক ধর্মের পবিত্রতম প্রতীক।
প্রাচীন মিশরিয়ানরা ক্রুশকে পবিত্র চিহৃ বলে বিশ্বাস করত।
তাদের বহু দেবতার শরীরে এই চিহৃ অংকিত থাকত।
মিশরের অন্যতম দেবতা হোরাসের হাতেও ক্রুস চিহৃ দেখা যায়।
মূলত প্রাচীন মিশরিয়ানরাই ক্রুসের ব্যবহার শুরু করে বলে জানা যায়।
আলেকজান্ডার যখন সম্রাট সেরাপিসের মন্দির ধ্বংস করেন সেই মন্দিরের পাথরের ভিত্তি ছিল ক্রসের উপর, যেগুলো বর্তমান গির্জাগুলোতে থাকে।
মিশরীয় কিছু লোককথায় জানা যায়, প্রাচীন মিশরীয় দেবতা ওসিরিস ক্রুশ ধারণ করে মানুষের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মানুষ অমরত্ব লাভ করত।
এছাড়াও গ্রীক, ব্যবিলিয়ন, পার্শিয়ানদের মধ্যে ক্রুশের ব্যবহার ছিল।
খ্রিষ্ট ধর্মটি এসেনিজ ইহুদীদের সৃষ্টি সেটি, সেটি পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
রাশিচক্রের মেষ রাশি ২৫ ডিসেম্বর সূর্যকে অতিক্রম করে, তাই ঈশ্বরের মেষ ২৫ ডিসেম্বর পূর্ণ জীবন লাভ করে।
এটা যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিন, যা এক সময় একটি ভেড়ার আকৃতিতে পুজিত হত।
খ্রিস্টান চার্চের একটি গোপন নথিতে ভেড়ার বদলে একটি মানুষ্যাকৃতিতে ক্রাইস্টের প্রতিকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা জানা যায়।
প্রথম খ্রিস্টাব্দ থেকেই পৃথিবীতে এই খ্রিষ্ট ধর্মের শুরু।
এইরকম একটি চরিত্রকে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক নবী হযরত মুহাম্মদ স্বীকার করেছেন এবং সাত আসমানে গিয়ে যীশু খ্রিষ্টের সঙ্গে সাক্ষাতের দাবী পর্যন্ত করেছেন!
(সূত্র: এরিয়ান সান-মাইথ: দ্য অরিজিন অব রিলিজিয়ন্স)
কিছু পন্ডিতদের মতে, খ্রিষ্টান শব্দটির প্রথম ব্যবহার শুরু হয় বর্তমানের সিরিয়ার এন্টিয়াক শহরে ৩৫ থেকে ৪০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে ইহুদি এবং অইহুদিদের সমন্বয়ে একটি নতুন ধর্মবিশ্বাসীদের পরিচয় প্রকাশ‍্যে উপস্থাপনের মাধ্যমে।
যিশু খ্রিষ্টের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই এই খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি।
গ্রীক ভাষায় খ্রিষ্ট / Christo শব্দটি হিব্রু শব্দ ‘মেসাইয়াহ্’ থেকে প্রবর্তিত।
ঈশ্বর কর্তৃক মানবজাতির জন্য প্রদান করা নির্দেশনাগুলো পূরণে ঈশ্বরের পছন্দের প্রেরিত পবিত্র ব্যক্তিকে ‘মেসাইয়াহ্’ বলা হয়।
ইহুদিদের বিশ্বাস ছিল, তাদের মুক্তিদাতারূপে এক মেসাইয়াহ্ এর আগমন হবে।
নাজারাথের যীশু খ্রিষ্টকে প্রত্যাশিত সেই আগমনকারী নবী ও পথপ্রদর্শক হিসাবে গণ্য করে, যীশু খ্রিষ্টের মৃত্যুর পর থেকেই এই নতুন ধর্ম বিস্তৃত হতে থাকে।
খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী যতটা বৃদ্ধি হতে থাকে, যীশুর নামের সঙ্গে ‘খ্রিষ্ট’ নাম ততই
বিস্তৃত হতে থাকে।
বেশকিছু প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়, খ্রিষ্ট ধর্মের প্রথম দিকে খ্রিষ্টানরা ছিল ইহুদি। তারা ইহুদি তোরাহ পাঠ ও অনুসরণ করত।
ইহুদিরা যীশু খ্রিষ্টকে মানব জাতির উদ্ধারকর্তা হিসেবে মনে করত।
নাজারথে যীশু খ্রিষ্টের ভক্তদের প্রথমে খ্রিষ্টান নামে সন্মোধন করা হত। যীশু খ্রিষ্ট নিজে ইহুদি হলেও, তিনি ইহুদি ধর্মের অনুষ্ঠান ও পুরোহিতদের প্রাধান্য যীশু খ্রিষ্টকে পছন্দ করতেন না।
যীশু খ্রিষ্ট প্রচার করল ক্ষমা, প্রেম ও প্রীতির ধর্ম। তাঁর মতে সকল মানুষ এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের পুত্র।
যীশুর মতে ঈশ্বর পরম পিতা।
তিনি মনে করতেন, ঈশ্বর অসীম, সর্বশক্তিমান ও দয়াময়।
খ্রিষ্ট ধর্মের বক্তব্যের মধ্যে ইসলামের একাকত্ববাদের মিল আছে। অপরদিকে ভ্রাতৃত্ব প্রেমের দিক থেকে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে অনেকটা মিল পাওয়া যায়।
কিছুদিন পূর্বে ভারতের RSS এর সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা গণেশ দামোদর সাভারকার তাঁর লেখা বইতে দাবি করেছেন, যীশু খ্রিষ্ট একজন তামিল হিন্দু ছিলেন।
কিছু ঐতিহাসিকের মতে,
ইহুদি উপজাতিদের উপর রোমান সাম্রাজ্যের বারংবার নৃশংস অত্যাচারের ফলে খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল।
সশস্ত্র প্রতিরোধে একাধিকবার ব্যর্থ হয়ে ইহুদিদের একটি অংশ পরলোকে মুক্তির অনুসন্ধান করে।
এই সময়ে ডেড সি অঞ্চলে সম্ভবত ইসিন সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে খ্রিষ্ট ধর্মের সূচনা হয়।
ইহুদিদের মধ্য থেকে এভাবে খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তির পেছনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব থাকতে পারে।
সম্রাট অশোকের প্রেরণ করা বৌদ্ধ ধর্মযাজকগণ এই অঞ্চলে ধর্ম প্রচারে তৎপর ছিলেন, এমন কিছু ঐতিহাসিক তথ‍্য প্রাচীন বহু গ্রন্থে পাওয়া যায়।
তাছাড়াও যে অহিংসার তত্ত্ব নিয়ে খ্রিষ্ট ধর্মের উত্থান হয়েছিল, তার কোন পুরানো ঐতিহ্য ইহুদিদের মধ্যে ছিল না।
ডেড সি অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত প্যাপিরাস পাণ্ডুলিপিগুলো থেকে স্পষ্ট হয়েছে, বৌদ্ধ ধর্মের সংগঠন ও তাত্ত্বিক আদর্শের সঙ্গে পুরোনো খ্রিষ্ট ধর্মের অনেক মিল ছিল।
অবশ্য ঐ পাণ্ডুলিপিগুলো আবিষ্কৃত হবার অনেক পূর্বে কিছু পণ্ডিত উল্লেখ করেছিলেন, বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে ইসিনদের মধ্য থেকে খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল।
কিছু ঐতিহাসিকের মতে, নাজারাতের যীশুর জীবন ও বাণীকে ভিত্তি করে খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি।
ইসলামের দৃষ্টিতে হজরত ঈশা (আ.) পয়গম্বরদের মধ্যে বড় একটা স্থান অধিকার করে আছেন।
মুসলমানদের একটি অংশ বিশ্বাস করে, হজরত ঈশা (আ.) এর জন্ম হয়েছে অলৌকিকভাবে।
মুসলমানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কুরআনে হজরত ঈসা (আ.) এর নাম পঁচিশ স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন- ‘ইবনে মরিয়ম’, ‘মসিহ’, ‘আবদুল্লাহ’, ‘রাসূলুল্লাহ’। এছাড়াও ‘ঈশ্বরের বাণী’, ‘রুহুল্লাহ’, ‘ঈশ্বরের চিহ্ন’ এবং অন্য নামে ১৫টি বিভিন্ন সুরায় উল্লেখ করা হয়েছে।
কুরআনে ‘জেসাস’-কে ‘ঈশা’ বলা হয়েছে। হিব্রু ‘ঈসাও’ থেকে আরবীতে ‘ঈশা’ শব্দটি এসেছে, লাতিনে এসেছে ‘জেসাস’ তার ক্ল্যাসিক্যাল নাম ‘জোশুয়া’ থেকে। হিব্রুদের একটা সাধারণ নাম ‘ইসাও’।

খ্রিস্ট ধর্মের প্রসার

রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রতিষ্ঠা পায় মূলত ৩১৩ খ্রিস্টাব্দের কিছু পরে। কনস্টান্টাইনের সময়কাল থেকে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রসার লাভ করতে থাকে।
যিশু খ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্য ছাড়াও সন্ত পৌল, প্রাচীন খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন।
তাঁর রচিত বেশকিছু পুস্তক বাইবেলের নতুন নিয়ম নিয়ে তৈরী।

খ্রিষ্ট ধর্মের বিভক্তি :

খ্রিষ্ট ধর্ম প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। একটি ক্যাথলিক এবং অন্যটি প্রটেস্ট্যান্ট।
ক্যাথলিকরা কুমারী মেরীকে যীশুর মাতা বলে স্বীকার করেন।
অপরদিকে প্রটেস্ট্যান্টরা এটা বিশ্বাস করে না।
বতর্মান খ্রিষ্ট ধর্মে আরও কিছু নতুন বিভক্তিকরণ দেখা যায়।
যীশু খ্রিষ্টের বেশকিছু শিষ্য ছিল, যারা তাঁর বাণী প্রচার করেছেন, সেইন্ট পল তাঁদের মধ্যে প্রধান।
অন্যরা হলেন পল, লিউক ও মার্ক।
খ্রিষ্ট ধর্মে মোক্ষের কথা উল্লেখ থাকলেও, সেই মোক্ষ বৌদ্ধ ধর্মের মোক্ষের মত না।
বর্তমানে পৃথিবীতে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রায় তিরিশটি সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত।
এগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, রোমান ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, বেনিডেকটাইনস, ব্যাপটিস্ট, এরিয়ানাবাদ, নেস্টেরীয়বাদ, মনোফাইজিটিজম, কুয়েকার্স, সেভেন্থ অ্যাডভেনটিস্ট এবং মেথডিজম।
কিছু বিশ্লেষকদের মতে, রাজা কনস্তান্তিনোপলের সহায়তায় যীশুর মৃত্যুর ৩০০ বছর পরে ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে নাইসিয়াতে Nicen Council সম্মেলনের মাধ্যমে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাইবেল এই সম্মেলনের মাধ্যমেই রচনা করা হয় এবং এর মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ত্রিত্ববাদ”।

খ্রিষ্ট ধর্মের ত্রিত্ববাদ :

ত্রিত্ববাদ খ্রিষ্ট ধর্মের অন‍্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। পবিত্র পিতা, পবিত্র পুত্র এবং পবিত্র আত্মা এই তিনের মিলিত রূপই হচ্ছেন ঈশ্বর, এটাই ত্রিত্ববাদ।

খ্রিস্ট ধর্মের মূলনীতি

ক্যাথলিকদের বিশ্বাস- পবিত্র পিতা, পবিত্র পুত্র এবং পবিত্র আত্মা এই তিনজনই ঈশ্বর এবং তিনিই যিশু খ্রিষ্ট। 
অর্থাৎ তিনটি আলাদা রূপে মানুষের কাছে, ঈশ্বর নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। ইহুদিগণ এই মতবাদ অস্বীকার করে।
যিশু খ্রিষ্ট মানবজাতীর পাপের জন্য মৃত‍্যুবরণ করেছেন এই ধারণা খ্রিষ্ট ধর্মানুলম্বীগণ, তাদের ধর্মের বড় একটি মূলনীতি হিসাবে মনে করেন।

বাইবেল ও পুস্তক সংখ‍্যা :

মূল গ্রিক বাইবেল বা ক্যাথলিক বাইবেলে পুস্তকের সংখ্যা ৭২টি।
মার্টিন লুথার ৭টি পূর্ণ বইকে জাল বলে বাতিল করেন।
অন‍্যান‍্য বইগুলো থেকেও বেশকিছু অধ্যায় ও আয়াত জাল বলে বাতিল করেন।
এজন্য প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলে বইয়ের সংখ্যা ৬৬টি।
ক্যাথলিক বাইবেল বাংলায় ‘পবিত্র বাইবেল : জুবিলী বাইবেল‘ নামে অনূদিত এবং বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনী কর্তৃক ১৯৯৯, ২০০৬ সালে প্রকাশিত।
বাংলা বাইবেলের কেরীর অনুবাদ মূল ইংরেজির কাছাকাছি, কিন্তু ভাষা অনেকটাই দুর্বোধ্য।
প্রাচ্যীয় অর্থডক্সদের বাইবেলে আছে ৪৯ টি বই।
হিব্রু বাইবেলে ২৪টি বইকে একত্র করে ওল্ড টেস্টামেন্ট বাইবেলের একটি অংশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অপর একটি অংশ হচ্ছে নতুন নিয়মে। খ্রিষ্ট ধর্মানুলম্বীগণ পুরাতন নিয়মকে তাদের গ্রন্থের একটি অংশ হিসেবে রাখলেও, এটাকে তারা অনুসরণ করে না।
খ্রিষ্ট ধর্মানুলম্বীগণের মতে এটা খ্রিষ্ট ধর্ম প্রতিষ্ঠা কালীন সময়ের মানুষদের জন্য প্রযোজ্য, বর্তমান সময়ের জন‍্য নয়।
তবে বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট ইহুদিদের কাছে গুরুত্বহীন।
তাদের মতে যীশু খ্রিষ্ট একজন সাধারণ ইহুদি রাবাই ছিল। যীশু খ্রিষ্টের জন্মের অলৌকিক ঘটনা তারা বিশ্বাস করে না।
উল্লেখ্য, যিশু খ্রিষ্টের শিষ‍্যদের রচিত নিউ টেস্টামেন্টের মূল ভাষা ছিল কনি গ্রিক। এটি চার ভাগে বিভক্ত-
       * প্রথম পাঁচটি গ্রন্থ তোরাহ নামে পরিচিত।
       * দ্বিতীয়টি ইসরাইল জাতির ইতিহাস সম্পর্কে রচিত ইতিহাস গ্রন্থ।
       * তৃতীয় গ্রন্থটি ভালো ও মন্দ নিয়ে রচিত কাব্যিক জ্ঞান সম্পর্কিত।
       * চতুর্থটি বইতে আছে বাইবেলের নবীদের সম্পর্কে তথ‍্য।
 কিছু মুসলিমরা মনে করেন, ইঞ্জিল হচ্ছে বাইবেল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা সঠিক না। তোরাহ নামে যে বইগুলো, সেগুলো তাওরাত হতে পারে।
খ্রিষ্ট ধর্মানুলম্বীদের বাইবেলের দ্বিতীয় অংশ নিউ টেস্টামেন।
এই গ্রন্থ মূলত যীশু খ্রিষ্টের শিক্ষা ও জীবনপযাপন এবং প্রাথমিক যুগের খ্রিষ্ট ধর্মের বিবরণ উল্লেখ করা।
যীশু খ্রিষ্টের অনুসারীদের রচিত মোট ২৭ টি গ্রন্থ এখানে আছে। শুধু যীশু খ্রিষ্টের নিজের বক্তব্য নিয়ে রচিত বাইবেলকে রেড লেটার বাইবেল বলা হয়।
 নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেলের ২৭ টি গ্রন্থ হচ্ছে-
৪ টি ক্যানোনিকাল গসপেল
১ টি শিষ্যদের আচরণ নিয়ে রচিত
১৪ টি সন্ত পল নিয়ে লেখা
৭ টি ক্যাথলিক এপিস্টল
১ টি দৈববাণীর গ্রন্থ
 ৪৫ থেকে ১৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এগুলো রচিত হয়। খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীগণ এই গ্রন্থের বাণীগুলোই অনুসরণ করে।
Psalm বাইবেল (তৃতীয় হিব্রু বাইবেলে) মুসলমানদের মাঝে যাবুর কিতাব নামে পরিচিত, কারণ হিসাবে বলা হয় এটা দাউদ(আঃ) এর কিতাব।
সবচেয়ে পুরনো বাইবেল পাওয়া যায় ভ্যাটিকানের লাইব্রেরীতে।

ইভাঞ্জেল

“ইভাঞ্জেল” শব্দের বাংলা অনুবাদ “ভালো খবর”। লুক, জন, ম্যাথিউ, মার্ক এই চারটি ক্যানোনিকাল গসপেলক; ইভাঞ্জেল অর্থাৎ, ভালো খবরের বই নামে পরিচিত।
যে ধর্মপ্রচারকগণ অন্য ধর্ম থেকে খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে কাজ করেন, তাদেরকে ইভাঞ্জেলিস্ট নামে সন্মোধন করা হয়।

খ্রিষ্ট ধর্মে বাপ্তাইজম

 

বাপ্তাইজম শব্দের অর্থ, খ্রিষ্ট ধর্মে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্বাস ও স্বীকার করে নেওয়া হয়, বাপ্তাইজ ব্যক্তি যীশু খ্রিষ্টের অনুসারী।
যীশু খ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হয়ে দেহত‍্যাগ করা এবং মৃত্যুর তিন দিন পর সুক্ষ শরীরে দেখা দেওয়ার ঘটনার মাধ্যমে প্রতিকী রুপে মেনে নেয়া হয়।

যোহন বাপ্তাইজ

যোহন খ্রিষ্ট ধর্মের একজন গুরুতপূর্ণ ব্যাক্তি, বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে তার নামে একটি গসপেল রয়েছে। তাঁর পিতার ছিলেন সখরিয়া এবং মায়ের নাম এলিজাবেথ।

খ্রিষ্ট পূর্ব কাকে বলে?

 

খ্রিষ্ট পূর্ব অর্থাৎ BC বলতে বুঝায় Before Christ অর্থাৎ, খ্রিষ্টের জন্মের পূর্বে। আর  খ্রিস্টাব্দ বলতে বুঝায় AD অর্থাৎ Anno Domini অথবা, Year of the lord. এখানে যীশু খ্রিষ্টকে স্রষ্টা হিসেবে মেনে নেয়া হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের ইতিহাস :

 

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন ডঃ উইলিয়াম কেরী (1761-1834)।
তাঁর ব‍্যাবস্থাপনায় শ্রীরামপুর থেকে প্রায় ৪০টি ভাষা ও উপভাষায় খ্রিষ্টধর্মীয় কিছু গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
উইলিয়াম কেরী পরবর্তী অনুবাদগুলোতে বাংলা অনুবাদে কিছু বৈচিত্র্য দেখা যায়।
এসব অনুবাদে God এর বাংলা অনুবাদে ঈশ্বর থেকে আল্লাহ, খোদা, ভগবান এবং যিশু খ্রিষ্টের বাংলা অনুবাদ প্রভু যীশু ঈসা মাসীহ ইত্যাদি শব্দের ব‍্যাবহার দেখা যায়।
কিছু সুত্রমতে, ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচারের প্রাচীনতম নিদর্শন প্রথম শতাব্দীতে ৫২ খ্রিস্টাব্দে মালাবার উপকূলে টমাসের আগমনকে কেন্দ্র করে।
তিনি কয়েক হাজার হিন্দু ব্রাহ্মণকে ধর্মান্তরিত করেছিলেন যীশু খ্রিষ্টের আত্নত‍্যাগ ও জীবনধারার প্রতি আকৃষ্ট করে।
অন‍্য একটি সুত্রমতে, ১৭৪০ সালে প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট, রেভারেন্ড জন জাকারিয়া কিয়ারনন্ডার, বঙ্গভূমিতে আসে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারণার জন‍্য।
১৭৭০ সালে, তিনি পশ্চিমবঙ্গে “মিশন চার্চ” নামে একটি প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ ও নির্মাণ করেন।

বাংলাদেশে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের ইতিহাস :

আলফোনসো ডি আলবুকার্ক এবং পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারক থাকার পরেও ১৫১০ সালে পর্তুগিজদের আগমনের আগে বাংলাদেশে খ্রিষ্ট ধর্মের উপস্থিতি ছিল না।
আলবুকার্ক স্থানীয় মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে করার পরে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের চেষ্টা করেছিলেন।
তাদের বংশধর খ্রিস্টানদের প্রথম প্রজন্ম। ক্যাথলিক পোপ এবং পর্তুগালের রাজার মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে, ১৫১৪ সালের মধ্যে পর্তুগিজরা বাংলায় খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের অধিকার লাভ করে।
১৬৭২ সালে ডোম আন্তোনিও দা রোজারি নামে এক ব‍্যাক্তি (একজন তরুণ বাঙালি, যিনি খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়), ২০,০০০ নিম্নবর্ণের হিন্দুকে খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে সমর্থ হয়।
এরপরে সপ্তদশ থেকে আঠারো শতকের মধ্যে পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকরা বাংলা ভাষায় খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার করেছিলেন।
তারপর থেকে ইভাঞ্জেলিক্যাল বই এবং খ্রিষ্ট ধর্মতত্ত্ব বাংলা ভাষায় লেখা হতে থাকে।
১৮ শতকের মধ্যে উইলিয়াম কেরির মতো ব্রিটিশ মিশনারিরা আরও গির্জা তৈরি করেছিলেন, বাইবেল এবং অন্যান্য খ্রিস্টান গ্রন্থের অনুবাদ এবং ধর্মীয় বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
ব্রিটিশ মিশনারিরাগণ ও এসময় খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে “দিগদর্শন”, “দ্য গসপেল ম্যাগাজিন” এবং “দ্য খ্রিস্টান মহিলা” নামে খ্রিস্টান সংবাদপত্র তৈরি করেছিলেন।
বতর্মান সময়ে, বাংলাদেশে খ্রিষ্ট ধর্মের উত্থানের কৃতিত্ব পশ্চিমা এনজিও এবং খ্রিষ্ট দাতব্য সংস্থাগুলোর, যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর মানবিক সহায়তার কাজে এসেছিল।
তারপর থেকে এই এনজিও এবং দাতব্য সংস্থা বাংলাদেশে শুধুমাত্র জরুরি ত্রাণ, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার জন্য সহায়তা করেনি, তারা বাইবেল পড়ার জন‍্য উৎসাহিত করেছে।
ধারণা করা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৭,০০০ থেকে ২৩,০০০ এনজিও রয়েছে।

বাংলাদেশে চার্চ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস :

বাংলাদেশে ১৬০০ সালে জানুয়ারি মাসে প্রথম গির্জা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
ঐ গির্জাটির নাম ছিল, “যীশুর পবিত্র নামের চার্চ”।
জেসুইটদের সহযোগিতায় ঐ চার্চ নির্মাণ করা হয়েছিল।
তবে তখন শুধু শুধুমাত্র প্রার্থনার অনুমতিই নয়, যশোরের রাজার মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা এবং জায়গা দেওয়া হয়েছিল।
১৬০০ সালে চট্রগ্রামে ২৪ জুন ২য় গির্জাটি নির্মাণ করেন আন্দ্রে বোভস।
ঐ চার্চ নির্মাণে আরাকানেরর্র্য রাজা আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিলেন। গির্জাটির নাম ছিলো “সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট চার্চ”।
১৬০১ সালে তৃতীয় গির্জাটি চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্বে ডোমিনিকানদের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়।
তবে পরবর্তীতে আরাকানদের আক্রমণে এই গির্জাগুলোর বেশিরভাগ ধ্বংস হয়।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার ০.৪% খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী।
 নিশ্চয়ই আর্টিকেল থেকে যীশু খ্রিষ্ট প্রবর্তিত খ্রিষ্ট ধর্মের উৎপত্তি, ইতিহাস ও ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচারের ইতিহাস বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে অবগত হয়েছেন!

3 thoughts on “ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের ইতিহাস | খ্রিষ্ট ধর্মের ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *