আলোচিত সংবাদইতিহাসধর্মসনাতন ধর্ম

ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা | কাশ্মীরের ইতিহাস

ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা
Spread the love

 বর্তমানে কাশ্মীরের অবস্থা দেখে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, কাশ্মীরের ইতিহাসে ঐতিহাসিকভাবে জড়িয়ে আছে ভারতের আলেকজান্ডার খ‍্যাত এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বিক্রমী সম্রাট ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা নামের এক মহান শাসকের নাম। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে, তাঁর বিক্রমী কর্মকাণ্ডের ছোট একটি তালিকা দেওয়া হলো-

১) কাশ্মীরের এই বিখ্যাত হিন্দু রাজা ললিতাদিত্য মুক্তাপিডা ভারতবর্ষে সবচেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্যটি স্থাপন করেছিলেন। 

২) বিখ্যাত এই হিন্দু রাজা প্রবল বিক্রমে একের পর এক ইসলামি রাজ্য, তিব্বতি সহ লুটেরাদের আক্রমণ করেছিলেন এবং প্রতিবারই শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিলেন । 

৩) ভারতের আলেকজান্ডার খ‍্যাত এই হিন্দু সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা, পরাজিত বহিরাগত লুটেরাদের মাথার চুল অর্ধেক কেটে রাজপথে হাঁটিয়ে ছিলেন এবং করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা না চাওয়া পর্যন্ত কেউ ক্ষমা পায় নি । 

৪) অপরাজিত এই মহান হিন্দু সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা শুধু আগ্রাসী আরবীয়দের নয়, তিব্বতি শাসকদেরও কাল ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন । 

৫) এই হিন্দু সম্রাট ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা, তাঁর রাজ‍্যসীমা উত্তরে তুর্কিস্থান থেকে দক্ষিণে কেরালা, পশ্চিমে ইরান থেকে পূর্বে আসাম পর্যন্ত বিস্তার করেছিলেন।

৬) তিনি ভারতবর্ষের এমনি একজন বিক্রমী সম্রাট, যিনি তাঁর জীবদ্দশায় একবারও পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেন নি। 

ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা
ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা

 

রাজতরঙ্গীনি গ্রন্থে বিখ্যাত কাশ্মিরী ঐতিহাসিক কলহন আরবীয় যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন– “দোর্দণ্ডপ্রতাপ ললিতাদিত্যের ক্রোধ তখনই শান্ত হত, যখন তাঁর শত্রু রাজারা হাত জোড় করে তাঁর বিজয়কে স্বীকার করে নিতেন। তাঁর রণবাদ্যের শব্দে শত্রুদেশের জনতা এবং সৈন্যবাহিনী চরম আতংকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত, এমন এক দৃশ্য যেন প্রাণভয়ে ভীত রমণীরা তাদের গর্ভের ভার মোচন করে ফেলেছে।”

ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা কনৌজ, গৌড় প্রদেশ, বঙ্গদেশ, তিব্বত, কুচা, টারফান, আসাম এবং বর্তমান বাংলাদেশ নিজের বিশাল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করেছিলেন।

তিব্বত জয়ের পরে, তিনি সমগ্র পৃথিবী জয়ের উদ্দেশ্যে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, সেনা সদস্য বৃদ্ধি… ইত্যাদির মাধ্যমে একটি বিশাল সেনা বাহিনী তৈরী করেন। এরপর যুদ্ধযাত্রা করেন- প্রথমে পশ্চিমের মহারাষ্ট্রের রাষ্ট্রকূট, এরপর দক্ষিণের পল্লব রাজাদের পরাজিত করলেন। এরপর কলিঙ্গের দখল। এই বিজয়ের পরই তাঁকে আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে তুলনা করে বিদেশী ঐতিহাসিকগণ তাঁকে ভারতের আলেকজান্ডার উপাধি দিয়েছিলেন।

কাশ্মীরের ইতিহাস  

এক শ‍্রেণীর বিকৃত ব‍্যাক্তিদের দাবী- এই উপমহাদেশের ভূস্বর্গ হিসাবে বিখ‍্যাত,  কাশ্মীর ভারতের অংশ নয়। তাদের এই দাবীর সমর্থে কিছু বাম মতাদর্শে পরিচালিত তথাকথিত ইতিহাসবিদ মনগড়া প্রমাণ দিয়ে থাকেন। এদের ভাষ‍্য- ভারত স্বাধীন হবার পরেও ভারতের কয়েকটি রাজ‍্য ছিল, যারা ভারতের অধীনস্থ হতে চায়নি। কাশ্মীর এবং জুনাগড় এমন দুটি রাজ্য। উল্লেখ্য, জুনাগড়ের রাজ‍্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিল কিন্তু শাসক ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের। এজন্য তিনি দেশ ভাগের সময় পাকিস্তানে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সংখ‍্যাগরিষ্ঠ জনগণ বেশিরভাগ হিন্দু থাকার কারণে তাঁরা ভারতের অংশে থাকার সিধান্ত নেন এবং তাদের মুসলিম শাসকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। 

সংখ‍্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার জন‍্য গণভোট আয়োজন করা হয় এবং জুনাগড় রাজ‍্য ভারতের অংশ হয়। অপরদিকে কাশ্মীরের রাজা ছিলেন সনাতন ধর্মানুলম্বী হরি সিংহ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের। রাজা হরি সিংহ প্রথমে স্বাধীন রাজা হিসাবে থাকার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিলেও পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে জহরলাল নেহেরুর সাহায্য কামনা করেন। এই সময় জহরলাল নেহেরু কাশ্মীরকে ভারতের অধীনস্থ করেন৷ 

স্বাভাবিকভাবেই এখানে প্রশ্ন হতে পারে- জুনাগড়ের সংখ‍্যাগরিষ্ঠ জনগণ সনাতনী ছিল, তাই তাকে ভারতের অধীনস্থ করা হয়, কিন্তু কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ঐ রাজ‍্য কেন পাকিস্তানের অধীনস্থ হতে পারল না?  এই প্রশ্ন অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশ্নের সুন্দর একটি উত্তর আছে, অবশ‍্য এই উত্তর পাল্টা প্রশ্ন হিসাবে ভূমিকা রাখবে। উত্তর- রাজা ললিতাদিত‍্য মূক্তিপিদার শাসনামলে কাশ্মীরের সব জনগণ হিন্দু ছিল। 

গজনীর সুলতান মাহমুদ নৃশংস আগ্রাসনে কাশ্মীরের রাজা জয়পালকে যখন পরাজিত করে, সেই সময়েও কাশ্মীরের জনসাধারণ হিন্দু ছিলেন, জয়পালের সন্তান আনন্দপাল যখন যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন তখনও কাশ্মীরের সব জনগণ হিন্দু ছিলেন। পরবর্তীতে লোহারা রাজবংশের শাসনামলেও কাশ্মীরের বেশিরভাগ জনগণ হিন্দু ছিলেন। তাহলে বিংশ শতাব্দীর কাশ্মীর রাজ‍্য কিভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ‍্য হয়ে উঠল? এর একটাই কারণ- নৃশংস হিন্দু গণহত্যা আর নিষ্ঠুর ধর্মান্তকরণের করুণ ইতিহাস।

ফিরে আসি আজকের মূল আলোচনায়। ললিতাদিত‍্য, যাকে ভারতীয় বিকৃত/বামপন্থী ঐতিহাসিকগণ পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর নাম মুছে দেবার চেষ্টা করেছেন। স্কুলের পাঠ্যসূচী তো বাদ দিলাম, কোনো একাডেমিক আলোচনাতেও তাঁর নাম পাওয়া যায়না।এই বিষয়ে গবেষণা তো বহুদূরের কথা! 

অথচ, ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদাকে নিয়ে পরিপূর্ণ তথ্যের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে রাজত্ব করা এই মহান সম্রাটের পূর্ণাঙ্গ তথ‍্য নিয়ে কলহন নামের এক বিখ্যাত ঐতিহাসিক দ্বাদশ শতাব্দীতে “রাজতরঙ্গিনী” নামক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

 রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থটি শুধু ঐতিহাসিক সত্তা নয়, সংস্কৃত ভাষার উপর কলহনের বিশেষ জ্ঞানের পরিচয় দেয়। এই ঐতিহাসিক রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ যদি কলহনের পরিবর্তে কোনো পার্সি, ইসলামি, ব্রিটিশ অথবা অন‍্য কোনো বিদেশী লেখক রচনা করত, তাহলে হয়তো ভারতীয় ইতিহাসে এই মহাবীরের একটু স্থান হতো। 

বহু পরিশ্রমের মাধ্যমে রচিত এই গ্রন্থ ৮ খন্ডে বিভক্ত ও ৭৮২৬টি শ্লোক নিয়ে রচিত। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে, তবে কেন ভারতের ইতিহাসে ললিতাদিত্য নেই? 

এর বহু কারণ আছে, তৎকালীন সময়ের কুখ্যাত হিন্দুবিরোধী বিতর্কিত ঐতিহাসিকগণ বিশেষ করে ইরফান হাবিব, মোহম্মদ হাবিব, রোমিলা থাপার, বিপান চন্দ্র সহ বেশকিছু চাটুকার মুঘল ও ব্রিটিশ শাসন নিয়ে লেখালেখির মাধ্যমে কৌশলে ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার নাম মুছে দিয়েছেন!  এই চাটুকার ঐতিহাসিকগণ সনাতনী এসব মহান সম্রাটদের গৌরবময় বীরত্বের ইতিহাস পরিকল্পনা মাফিক মুছে দিয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার দায়িত্ব প্রাপ্তগণ এসব ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণ তাঁরা দায়িত্ব প্রদানকারী একটি পরিবারের চাটুকার ছিলেন। 

১৯৮৯ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জারি হওয়া একটি সার্কুলারে স্পষ্টভাবে নির্দেশ ছিল যে, মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে হিন্দু মন্দির, স্থাপত‍্য ধ্বংস, ধর্মান্তর, হিন্দুদের উপর অত্যাচার এসব বিষয় কোনো পাঠ্য ইতিহাস বইতে উল্লেখ করা যাবে না। স্বাভাবিকভাবেই এর কারণ, একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট করা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে এই জনগোষ্ঠীর সহায়তা পাওয়া। কিন্তু বিকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করতে যদি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেওয়া হয়, তবে সেই জাতির ভবিষ্যৎ পরিণতি কি?

 স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে,  বিদেশী বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে তুলনীয় এই বিখ্যাত সম্রাটকে ইতিহাস থেকে মুছে দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সম্রাট অশোককে কেন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হিসাবে ঘোষণা করা হল? সম্রাট অশোক সম্পর্কে জানতে হলে,  তাঁর নির্মিত শিলালিপি, এবং বৌদ্ধ শাস্ত্র থেকে তথ‍্য সংগ্রহ করতে হয়। যদিও তৎকালীন সময়ে কয়েকজন বিদেশী ঐতিহাসিক ও ভ্রমণকারীর বর্ণনা পাওয়া যায়, তারপরও সেখানে নিরপেক্ষ ইতিহাস পাওয়া সম্ভব না, এই বিষয়ে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। 

অপরদিকে ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার মৃত্যুর প্রায় ৫০০ বছর পরে রচিত ঐতিহাসিক  রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থকে আজও কাশ্মীর তথা ভারতের ইতিহাসে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। ইতিহাস রচনার জন্য মুক্তিপিদার আত্মা নিশ্চয়ই কহলন/জনরাজদের উপঢৌকন দিতে আসেনি, যেটা এই উপমহাদেশের অনেক ঐতিহাসিক পেয়ে থাকেন! 

এক্ষেত্রে যদি বলা হয় অশোক অহিংসার পথ গ্রহণ করেছিলেন এজন্যই এজন্যই  এই সম্মান দিয়েছে বাম ঐতিহাসিকগণ! কিন্তু তাঁরা ভূলে গিয়েছিলেন, ধর্ম হিংসা তথৈব চ! জেনে রাখা উচিত একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কখনো অহিংসা নীতির উপর ভর করে টিকে থাকতে পারে না।

 যেখানে বিশ্বের পরাশক্তি আমেরিকার মত দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতীক ভয়ংকর এক ঈগল পাখি, শ্রীলংকার মতো দেশে আক্রমণে উদ্যত সিংহ, চীনের ড্রাগন… সেখানে এদেশে শান্তির অশোক স্তম্ভ কি শুধুমাত্র প্রগতির প্রতীক হিসেবেই কাজে লাগানো হয়েছিল? কিছু বিশ্লেষকদের ধারণা, ভারতীয় সংবিধানের কথিত রূপকার আম্বেদকরও বৌদ্ধ ধর্মানুলম্বী ছিলেন তাই হয়তো এখানে কোনো যোগসূত্র ছিল!  ভারতের আলেকজান্ডার এই নাম ভারতের ইতিহাসে স্থান পায় নি, কিন্তু ব্রিটিশদের ইতিহাসের পাঠ‍্যগ্রন্থে ঠিকই স্থান পেয়েছে।

ইতিহাস চাঁপা দেওয়ার কারণে ভারতের ইতিহাসে বহিরাগত লুটেরা আরবীয়/মোঘলগণ আজ মহান, অপরদিকে ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা, পৃথ্বীরাজ, রানা প্রতাপ, শিবাজীর মতো মহান রাজা সম্রাটগণ আজও অবহেলিত!  তৎকালীন বিকৃত ঐতিহাসিকদের কারণে ভারতের সনাতনী অগ্রগতি, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক নীতির উপর বিরুপ প্রভাব সহ বহু বছর ধরে সনাতনী মন/মানসিকতার অনেক বড় ক্ষতি হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে! 

আরও পরুন; মহারানা প্রতাপ

পৃথ্বীরাজ চৌহান

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ

ভারতের আলেকজান্ডার কে?

কাশ্মীর অধিপতি ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা  (মুক্তিপিড় নামেও আখ‍্যায়িত) তিনি  ভারতের আলেকজান্ডার নামে বিশ্বের ইতিহাসে পরিচিত। ভারতের আলেকজান্ডার খ‍্যাত লালিতাদিত্য মুক্তাপিদার নীতি ও যুদ্ধ কৌশল বিদেশের পাঠ‍্যসূচীতে স্থান পেয়েছে কিন্তু এই উপমহাদেশের জনগণ তাঁর সম্পর্কে সামান্যই জানে।

৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মোহম্মদ বিন কাশেমের সিন্ধু আক্রমণের পর থেকে ১০০০-১০২৭ খ্রিষ্টাব্দে গজনীর সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণ পযর্ন্ত প্রায় ৩০০ বছর ভারতবর্ষের ভূমিতে বড় ধরনের কোনো আক্রমণ হয়নি একমাত্র পরাক্রমশালী মহান যোদ্ধা ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদার ভয়ে। তিনি মহাবিক্রমে আরব, তুর্কি, পার্সী, আরব সীমান্ত পর্যন্ত জয় করে আফগানিস্তানে হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপন করে ছিলেন। ভারতের আলেকজান্ডার খ‍্যাত কাশ্মীরের এই মহান শাসক আফগানিস্তানের উত্তরভাগ থেকে শুরু করে বাংলাভূমি পযর্ন্ত এই মহাদেশের বিশাল অঞ্চল নিজের সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করেছিলেন। 

নিজের শাসনামলে সাফল্যের সঙ্গে দারদ, তুরস্ক সহ বেশকিছু বিদেশী বর্বর গোষ্ঠীদের অনবরত আক্রমণের হাত থেকে ভারতভূমিকে রক্ষা করেন এবং ন‍্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে সনাতন ধর্মকে সুরক্ষিত করেন। তিনি তৎকালীন অখণ্ড ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের আফগানিস্তানের গান্ধার, কপিশা, জাবুলিস্থানের স্থানীয় তুর্কি শাহী শাসকদের পরাজিত করে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ইরান ও তুর্কমেনিস্থানের তুর্কি শাসকদের পরাজিত করেছিলেন। 

পামির মালভূমি অতিক্রম করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত প্রদেশ দখলকারী আগ্রাসী তিব্বতি সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার সবচেয়ে অভূতপূর্ব ও গৌরবময় মহাবিজয় হয়েছিল ৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে আল জুনেদের বিরুদ্ধে।  আল জুনেদের বিশাল সেনাবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। 

ললিতাদিত্য ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক ছিলেন, কাশ্মীর থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য তৈরী করে রাজত্ব করেছিলেন। উজবেকিস্তান থেকে শুরু করে বাংলার সুন্দরবন পর্যন্ত, তিনিই একমাত্র সনাতনী শাসক যিনি অখন্ড ভারতকে বাস্তবে রুপ দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে প্রতিবেশী দেশ সহ তার বাইরেও ভারতের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।  

৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে অখণ্ড ভারতবর্ষের অখণ্ডতা এবং পবিত্রতা যখন আরবীয় খলিফা আল জুনেদ বাহিনীর মাধ্যমে বিপন্ন হয়েছিল, তখন কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত‍্য ভারতবর্ষের পরিত্রাতা হয়ে ভারতভূমি রক্ষা করে এবং আগ্রাসীদের উৎখাত করে বিশাল সাম্রাজ্য তৈরী করেছিলেন।

অনেক পরে ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার মধ্য এশিয়া বিজয় নিয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অধ্যাপক আন্দ্রে উইঙ্ক -এর AL Hind, Making of Indo-Islamic world  ছাড়াও কোরিয়ান বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হায়েচোর বিবরণ (খুব সম্ভবত তাঁর ভারত ভ্রমণ ৭২৫ খ্রিষ্টাব্দে ছিল) থেকেও ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় যেগুলো ঐতিহাসিক কলহনের বর্ণনার সঙ্গে একমত পোষণ করে। 

জার্মান ইতিহাসবিদ ও গবেষক, হারমান গোয়েটজ কলহনের রচিত এই ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘রাজতরঙ্গিনী’ সম্পর্কে বলেছেন- ‘রাজতরঙ্গিনী’ শুধুমাত্র ঐতিহাসিক গ্রন্থ না, এটি ভারতবর্ষের আলেকজান্ডার ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার বিশাল সাম্রাজ্য গঠনের ঐতিহাসিক দলিল!  

গৌড়রাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী সময় থেকে পাল রাজবংশের শাসনামল শুরুর পূর্ব পর্যন্ত তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে চরম অরাজকতা বিরাজ করত। তৎকালীন সময়ের লিপি, খালিমপুর তাম্রশাসন ও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম কাব্যে পাল বংশের শাসন শুরুর পূর্ববর্তী সময়ের বাংলার বিশৃঙ্খলা অবস্থাকে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সঠিক কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাবে স্থানীয় প্রধানগণ বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এবং নিজেদের মধ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন‍্য যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। তৎকালীন সময়ে বারবার বিদেশী লুটেরাদের আক্রমণ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে এবং এর কারণেই বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।

অনেকেই বলে থাকেন, প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য নির্মাণ করেছিলেন যেসব রাজা/ সম্রাট তাদের মধ‍্যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য,  ভারতের নেপোলিয়ন সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত, আলাউদ্দিন খিলজি, মুঘল সম্রাট আকবর, ঔরঙ্গজেব উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা একমাত্র হিন্দু রাজা, যিনি প্রবল বিক্রমে একের পর এক আগ্রাসী মুসলিম রাজ্যগুলোকে আক্রমণ করেন এবং প্রতিবারই পরাজিত করেন। তাঁর কাশ্মীর রাজ‍্যকে বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করে ভারতের আলেকজান্ডার হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় সামরিক অভিযানে ব্যয় করেছিলেন।  

ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা
ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা

ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার জন্ম

ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা ৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন তৎকালীন কাশ্মীরের রাজা দুর্লভক প্রতাপাদিত্য। দুর্লভক কাশ্মীরের কর্কট কায়স্থ বংশের বংশধর। উল্লেখ্য, ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার এক পূর্বপুরুষ (তিনি সমসাময়িক রাজার সেনাপতি ছিলেন) দুর্লভ বর্ধন কাশ্মীর রাজার একমাত্র কন্যাকে বিয়ে করেন এবং পরবর্তীতে কর্কট বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার পিতা দুর্ভলক প্রতাপাদিত্য এই দুর্লভ বর্ধনেরই নাতি ছিলেন। চন্দ্রপিদা (মতান্তরে বজ্রাদিত্য) এবং তারাপিদা (মতান্তরে উদয়াদিত্য), নামে তাঁর দুই ভাই ছিল। 

তিনি তৎকালীন সময়ের কাশ্মীরের রাজা দুর্লভক প্রতাপাদিত্যের তৃতীয় পুত্র ছিলেন। কাশ্মীরের কর্কট কায়স্থ বংশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। কয়েক যুগ ধরে এই বংশের সবাই কাশ্মীরের রাজার সেনাবাহিনীতে যোগদান করত। অর্থাৎ ক্ষত্রিয় বংশ এবং এই বংশ বীরত্বের জন্য অনেক বিখ্যাত ছিল। এই কারণে কাশ্মীরের নৃপতি তাঁদের শাক্যসেনা উপাধি দিয়েছিলেন। কিন্তু শুরুতে এই বংশের কাশ্মীরের শাসনের সক্ষমতা ছিল না। 

ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদার সিংহাসন আহোরণ

নিয়ম অনুযায়ী জ্যেষ্ঠপুত্র চন্দ্রাপিদা প্রথমে সিংহাসনে আহোরণ করেন। কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যু বরণ করার কারণে, তারপর তারাপিদা সিংহাসনে আহোরণ করেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালীন মাত্র দেড় বছরের মাথায় রোগাক্রান্ত হয়ে তিনিও মৃত্যু বরণ করেন। তারাপিদার মৃত্যুর পরে ৭১৯ খ্রিষ্টাব্দে ২০ বছর বয়সে সিংহাসন আহোরণ করেন ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা। (কিছু ঐতিহাসিকের মতে, ললিতাদিত্য ৭২৪ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরের সিংহাসন আহোরণ করেছিলেন।) উল্লেখ্য, প্রাচীন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে কাশ্মীর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সপ্তম শতকে কার্কট বংশের প্রতিষ্ঠাতা দুর্লভ বর্ধনের শাসনামল থেকে।

ললিতাদিত‍্য মুক্তাপিদা এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা হয়েছিলেন।ঐতিহাসিক কলহনের বর্ণনা অনুযায়ী ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার রাজত্বকাল ছিল ৩৬ বছর, ৭ মাস এবং ১১ দিন পযর্ন্ত। অর্থাৎ তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী ললিতাদিত্য ৭০০-৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। তবে, এই তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে, আধুনিক ঐতিহাসিকদের ধারণা, ৭২৪/২৫-৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ললিতাদিত্যের শাসনামল ছিল।  কলহনের তথ‍্য অনুযায়ী ললিতাদিত্য, নিজেকে পৌরাণিক নাগ রাজা কর্কোট বংশের বংশধর হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ব করতেন।

ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদার কাশ্মীর রাজ‍্য রক্ষা, সাম্রাজ্য গঠন ও শাসনামল 

এরমধ্যে ভারতবর্ষে মুসলিম আগ্রাসন শুরু হয় এবং মোহাম্মদ বিন কাশেমের নেতৃত্বে মুসলমানদের বিশাল সেনাবাহিনী মুলতান, পেশোয়ার, সোয়াত, এবং সিন্ধু জয় করে সমগ্র মধ্য ভারত জয় করার জন্য এগিয়ে যায় কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে। প্রথমে ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা নিজে সেনাবাহিনী নিয়ে তিব্বতের অধীনস্থ লাদাখ অঞ্চলের কয়েকজন ছোট রাজা দারাদা (দার্দ),কভোজা (কম্বোজ), ভুট্টা সহ বেশকিছু  উপজাতিদের সঙ্গে যুদ্ধে করেন এবং খুব কম সময়ের মধ্যে তিনি এই অঞ্চলকে নিজের অধীনস্থ করেন তাদের পরাজিত করে। 

আরব ও তুর্কিদের বিরুদ্ধে ললিতাদিত‍্যের বিজয়

খলিফা হিশামের নির্দেশে সিন্ধুর আরব গভর্নর জুনায়েদ কাশ্মীর আক্রমণ করেন। মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মোহাম্মদের মৃত্যুর পরে চারটি প্রধান খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উমাইয়াদ ২য় খিলাফত ছিল, যার রাজধানী সিরিয়ার দামেস্কে ছিল। আরবীয়গণ মুহাম্মদ বিন কাসিমের সঙ্গে সিন্ধুতে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং এই অঞ্চল সম্পূর্ণ লুণ্ঠিত হয়েছিল। এই অঞ্চল লুটপাটের পরে কাশ্মীরের দিকে নজর দিয়েছিল। কারণ কাশ্মীর তখন একটি সমৃদ্ধ রাজ‍্য ছিল। 

প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে নজর দিলে দেখা যায়, সনাতনী রাজা/সম্রাটগণ যুদ্ধে জয় করা রাজ‍্যের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে ভারতীয় সংস্কৃতি জোর করে প্রচার করে নাই। ইতিহাস বিখ্যাত ভারতীয় রাজা সম্রাটগণ, যখন একে অপরের সাথে যুদ্ধ করত, তখন তাঁরা কিছু যুদ্ধ নীতি অনুযায়ী যুদ্ধ করত।  

কিন্তু তৎকালীন সময়ের আরবীয়, মুঘলগণ অথবা অন্যান্য আক্রমণকারীরা তাদের জয় করা অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধ্বংস করেছে এবং যুদ্ধ নীতি অনুসরণ না করে সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করেছে। তারা বেসামরিক জনগণ ও নিরপরাধদের হত্যা করেছে ধর্মান্তরিত না হলে, ক্ষেতের ফসল পুড়িয়ে দিয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে, জোর করে ধর্মান্তরিত এবং দাসী হিসেবে ভোগ করেছে। বর্বর এই আক্রমণকারীদের কাছে পরাজয়ের অর্থ- নিজ দেশের ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিনাশ। 

ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা এই বিষয়গুলো সবসময় মনে রাখতেন, এজন্য তিনি বর্বরদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে পাল্টা আক্রমণ করে তাদের শায়েস্তা করেছিলেন। তিনি শুধু নিজের দেশে বহিরাগত আক্রমণকারী আরবীয়, তুর্কি, তিব্বতিদের পরাজিত করেননি, তাদের দেশ আক্রমণ করে তাদের হৃদয়ে এমন ভীতি সৃষ্টি করেছিলেন যে, পরবর্তী প্রায় ৩০০ বছর ধরে কেউ ভারতভূমির দিকে আগ্রাসনের সাহস করেনি।

এরপর ৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে জুনেদ সিন্ধু প্রদেশের শাসনভার গ্রহণ করে সমগ্র ভারত জয় করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ললিতাদিত্য ধারণা করেছিলেন, জুনেদের সেনাবাহিনী কাশ্মীর দখলে আসবে। তাই তিনি কনৌজের রাজা যশবর্মনের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে, শক্তিশালী বৃহৎ সেনাবাহিনী তৈরী করেন। 

উল্লেখ্য, রাজা যশবর্মনের অধীনস্থ ছিল- বর্তমান বিহার, উত্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ সহ বঙ্গভূমির একাংশ। অপরদিকে তখন ললিতাদিত্যের নিয়ন্ত্রণে কাশ্মীর, হরিয়ানা এবং উত্তর পাঞ্জাব। এরপর শত্রুসৈন‍্যদের গতিবিধির উপর নজর রেখে অপেক্ষা করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রথমে তিনি আক্রমণ করবেন না। এভাবে কয়েকটি মাস অতিক্রমের পরে ললিতাদিত‍্যের আশঙ্কা সত্যি করে জুনেদের নেতৃত্বে আগ্রাসী আরবীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীর সীমান্তে আক্রমণ করে। তখন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাল্টা প্রতিরোধ করেন ললিতাদিত্য এবং যশবর্মন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আরবীয় বাহিনী পরাজয় বরণ করে। 

এরপর রাজা ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার কাছে সংবাদ আসে, বর্তমানে আফগানিস্তান অঞ্চলে আরবীয়গণ নির্মম অত্যাচার করছে হিন্দুদের উপর। হাজার হাজার হিন্দু প্রাণ বাঁচাতে পলায়ন করছে। তিনি বুঝতে পারেন, কাশ্মীরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে আরবীয়গণ। সংবাদ শোনার পরে ললিতাদিত্য ক্রুদ্ধ হয়ে নির্দেশ দেন পরাজিত আরব সেনাদের মাথার চুল অর্ধেক কেটে ফেলতে। এরপর এই হিন্দু রাজা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন আগ্রাসী আরবীয়দের শায়েস্তা করতে। 

ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা
ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা

 

যশবর্মনকে রেখে তিনি নিজে বৃহৎ একটি সেনাবাহিনী নিয়ে দার্দিস্থান (বর্তমানে উত্তর পাকিস্তান এবং উত্তর পূর্ব আফগানিস্তান) আক্রমণ করেন। কয়েক দিনের যুদ্ধে দার্দিস্থান নিজ অধীনস্থ করেন। এরপর তিনি নজর দেন বর্তমানের উজবেকিস্থান, তাজিকিস্তান, দক্ষিণ কিরগিজস্তান, এবং দক্ষিণ পশ্চিম কাজাকস্তানের দিকে। সহজেই বিজয় অর্জন করেন এসব দেশে। এরপর তিনি তুর্কিস্তান জয়ের ইচ্ছা পোষণ করে আক্রমণ করেন। বুখারায় (বর্তমানে তুর্কিস্তানের অন্তর্গত) তখন মুমিন নামে এক আরবীয় পরাক্রমশালী শাসকের রাজত্ব ছিল। তিনি চারবার যুদ্ধ করেও ললিতাদিত্যকে পরাজিত করতে পারেননি। 

তিনি তখন প্রাণভয়ে আত্মসমর্পন করেন এবং ললিতাদিত‍্যের আনুগত্য স্বীকার ও জিজিয়া কর প্রদান করতে সম্মত হলেন। ইতিহাসে একটাই উদাহরণ আছে, বিজয়ী হিন্দু রাজাকে মুসলিম শাসকের জিজিয়া দেওয়ার। এই যুদ্ধের বিষয়ে ঐতিহাসিক কলহন বলেছেন- “দোর্দণ্ড প্রতাপ লালিতাদিত্যের ক্রোধ তখনই শান্ত হত, যখন তাঁর শত্রু রাজাগণ হাত জোড় করে তাঁর অধীনতা স্বীকার করতেন। তাঁর রণবাদ্যের শব্দে শত্রু দেশের জনগণ এবং সৈন্যবাহিনী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হতো” 

ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা, জুনায়েদ এবং আগ্রাসী আরবীয় সেনাবাহিনীকে এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিলেন যে জুনায়েদ বেঁচে থাকা পর্যন্ত কাশ্মীর আক্রমণ করা স্বপ্নেও ভাবে নাই!  ‘ফাতেনামা সিন্ধু’-তে ললিতাদিত‍্য সম্পর্কে বর্ণনা আছে- ললিতাদিত্য তুখারা (বর্তমানে তুর্কমেনিস্তানের তুর্কি এবং বাদাকস্তান থেকে তোচরান), ভুটাস (বর্তমানে বালুতিস্তান এবং তিব্বত) এবং দারদাস অঞ্চলগুলো জয় করেছিলেন। 

পার্সিয়ান কিংবদন্তি আল-বেরুনী একাদশ শতাব্দীতে এই কাশ্মীরি রাজার কথা উল্লেখ করেছেন, মুক্তো-পালক নামে। এই বিখ্যাত পণ্ডিত ও গবেষক আল বেরুনী তাঁর রচিত ‘তারিখ-ই-হিন্দ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, কাশ্মীরিরা তিব্বতীদের বিরুদ্ধে তাঁদের বিজয় হিসাবে দ্বিতীয় চৈত্র উদযাপন করেছিল।

আল বেরুণির ভাষ‍্যমতে, একজন কাশ্মীরি রাজা উজবেকিস্তানের গভর্নর মোমিনকে পরাজিত করেছিলেন। তিনি ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। তাঁর কারণে মুসলিম শাসকগণ কাশ্মীর তথা ভারত আক্রমণ করতে ভয় পেতেন।  হিন্দুকুশ-পামির এলাকাতেও তিনি বিজয় অর্জন করেছেন। 

তিনি কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য প্রসারিত করেন এবং কারাকোরাম পর্বতশ্রেণীতে গমন করেন।  ভারতভূমি আক্রমণের কারণে তিনি আরবদের প্রতি এতটাই ক্ষিপ্ত ছিলেন যে, তিনি যুদ্ধে বন্দী সেনাদের মাথার চুল অর্ধেক কেটে ফেরত পাঠাতেন। উত্তরে তিব্বত থেকে শুরু করে দ্বারকা এবং দক্ষিণে ওড়িষ‍্যার সাগর, পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত ললিতাদিত্য প্রবল বিক্রমে তাঁর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাঁর সেনাবাহিনী আরণ্যক রাজ্যে (পারস্য) পৌঁছেছিল, যা বর্তমানে ইরান নামে পরিচিত।

ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা শুধু একজন মহান বীর যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি একজন প্রজাদরদী শাসক এবং সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্প,স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের মহান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি স্থাপত্য বিদ‍্যার অপূর্ব নিদর্শন রেখেছেন, তাঁর শাসনামলে নির্মিত বেশকিছু মন্দির ও স্থাপত্য এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ‍্য দেয়। তাঁর শাসনামলে ক্ষুদ্র কাশ্মীর রাজ‍্য, বিশাল সাম্রাজ‍্যের অধিকারী হয়ে সনাতনী শিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞান এবং স্থাপত্যের একটি বড় কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত লাভ করে।

তিনি কাশ্মীরে অনেকগুলো শিক্ষাকেন্দ্র ও গুরুকূল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেগুলো উগ্র ইসলামিক আগ্রাসনে ধ্বংস হয়েছে। আরব এবং তিব্বতের একাংশ বিজয়ের পরে দেশের অভ্যন্তরে একটি নতুন সমস্যার মুখে পড়েন ললিতাদিত্য। ৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শ্রীনগর থেকে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করে বর্তমান ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বারামুল্লা জেলায় পরাশপুরে স্থানান্তরিত করেছিলেন। পরবর্তীতে কনৌজের গাদিপুরায় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। নিজেদের শক্তি ও উত্তর ভারতের সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি নিয়ে যশবর্মনের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই বিরোধ রাজা যশবর্মন শুরু করেছিল। 

আলোচনার মাধ্যমে সুফল না পেয়ে ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা উপলব্ধি করলেন দেশের অভ্যন্তরে মিত্রদের সঙ্গে বিরোধ থাকার অর্থ দুর্বলতাকে আমন্ত্রণ করা। একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন করতে হলে প্রথমেই দেশের অভ‍্যন্তর শক্তিশালী করতে হবে। অতএব, দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিকল্প নেই। 

কিছু ইতিহাসবিদের মতে, ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা ও যশোবর্মণের এই যুদ্ধ দীর্ঘ হয়, পরবর্তীতে যশোবর্মণ পরাজয় এড়াতে ললিতাদিত‍্যের কাছে “যশোবর্মণ ও ললিতাদিত‍্যর চুক্তি” নামে একটি শান্তি চুক্তির প্রস্তাব করেন। কিন্তু ললিতাদিত্যের সেনাপতি মিত্রসরামণ এই চুক্তির নাম নিয়ে আপত্তি জানান এবং চুক্তির নাম সংশোধন করে যশোবর্মণের নামের আগে ললিতাদিত্যের নাম দিতে বলেন। প্রথমে ললিতাদিত্য সেনাপতি মিত্রসরামণকে যুদ্ধ দীর্ঘ করা এবং এই চুক্তিতে দেড়ী হওয়ার জন‍্য ভৎসনা করলেও, পরবর্তীতে ললিতাদিত্য নিজেই এই সেনাপতির সঙ্গে সহমত প্রদান করেন।

তারপর তিনি চুক্তি বাতিল করেন এবং ৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা যশবর্মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এর ফলে কনৌজ রাজ‍্য ললিতাদিত্যের সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়। এরপর অতি সহজেই তিনি গৌড় এবং বঙ্গদেশ নিজের সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে নেন। কলহন তাঁর রাজতরঙ্গীনিতে উল্লেখ করেছেন, গৌড়ের পাঁচজন রাজাকে ললিতাদিত্য পরাজিত করেছিলেন। 

ললিতাদিত্য এখানে পাঁচটি নতুন স্থাপত্য তৈরী করেন এবং দেখাশোনার জন‍্য অন্যান্য রাজকুমার ও সামন্তদের নিয়োগ দেন। এরপর ললিতাদিত্য পূর্ব দিকে জয়ের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায় এবং কলিঙ্গ জয় করেন। গৌড় রাজ‍্য নিজ অধীনস্থ করে সাম্রাজ‍্য বর্ধিত করতে নজর দেন। ত‍ৎকালীন সময়ে গোসাল নামে গৌড়ের রাজা ছিল। গোসাল তখন আভ্যন্তরীণ ও বহিঃশক্তির আক্রমণে এমনিতেই সংকটে ছিল। ললিতাদিত্যের বিশাল সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তাঁর তখন ছিল না। এক্ষেত্রে তিনি হাতি বাহিনী উপহার হিসাবে প্রেরণ করে ললিতাদিত্যের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন।

ললিতাদিত্য এই সন্ধির প্রস্তাব গ্রহণ করেন, এরপর তিনি মগধ ও আসাম নিজ অধীনস্থ করেন। এরপর ললিতাদিত‍্য, পূর্ব সমুদ্র উপকূলে থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যুদ্ধ যাত্রা করেন এবং কর্ণাটক জয় করেন। রত্ত নামে কর্ণাটা রাণী বিন্ধ্য পর্বতমালা এলাকায়  ললিতাদিত্যের জন্য উপযোগী রাস্তা নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। তিনি অনেক শক্তিশালী ছিল, তাঁর মতো শক্তিশালী শাসক ললিতাদিত্যের অধীনতা স্বীকার করেছিলেন। কলহনের বর্ণনা অনুযায়ী, দক্ষিণে ললিতাদিত্যের সেনাবাহিনী নারকেল গাছের দ্রাক্ষারস পান করে, এবং কাবেরি নদীর তীরের মনোরম বাতাস উপভোগ করে ক্লান্তি ভূলে যায়। এরপর ললিতাদিত্য

কোঙ্কন, দ্বারকা জয় করে নিজ সাম্রাজ্য সীমা আরও বর্ধিত করেন। দক্ষিণ রাজাদের পরাজিত করে ললিতাদিত্য অবন্তী থেকে উত্তরাপাঠ পর্যন্ত গিয়ে বেশ কয়েকজন শক্তিশালী রাজাদের সাথে যুদ্ধ করেন এবং বিজয় অর্জন করেন। তিনি কম্বোজা রাজ্যে জয় করে, সেখানকার বিখ্যাত ঘোড়াগুলো নিজ সেনাবাহিনীর জন‍্য সংগ্রহ করেন। ঐতিহাসিক কলহনের ভাষ‍্য মতে, সাপ যেমন গরুড়কে দেখে দ্রুত লুকিয়ে পড়ে ঠিক তেমনি ললিতাদিত্যকে দেখার পরে শত্রুবাহিনী ভয়ে আত্মগোপন করত।

বহুদেশ বিজয়ের মাধ্যমে প্রচুর সম্পদ কাশ্মীরের অধীনস্থ হয়। ললিতাদিত‍্য তাঁর পরিচারকদের হাতে কয়েকটি দেশের শাসনভার প্রদান করেন। ঐতিহাসিক কলহনের বর্ণনা অনুযায়ী, ললিতাদিত‍্য বালির মহাসাগরের পরে একটি বৃহৎ পতিত ভূমি অতিক্রম করার কিছুদিন পরে তিনি উত্তরের সীমানাহীন এলাকার অভিমুখে যাত্রা করেন। তৎকালীন সময়ে তিনিই প্রথম ভারতীয় যোদ্ধা, যিনি এই দেশগুলো জয়ের উদ্দেশ্যে গিয়েছিল। এই যুদ্ধ অভিযানের সময়, ললিতাদিত‍্যের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য সনাতনী দেবতা কুবের কিছু যক্ষদের প্রেরণ করে এবং ললিতাদিত‍্য  এদের সঙ্গে যুদ্ধে বহু দুঃসাহসিক কাজ করেছিল। (সম্ভবত, এখানে কলহন আরবীয় অথবা আফ্রিকান সৈন্যদের কথা বলছেন)।

এরমধ্যে তিব্বত অনেকটা শক্তিশালী সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছিল। এই সাম্রাজ্যকে প্রতিহত করতে নজর দেন তিনি। কিন্তু অজানা ভূখণ্ড, অপরিচিত আবহাওয়া এবং জলবায়ু। অতএব, এখানে বিজয় অর্জনে এই দেশ সম্পর্কে অবগত এমন মিত্র দেশের সহায়তা দরকার। এক্ষেত্রে রাজা ললিতাদিত্য কূটনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, চীনের ট্যাং রাজবংশের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, সপ্তম শতাব্দীতে এই ট্যাং বংশ অনেক শক্তিশালী হয়েছিল, কিন্তু অষ্টম শতাব্দীতে তিব্বত শক্তিশালী হয় এবং মধ্য চীনের বেশকিছু অঞ্চল দখল করে।  এজন্য স্বাভাবিকভাবে তিব্বতের উপর চীনের এই রাজবংশ বিদ্বেষ পোষণ করত। 

এসব বিষয়ে ললিতাদিত্য অবগত ছিলেন, তাই তিনি ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ট্যাং রাজ বংশের সঙ্গে যোগাযোগ করে মিত্রতা স্থাপন করেন। কোনরকম চিন্তাভাবনা না করেই ললিতাদিত্যের এই প্রস্তাবে চীনের রাজবংশ একবাক‍্যে সমর্থন করে। স্বল্প সময়ের মধ‍্যেই ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার সহায়তার জন‍্য কয়েক হাজার সুসজ্জিত অশ্বারোহী যোদ্ধা সহ একটি বড় পদাতিক বাহিনী প্রেরণ করে এবং তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়।

ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা এবং চীনের যৌথ আক্রমণে শক্তিশালী তিব্বত পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের ফলে কুচা এবং টারফান অঞ্চল ললিতাদিত্যের অধীনস্থ হয়। তৎকালীন সময় ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে কুচা অঞ্চল অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কুচা অঞ্চল নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকার অর্থ- প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগাযোগ এবং বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিল্ক রুটের একটি উল্লেখযোগ্য শাখার উপর আধিপত্য।

ললিতাদিত্য নাম চীনের টাং রাজবংশের রেকর্ডে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকগণ ‘নিউ বুক অফ টাং -এ একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ খুঁজে পেয়েছেন। চীনের এই গ্ৰন্থে তাকে মুক্তাপির  হিসাবে উল্লেখ করা রয়েছে।  জনশ্রুতি আছে, মেওয়ারের বিখ্যাত যোদ্ধা বাপ্পা রাওয়াল শুধুমাত্র ললিতাদিত্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন না, তিনি বিদেশী আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ললিতাদিত‍্যের বিখ্যাত কিছু যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

 ললিতাদিত্য তাঁর সেনাবাহিনীতে অনেক ভাড়াটে চীন সেনা এবং যুদ্ধকৌশলবিদদের নিয়োগ দিয়েছিলেন, এই কারণে আরব ও তিব্বত বিজয়ে তিনি দ্রুত সফলতা পেয়েছিলেন। এরপরে তিনি আসাম এবং বর্তমান বাংলাদেশ নিজের সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন।

তিব্বত বিজয়ের পরে তিনি তাঁর সাম্রাজ্য আরও বিস্তার করতে মনোনিবেশ করেন। এজন্য উপযুক্ত সেনাবাহিনী তৈরী করেন প্রয়োজনীয় অস্ত্র দিয়ে কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। এরপর বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বিশ্ব জয়ে প্রথমে পশ্চিম দিকে গমন করেন। তখন মহারাষ্ট্রে রাষ্ট্রকূট বংশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এদের পরাজিত করে ললিতাদিত্য দক্ষিণে যুদ্ধযাত্রা করেন। পল্লব রাজাদের পরাজিত করে, কলিঙ্গ নিজের অধীনে নিয়ে আসেন। এমনভাবে ক্রমাগত বিজয় অর্জনের কারণে বিদেশী ঐতিহাসিকগণ তাঁকে আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে তুলনা করেন এবং ভারতের আলেকজান্ডার উপাধি দিয়েছিলেন।

মগধ, গৌড়, কামরূপ ও কলিঙ্গ জয় করেছিলেন তিনি। দক্ষিণ ভারতের চালুক্য শক্তিকে তিনি পরাজিত করে, কর্ণাটক নিজ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করে কাবেরী উপত্যকা পর্যন্ত অগ্রসর হন। এরপর তিনি পশ্চিম দিকে সাম্রাজ্য বিস্তারে নজর দেন এবং কোঙ্কন, দ্বারকা, কাথিওয়াড়, মালব ও গুজরাট জয় করেন। কিছু ঐতিহাসিকের মতে- 

তিব্বত ও আরবীয়গণের আক্রমণ প্রায় একই সময়ে হয়েছিল। রাজা ললিতাদিত্য প্রথমে তিব্বতিদের পরাজিত করে পরবর্তীতে আরবীয়দের আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আঘাতে শোচনীয় অবস্থা করেন। আগ্রাসী আরবীয়দের তুর্কি পর্যন্ত তাড়িয়ে তাঁর সাম্রাজ্য তুর্কি পযর্ন্ত বিস্তার করেছিলেন।

রাজা ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদার রাজ‍্যসীমা

রাজা ললিতাদিত্যের রাজ‍্যসীমা বিস্তৃত হয়েছিল পূর্বদিকে তিব্বত থেকে পশ্চিমে ইরান পর্যন্ত। উত্তরে তুর্কিস্তান থেকে দক্ষিণে কেরালা পযর্ন্ত। কাশ্মীরের এই বিখ্যাত রাজা ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদার সাম্রাজ্য বাংলা থেকে তিব্বত পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। উত্তর ও পশ্চিমে কম্বোজ হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং আফগানিস্থানের গান্ধার ও হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে পারস্য ও তুর্কমেনিস্থানের বেশকিছু অঞ্চল পর্যন্ত, উত্তর ও পূর্বে অাসামের কামরূপ পর্যন্ত, পূর্বদিকে বাংলা হয়ে কলিঙ্গ পর্যন্ত, দক্ষিণে বিন্দ্য পর্বত অতিক্রম করে কাবেরি নদী পর্যন্ত, পশ্চিমে গুজরাটের দ্বারকা ও অবন্তী রাজ্য পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল মহান ও অপরাজিত সম্রাট ললিতাদিত্যের সাম্রাজ্য। 

তাঁর শাসনামলে কাশ্মীর শুধু ভারতের নয়, সমগ্র মধ্য এশিয়ার শক্তিকেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা শুধু একজন পরাক্রমশালী যোদ্ধা ছিলেন না, একজন ন‍্যায়পরায়ণ মহান রাজা হিসাবেও ইতিহাসের পৃষ্ঠা আলোকিত করেছেন। তিনি বুঝেছিলেন, প্রজাগণ যদি অত্যধিক বিত্তশালী হয়ে ওঠে, তবে অহংকারের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করবে। 

এজন্য তিনি ধনসম্পদ সঞ্চয়ের উর্ধ্বসীমা রেখা দিয়েছিলেন নিয়ম করে। প্রজাগণ যতই ক্ষমতাবান হউক, মাত্রাতিরিক্ত সম্পদ কেউ সঞ্চয় করতে পারবে না। সামরিক বাহিনীর জন‍্যও তাঁর কঠোর নিয়ম ছিল। ভারতের আলেকজান্ডার হিসাবে খ‍্যাত ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা উপলব্ধি করেছিলেন, শুধু সাম্রাজ্য বর্ধিত করা একজন সফল সম্রাটের কর্তব্য না, সুশাসন, ন‍্যায়পরায়ণতা এবং সাম্রাজ্যের উন্নয়নের দিকেও নজর দেওয়া উচিত। 

একজন সম্রাট হিসেবে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস কিংবদন্তির সমতুল‍্য। এই বিষয়ে ঐতিহাসিক কলহনের রাজতরঙ্গিনী নেওয়া একটি অংশ- “যে নদী তাদের নিজস্ব অঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয়েছে, তাদের জন্য শুধু সমুদ্রই সীমাবদ্ধ। কিন্তু যারা প্রকৃতপক্ষে বিজয় অর্জন করার অভিলাষী তাদের পক্ষে সীমাবদ্ধতা নেই কোথাও”

রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে ধর্মীয় স্থাপত্য নির্মাণ এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিশদ বর্ণনা আছে। তৎকালীন সময়ে একটা প্রবাদ বাক‍্য প্রচলিত ছিল, ললিতাদিত্য মুক্তাপিদার কাছ থেকে কেউ কোনোদিন শূন্য হাতে আসে না। এই প্রবাদ তাঁর মহানুভবতা/দানশীলতার পরিচয় দেয়। ললিতাদিত্য কাশ্মীর ছাড়াও সমগ্র ভারতে বহু সংখ্যক মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর নির্মিত এসব ধর্মীয় স্থাপত্যগুলো বিস্ময়কর কারুকার্যের মাধ্যমে তৈরী। ললিতাদিত‍্যের শাসনামলে কাশ্মীর স্বর্ণযুগ হিসাবে পরিণত হয়, সেখানে শিল্প, স্থাপত্য এবং শিক্ষার বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছিল।  

 জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবন যাপনের সাথে সম্পৃক্ত বহু স্থাপত্য নির্মাণ বিষয়ে তথ‍্য পাওয়া যায়। তিনি জানতেন, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পদ ব‍্যাতীত কোনো জাতি তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারেনা। উল্লেখ্য, ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার মৃত্যুর প্রায় পাঁচশ বছর পরে এই রাজতরঙ্গীনি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, এটা প্রথম রাজতরঙ্গিনী নাকি জনরাজের রচিত ২য় রাজতরঙ্গিনী? এটা কলহনের রচিত প্রথম রাজতরঙ্গিনী।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ সর্ব প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করে বিশ্বের দরবারে পৌছে দেন অরেল স্টেইন। এর ফলে বিদেশী ঐতিহাসিকগণ ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদাকে Alexander of India উপাধি প্রদান করে। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদক স্টেইন, ললিতাদিত্যের নিকট যশোবর্মণের পরাজয় কে ঐতিহাসিক সত্য হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কলহনের রচিত রাজতরঙ্গনি গ্রন্থের ঐতিহাসিক বিবরণের  মাধ্যমে পরবর্তী বিজয়গুলোকে “সুস্পষ্টভাবে কিংবদন্তী” হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। 

ঐতিহাসিক সি ভি ভি বৈদ্য -এর মতে, কহলনের এই বিবরণ প্রথমে কাল্পনিক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর ‘চার্চ নামা’ -তে পাওয়া যায়, মুহাম্মদ বিন কাসিমকে রাজা দহির সম্বোধন করে এই লেখার একটি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “কাশ্মীরে এমন এক হিন্দু রাজা আছে, যার কাজে সবাই নতজানু হয়, তাকে বিদেশিগণ পর্যন্ত সম্মান করে, তাঁর সামনে মারকান, তুরানি সহ প্রভৃতি শাসকরা পযর্ন্ত তাঁর চরণ বন্দনা করে”। 

যুদ্ধক্ষেদ্ধে বিশেষ রণকৌশল, শৌর্য আর পরাক্রমে তিনি প্রাচীন ভারতবর্ষের সমস্ত সম্রাটদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পরে তিনি একমাত্র ভারতীয় বিখ্যাত সম্রাট, যার তরবারির স্পর্শে কাশ্মীরের রাজ‍্যসীমা প্রাচীন ভারতবর্ষের মানচিত্র অতিক্রম করে ইরান, তুর্কমেনিস্থান, তিব্বত এবং চিনের তাং সাম্রাজ্যের অন্তর্গত তাকলামাকান আর গোবি মরুভূমির বালুকাবেলা পযর্ন্ত বিস্তার লাভ করে বিশাল সাম্রাজ্যের রুপ নিয়েছিল। 

ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদার নির্মিত কিছু স্থাপত‍্যের বর্ণনা 

রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ থেকে ললিতাদিত‍্যের নির্মিত অসাধারণ স্থাপত্যের কিছু বর্ণনা দেওয়া হলো-

১. রুপার তৈরী ৬২০০০ কেজি ওজনের একটি গগনচুম্বী বুদ্ধমূর্তি।

২. শূণ্যে ভাসমান  একটি বৃহত্তম নরহরি প্রতিমা। বিশেষ কৌশলে নির্মিত এই প্রতিমার মাথার উপরে এবং পায়ের নিচে চুম্বক লাগানো হয়েছিল। অসাধারণ নির্মাণ কৌশল ও চুম্বক দুইটির কারণে প্রতিমা শূণ্যে ভাসমান থাকত।

৩. ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গকৃত চুয়ান্ন হাত উচ্চতার একটি বিষ্ণু স্তম্ভ। এই স্তম্ভের উপরে একটি গরুড়ের (সনাতনী গ্রন্থ মতে বিষ্ণুর বাহন) প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছিল।

৪. ৩৬০০ কেজি ওজনের রুপার তৈরী একটি হাস্যরত কৃষ্ণ প্রতিমা। 

৫. ৯৭৯ কেজি ওজনের স্বর্ণের নির্মিত একটি কেশব প্রতিমা।

৬. চমৎকার ও বৃহৎ একটি সূর্য মন্দির যেটা বর্তমানে মার্তণ্ড মন্দির নামে বিখ্যাত।

উল্লেখ্য, বিস্ময়কর এসব প্রতিমা/স্থাপত্যগুলো আগ্রাসীদের হিংস্র থাবায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। শুধুমাত্র তাঁর নির্মিত স্থাপত‍্যের শেষ নিদর্শন হিসাবে মার্তন্ড মন্দিরের কিছুটা চিহ্ন আছে। ৭২৫/৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ‍্যে এই মন্দির তৈরী করা হয়েছিল। রণাদিত‍্য নামক এক রাজা মন্দিরের ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন এবং ললিতাদিত্য নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ করেন।

অষ্টম শতাব্দীতে কাশ্মীরে রাজত্ব করা সবচেয়ে শক্তিমান সম্রাট ললিতাদিত্যের নির্মিত এই মার্তন্ড মন্দির সবচেয়ে বিস্ময়কর স্থাপত‍্য। হিমালয়ের পটে আঁকা অত্যন্ত শিল্পসম্মত এই মন্দির উচ্চ ভূমিতে অবস্থিত, যেখান থেকে কাশ্মীরের মূল উপত্যকা দৃশ্যমান। 

ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদার নির্মিত মার্তন্ড মন্দির
ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদার নির্মিত মার্তন্ড মন্দির

 

ঐতিহাসিক কহলনের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী জে ডুগুইড এই মন্দিরের ছবি একটি ছবি এঁকেছিলেন, বর্তমানে এই ছবি ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। কাশ্মীরের কসাই নামে পরিচিত সিকান্দার শাহ মিরি, ললিতাদিত‍্যের নির্মিত শেষ স্থাপত‍্যের এই নিদর্শন মন্দিরটি ধ্বংস করেন। পরিকল্পনা মতো চরম নির্মমতার মাধ্যমে ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদার গৌরবময় ইতিহাস সরিয়ে এবং তাঁর সমস্ত নিদর্শন ধ্বংস করে, ভারতের ভূস্বর্গ খ‍্যাত কাশ্মীর নামের হিন্দু রাজ্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তৈরির সবচেয়ে বড় অবদান সুলতান সিকান্দার মিরি -এর। 

ললিতাদিত্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে এই সিকান্দারের নৃশংস কর্মকাণ্ড চলে আসে, কারণ ললিতাদিত্যের উজ্জ্ব্বলতম সৃষ্টিকে তিনিই ধ্বংস করেছিলেন। প্রথমেই সিকান্দারের আগ্রাসী লোলুপ দৃষ্টি মাত্তন কারেওয়াতে অবস্থিত লালিতাদিত্যর তৈরি মার্তন্ড মন্দিরে পড়ে। হেনরি হার্ডিকোল এর সহায়তায় আর্কিওলাজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার “ইলাস্ট্রেশন অফ এনশিয়েন্ট বিল্ডিংস ইন কাশ্মীর” রিপোর্টে উল্লেখ করা আছে, কাশ্মীরের সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী ও মহান ধ্বংসস্তুপ হলো মার্তন্ড মন্দির, যেটি ইসলামাবাদের তিন কিলোমিটার পূর্বে।

ফার্সি ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ কাসিম হিন্দুশাহ রচিত ‘তারিখ-ই-ফিরিস্তা’ থেকে জানা যায়, মন্দির মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য এক বছর ধরে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু শক্তপোক্ত স্থাপত্য সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিলে, মন্দিরসমূহে আগুন লাগানো হয় যাতে সেগুলি নিষ্ঠুরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

হাসান রচিত তারিখ-ই-হাসানে লিপিবদ্ধ আছে, হিন্দু সম্রাটদের সময় থেকে কাশ্মীরকে অলঙ্কৃত করেছিল বহু মন্দির, যেগুলি পৃথিবীর জন্য বিস্ময়। তাদের কারিগরি ছিল এতো সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর, যে যারাই দেখবে এর সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। গোঁড়ামির শিকার সিকান্দার সেগুলি ধ্বংস করে এবং সেইসব ধ্বংসস্তুপ দিয়ে মসজিদ ও খানকাহ তৈরি হয়।

 তারিখ-ই-ফেরিস্তা প্রবন্ধের দশম খণ্ডে কাশ্মীরের নিয়ে যে মূল্যবান বর্ণনা আছে, সেখানেও এই নির্মম সিকান্দার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে- “অগণিত ব্রাহ্মণ তাঁদের ধর্ম পরিত্যাগ করেছিলেন, অথবা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন এবং অনেকেই ভয়ংকর শাস্তি থেকে বাঁচতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন”।

এবার ২য় রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থের বিষয়ে একটু আলোচনা! এই বিখ্যাত গ্রন্থ ললিতাদি‍ত‍্যের মৃত্যুর অনেক সময় পরে জনরাজ নামের একজন সংস্কৃত কবি ও ঐতিহাসিক কাশ্মীরের ইতিহাস বিষয়ক এই বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। লেখকের বিষয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য তথ‍্য পাওয়া যায় না। জনরাজের অকাল মৃত্যু হওয়ায় কারণে তিনি এই গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করতে পারেন নাই। শ্রীভারা নামক তাঁর এক ছাত্র এই গ্রন্থ রচনার কাজ শেষ করেন এবং তৃতীয় রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ রচনা করেন। 

 ২য় রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ থেকে সিকান্দারের কর্মকাণ্ডের একটু বিবরণ ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে উল্লেখ করা হলো— “এমন কোনো লোকালয় এমন কি জঙ্গলও ছিল না যেখানে সনাতনী দেব দেবীদের মন্দির ধ্বংস করা হয়নি। যখন সুরেশ্বরী, বরাহ সহ সকল দেব দেবীর প্রতিমা ভাঙচুর করা হচ্ছিল, তখন সমগ্র পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল, কিন্তু এই নিষ্ঠুর রাজার মনে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ে নাই। তিনি তাঁর সকল রাজকার্য ভূলে গিয়েছিলেন এবং সারা দিবারাত শুধু বিগ্রহ ধ্বংসের মাধ্যমে আনন্দ খুঁজে পেতেন।”  

আনুমানিক ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে অজ্ঞাত এক রচনাকারের রচিত মধ‍্যযুগের কাশ্মীরের ইতিহাস নিয়ে একটি প্রামাণ‍্য দলিল, “বাহারিস্তান–ই –শাহি”। কাশীনাথ পণ্ডিত নামের একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক এই গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন। খ‍্যাতনামা এই পন্ডিত বারামুলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং পাঞ্জাব ও তেহেরান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন। তিনি কাশ্মীরের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার অফ এশিয়ান স্টাডিস -এর অধ্যাপক এবং নির্দেশক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। ঐতিহাসিক এই অমূল্য ঐতিহাসিক দলিলের বাংলা অনুবাদ থেকে জানা যায়- 

সনাতনী মন্দির, পূজোর স্থান, প্রতিমা ধ্বংসের বিষয়ে সুলতান সিকান্দার অত্যন্ত আসক্ত ছিলেন। তিনি বীজবেহারা নামের একটি এলাকায় বৃহৎ মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। সমস্ত মন্দির, দেবালয় ও আরাধনার স্থান ধ্বংস করে হিন্দু সম্প্রদায়কে বিলুপ্ত করে দেওয়া তাঁর পরিকল্পনা ছিল।

বাঙালি জাতি ইতিহাস বিষয়ে অসচেতন, নিজেদের পূর্ব পুরুষদের প্রাচীন ইতিহাস অনেক কম লিপিবদ্ধ করা। যতটুকু লিপিবদ্ধ করা ছিল, সেগুলো ইতিহাসের পরিবর্তে লৌকিক গল্পতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে নিজেদের দায়িত্বহীনতার কারণে! প্রাচীন ভারতবর্ষের অতীতের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব!

আরবীয়, মুঘলদের শাসনামলে ভারতের বহু প্রাচীন স্থাপত্য, শিক্ষাকেন্দ্র ধ্বংস করা হয়েছে, এজন্য আমাদের প্রকৃত ইতিহাস চিরতরে কালের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে যেটা উদ্ধার করা এখন স্বাভাবিকভাবেই অসম্ভব! ঐতিহাসিক সত্যতার প্রাচীন ভারতের এই গৌরবময় ইতিহাস প্রায় ১৫০০ বছরের পুরোনো! 

তাই প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে- কিছু লৌকিক গ্রন্থ, প্রাচীন সনাতনী গ্রন্থ ও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন স্থাপত্য, শিলালিপির উপর ঐতিহাসিকদের নির্ভর করতে হয়। কিন্তু ইতিহাসের এসব উপাদান থেকে প্রকৃত ইতিহাসের তথ‍্য সংগ্রহ অসম্ভব, এজন্য ইতিহাসবিদগণ এসব উপাদানের সাথে পার্শ্ববর্তী এলাকার লিখিত ইতিহাসের সমন্বয় করে অনেকটা যাচাই/বাঁছাই করে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনা করে।

ধারণা করা হয়, কাশ্মীরের বিখ্যাত ঐতিহাসিক কহলনের রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থের রচনা কাল ১১৪৮-১১৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ‍্যবর্তী সময়ে। ঐতিহাসিক কহলন, বহু পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের পূর্বপুরুষ রচিত ইতিহাসের ঘটনাগুলো সংগ্রহ করে রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থ রচনা করে। আপাতদৃষ্টিতে এই গ্রন্থ কাশ্মীরের রাজাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক দলিল মনে হতে পারে, তবুও এই মূল‍্যবান দলিল থেকে পাওয়া তথ‍্যে  ৭২৩-৮০৬ খ্রিষ্টাব্দের কাশ্মীরের গৌরবময় ইতিহাস বিশ্ববাসীর সামনে উঠে এসেছে।

হাসান নামের একজন মুসলিম ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী- “কাশ্মীরের হিন্দুদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল এবং যে হিন্দুগণ ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করে, তাদের গণহত্যা করা হয়েছিল। সিকান্দারপোরাতে (সিকান্দার নির্মিত একটি শহর) হিন্দুদের মন্দিরের ধ্বংসপ্রাপ্ত পাথর সহ অন‍্যান‍্য ধ্বংসাবশেষ দিয়ে একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়।”

হিন্দু রাজ‍্য কাশ্মীর হিন্দুশূণ‍্য হবার এটাই ছিল সবচেয়ে বড় কারণ! জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর ও স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষাবিদ মোহম্মদ মুজিব -এর বর্ণনায়, “সিকান্দর নামক বিধ্বংসী অত্যাচারী নৃশংস শাসক, জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণকে একটি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক নীতিতে পরিণত করেন।” 

শ্রীরাম বক্সি তাঁর রচিত Kashmir Through Ages এ গ্রন্থে, তিনি সিকান্দার সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন- সিকান্দারের জীবনের লক্ষ ও রাজনৈতিক নীতি ছিল সনাতনী মন্দির ধ্বংস করা এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ করা। কাশ্মীরের সনাতনীদের তখন নিজের ধর্ম রক্ষা করতে কাশ্মীর ছেড়ে পলায়ন করা ছাড়া উপায় ছিলনা। 

প্রিয় পাঠকবৃন্দ এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, হিন্দু রাজ‍্য কাশ্মীর কিভাবে স্বল্পতম সময়ে মুসলিম রাজ‍্যে পরিণত হলো? শুধু কাশ্মীর অথবা এই ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, এই বিশ্বেই এমন বহু উদাহরণ আছে- যে হাতগুলো এখন উগ্রবাদ/নৃশংস কর্মকাণ্ড করছে, এক সময় তাদের পূর্ব পুরুষদের সেই হাতদুটো পৈতা ধারণ করে কুল দেবতার উদ্দেশ্যে জল ফল প্রদান করতো! 

 শিক্ষা ও সচেতনতার গুণে মোহম্মদ মুজিব, তারেক ফতেহ, হাসানের মতো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমানগণ এই উপমহাদেশের সম্পদ। তাঁদের বিশ্বাস ধর্মান্ধতা নয়, শিক্ষা এবং সচেতনতায় যদিও এদের সংখ্যা অতি নগণ‍্য! তারপরও মুজিবের মতো বিশেষ ব‍্যাক্তিদের মতামত এই মহাদেশের ইতিহাসে গুরুত্ব পায় নি। বিকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পুরণ করার জন‍্য দেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকেই যদি ধ্বংস করা হয়, তাহলে সেই জাতি কখনও সমৃদ্ধ ও উজ্জল ভবিষ্যৎ গঠন করতে পারে না।

ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা
ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা

 

ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদার শেষ জীবন

সামরিক অভিযানে যাওয়ার বহুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও কাশ্মীরে ললিতাদিত্যের মন্ত্রীগণ যখন ললিতাদিত্যের সম্পর্কে কোনো সংবাদ পেলেন না, তখন তারা তাদের সম্রাটকে খুঁজে বের করতে একজন বার্তাবাহককে প্রেরণ করে। 

তাঁদের প্রেরিত এই বার্তাবাহক ফিরে এসে বলে, আমাদের মহারাজ কাশ্মীরে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সামরিক দিকে আরও বিজয় অর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেইসাথে উত্তরসূরী হিসাবে তাঁর বড় পুত্র কুওয়ালা পিডাকে নিযুক্ত করতে বলেছেন এবং রাজ‍্য পরিচালনার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন।

পরবর্তীতে সামন্ত গণ ফিরে এসে জানায়, অনার্য দেশে প্রবল তুষারপাতের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।  তাঁরা আরও জানায়, ভয়ানক পরিস্থিতিতেও তিনি নিজেকে স্থির রেখেছিলেন, কোনো কিছুই তাঁকে বিচলিত করতে পারেনি। তিনি একজন মহান রাজা থাকাকালীন সম্মানের সঙ্গে একজন রাজার মত মৃত্যুবরণ করতে চেয়েছিলেন।

প্রকতপক্ষে ললিতাদিত্যের সাম্রাজ্য মুঘল শাসকদের সাম্রাজ্য থেকেও অনেক বৃহৎ ছিল। তবুও তিনি কখনই জয় কৃত এলাকাগুলোয় লুটপাট করেননি, অথবা তিনি সেই রাজ‍্যের শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জাতিসত্তাকে ধ্বংস করে জোর করে সনাতনী রীতি প্রয়োগ করেননি।

 ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার গৌরবময় বীরত্বগাঁথা ইতিহাস পৃথিবীতে প্রমাণ করেছে- কাশ্মীর ঋষি কাশ্যপের ভূমি, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য এবং স্থাপত্যের অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ছাড়াও ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। নিশ্চয়ই ললিতাদিত্যের এই গৌরবময় ইতিহাস সনাতনীদের মধ‍্যে বীরত্ব বোধ জাগ্রত করবে। সর্বদিক থেকে শোষণের কারণে বর্তমান সনাতনীদের উচিত ললিতাদিত্যের মতো  পরাক্রমশালী পূর্বপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার মাধ্যমে গৌরবময় এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গঠন করা।

One thought on “ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত‍্য মুক্তিপিদা | কাশ্মীরের ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *