আলোচিত সংবাদইতিহাসসনাতন ধর্ম

সেন বংশের শেষ শাসক রাজা লক্ষ্মণ সেন এর শাসন আমল ও ইতিহাস

Spread the love
সেন বংশের শেষ শাসক রাজা লক্ষ্মণ সেন এর শাসন আমল ও ইতিহাস
সেন বংশের শেষ শাসক রাজা লক্ষ্মণ সেন এর শাসন আমল ও ইতিহাস
রাজা লক্ষ্মণ সেন

সেন বংশের শেষ শাসক রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসন আমল ও ইতিহাস 

অবরিরাজ মদনশঙ্কর নরসিংহ গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণ সেন ছিলেন দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতকে বাংলার সেন রাজবংশের পঞ্চম এবং সর্বশেষ হিন্দু রাজা।

তিনি ১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজ‍্য শাসন করেছেন।

 

লক্ষ্মণ সেনের পরিচয় :

বাংলার ইতিহাসে লক্ষ্মণ সেন এক গুরুত্বপূর্ন স্থান অধিকার করে রয়েছেন।
তাঁর পূর্বসূরী ছিল, তাঁর পিতা গৌড়েশ্বর বল্লাল সেন।

হলায়ূধ মিশ্র ছিল বল্লাল সেনের মন্ত্রী। সম্রাট লক্ষ্মণ সেন তাঁর সাম্রাজ্যকে কামরূপ (বর্তমানে আসাম), কলিঙ্গ (বর্তমান উড়িষ্যা), কাশী, প্রয়াগরাজ এবং দিল্লী পর্যন্ত বর্ধিত করেছিল।

পিতা বল্লালসেন আনুমানিক ১১৭৮ খ্রিঃ মৃত্যুর পর লক্ষণ সেন সিংহাসন আরোহণ করেন।

লক্ষ্মণ সেনের মাতা ছিলেন চালুক্য বংশের রাজকন্যা রমাদেবী। যখন সিংহাসন আরোহণ করেন তখন লক্ষ্মণ সেনের বয়স ৬০ বছর।

লক্ষ্মণ সেন সম্পর্কে জানার জন্য উৎসের অভাব নেই,
কিন্তু একজন রাজপুত হওয়া সত্ত্বেও বাল্যকাল সম্পর্কে জানতে ঐতিহাসিক সূত্রের অভাব আছে।

ধারণা করা যায় যে, একজন রাজপুত্র হওয়ার কারণে তিনি অনেকটা আরাম আয়েশে জীবনযাবপন করেছেন। সময়কালে তিনি উন্নত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।

লক্ষ্মণ সেনের বাল‍্যকাল সম্পর্কে যেটুকু তথ্য জানা যায় তা থেকে ধারণা হয় যে, তিনি পিতা ও পিতামহের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন

লক্ষ্মণ সেন সম্পর্কে জানার উৎস সমূহ :

(১) লক্ষ্মণ সেনের তর্পনদিঘি তাম্রশাসন

(২)লক্ষ্মণ সেনের গোবিন্দপুর তাম্রশাসন

(৩)লক্ষ্মণ সেনের আনুলিয়া তাম্রশাসন

(৪) লক্ষ্মণ সেনের সুন্দরবন তাম্রশাসন

(৫) লক্ষ্মণ সেনের ঢাকা তাম্রশাসন

(৬) লক্ষ্মণ সেনের শক্তিপুর তাম্রশাসন

(৭)লক্ষ্মণ সেনের ভাওয়াল তাম্রশাসন

(৮) লক্ষ্মণ সেনের মাধাইনগর তাম্রশাসন

(৯) ড: নীহাররঞ্জন রায় রচিত ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’

সেন বংশের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লক্ষণ সেন পিতা ও পিতামহের রাজত্বকালে গৌড় অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন এবং কামরূম ও কলিঙ্গ রাজ্য জয় করেছিলেন।

সেন বংশের (লাখনাবতীর) শেষ রাজা হিসেবে রাজা লক্ষ্মণ সেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুপরিচিত ও গুরুত্বপূর্ন।

তার সময সেন রাজ্য উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করেছিলো। আবার তিনি ক্ষমতায় থাকতেই সাম্রাজ্যের পতন হতে থাকে।

লক্ষ্মণ সেনের শাসনামলে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার  রাজ‍্য দখল করেন
এবং লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য বিক্রমপুরের মধ‍্যে সীমিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সেনবংশের পতন হয়।

সিংহাসন আরোহণের পূর্বে রাজা লক্ষ্মণ
সেন:

একসময় লক্ষ্মণ সেনের সঙ্গে তার পিতা বল্লালসেনের মধ‍্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়।

কথিত রয়েছে যে, লক্ষ্মণ সেনের পিতা বল্লালসেন এক নিম্নবর্ণের বা নিচ বংশজাত মহিলার রুপে গুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে পত্মী হিসেবে গ্রহণ করেন।

হিন্দুদের উপর ঘটে যাওয়া দাঙ্গার ইতিহাস!

লক্ষণ সেন পিতার এমন আচরনকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেন নি।
লক্ষ্মণ সেন এর তীব্র প্রতিবাদ করলে বল্লালসেন পুত্রের প্রতি ভীষণ অসন্তুষ্ট হন
এবং তার উক্ত পত্নীর প্ররোচনায় লক্ষণ সেনকে পূর্ববঙ্গে নির্বাসন করেন।

অবশ্য এ অবস্থা দীর্ঘদিন বিরাজিত ছিল না। অচিরেই রাজা বল্লালসেন পুত্রের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেন।

 

কথিত আছে যে, পিতাপুত্রের এ মিলনে লক্ষ্মণ সেনের স্ত্রী তান্দ্রাদেবীর (মতান্তরে তারাদেবী) অবদান রয়েছে।

লক্ষ্মণ সেন তারাদেবী নামক এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন বলে জানা যায়। তারাদেবীর গর্ভজাত তিনটি পুত্র সন্তান ছিল।

তারা হলেন, কেশবসেন, মাধব সেন এবং বিশ্বরূপসেন। পরবর্তীতে পিতার মৃত্যর পর তারা পূর্ববঙ্গের সিংহাসন আরোহণ করেছিলেন।

বখতিয়ার খলজীর সাথে লক্ষ্মণ সেনের প্রথম যুদ্ধ :

20221116 195816
বখতিয়ার খলজী

 

১১৯২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মহম্মদ ঘুরি, পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করে দিল্লি ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

তারপর দিল্লির সুলতানি সেনা পূর্বের দিকে গহড়বাল রাজা জয়চন্দ্রকে পরাজিত করে কনৌজ দখল করে।

১২০১ সালে দিল্লি সালতানাতের সিপাহশালার সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী মগধ আক্রমণ করে ব্যাপক লুঠপাঠ চালায়।

মগধ দখল করে বখতিয়ার তৎকালীন সময়ের বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে ও অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুককে হত্যা করে।

লাহোর থেকে বিহার পর্যন্ত উত্তর ভারতের মধ‍্যে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার ফলে,
সমগ্র ভারতবর্ষে কেবলমাত্র বাংলা / বঙ্গভূমি একটি স্বতন্ত্র হিন্দু সাম্রাজ্য হিসাবে সনাতন ধর্মের বিজয়ধ্বজ ধারণ করে রাখে।

আপনার পছন্দ হতে পারে…

ভারতের ইতিহাসে কুখ‍্যাত তৈমুর!

মুঘলদের কট্টর শত্রু বাপ্পা রাওয়াল!

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্য!

প্রথম অস্ত্রাপ্রচারের জনক মহর্ষি সুশ্রত!

ঐতিহাসিক সুত্রে জানা যায়, পিতা ও পিতামহের সঙ্গে বাংলায় এসময় শাসনকার্য পরিচালনা করতেন হিন্দু কুলসূর্য পরমনৃসিংহ গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণ সেন

কথিত আছে, মহারাজ লক্ষ্মণসেন ছিলেন শ্রী বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার নৃসিংহদেবের পরমবৈষ্ণব উপাসক।

যৌবনকালে তিনি পুরী, কাশী ও প্রয়াগ ক্ষেত্র জয় করে সেখানে বিজয়ধ্বজ স্থাপন করেছিলেন।

পূর্ব ভারতের স্বতন্ত্র হিন্দু রাজ্য হিসেবে বাংলাভূমি, দিল্লি সালতানাতের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

যদিও দিল্লির সুলতানের পক্ষে সরাসরি বাংলা আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না,
কারণ বাংলার সামরিক শক্তি, বিশেষত বিধ্বংসী নৌবাহিনী ও হস্তীবাহিনীর সাথে যুদ্ধে এলে দিল্লির সেনাবাহিনী অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে যেত।

এই অবস্থায় ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে রাজমহলের জঙ্গলময় এলাকা দিয়ে বখতিয়ার খিলজী প্রায় ১৮০০০ তুর্কি সেনাবাহিনী নিয়ে বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্রে একটি অসফল আক্রমণ চালান।

তখন, লক্ষ্মণ সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও বাংলার যুবরাজ হেমচন্দ্র মাধবসেন খিলজীদের প্রতিরোধ করেন।

নবদ্বীপে তখন পর্যাপ্ত সৈন্য না থাকায় গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেন শঙ্খহট্টে গমন করেন
এবং বিশাল কৈবর্ত্য নৌসেনা ও হস্তীবাহিনী নিয়ে ফিরে এসে বখতিয়ার খিলজীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করেন।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড: নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থের আদিপর্বে সম্রাট লক্ষ্মণ সেন
ও বখতিয়ার খিলজীর মধ‍্যে সম্মুখ যুদ্ধ এবং ঐ যুদ্ধে সম্রাট লক্ষ্মণ সেন কর্তৃক বখতিয়ার খিলজীর শোচনীয় পরাজয়ের সত্যতা সম্পর্কে প্রাথমিক উৎস সহ প্রমাণ করেছেন।

এই যুদ্ধে ৮০ বর্ষীয় বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন বড় একটা হাতির পিঠে আরোহণ করে ধনুর্বানে খিলজীদের প্রতিহত করেন।

ঐ যুদ্ধে লক্ষ্মণসেন বখতিয়ারকে তীর দিয়ে আগাত করেন যেটা বখতিয়ারের হাতে আঘাত করায় সে অস্ত্র হারিয়ে ফেলে ও ‘হাতিয়ার হাতিয়ার’ আর্তনাদ করতে থাকে।

রাঢ়ভূমের প্রদ্যুম্নেরশ্বর মন্দির থেকে পাওয়া শিলালিপিতে সেন সভাকবি উমাপতিধর এর ‘ব্যজস্তুতি’ অলঙ্কারপ্রযুক্ত শ্লোক থেকে জানা যায় –

“সাধু ম্লেচ্ছনরেন্দ্র সাধু ভবতো মাতৈব বীরপ্রসূর্-
নীচেনাপি ভবদ্বিধেন বসুধা সুক্ষত্রিয়া বর্ততে
দেবো কূট্যতি বস্য বৈরিপরিযম্মারাঙ্কমল্লে পুরঃ
শস্ত্র শস্ত্রমিতি স্ফুরতি রসনাপত্রান্তরালে গিরঃ।।”

মূলত, এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েই ভয়ার্ত হয়ে বখতিয়ার বিহারে পালিয়ে আসেন।

 

লক্ষণ সেনের রাজসভার সভাকবি গণ :

লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় ৫ জন সভাকবি বা গুণী পন্ডিত ছিল।

(১)উমাপতিধর

(২)শরণ

(৩)ধোয়ী

(৪)গোবর্ধন

(৫)জয়দেব

এই ৫ জন সভাকবি সর্বদা লক্ষ্মণ সেনের রাজসভা অলংকৃত করে রাখতেন। এদেরকেই লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় “পঞ্চরত্ন” বলা হয়ে থাকে।

রাজা লক্ষ্মণ সেনের সিংহাসন আরোহণ:

অনুমানিক ১১৭৮ খ্রিঃ লক্ষ্মণ সেন ৬০ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন।
বল্লালসেন শেষ জীবনে বান প্রস্থ আশ্রম অবলম্বণ করতে যাওয়ার সময়,
তিনি লক্ষ্মণ সেনকে সিংহাসন অর্পণ করে দিয়ে যান।

রাজা বল্লাল সেন ও রানী রমাদেবী এই বিখ্যাত পুত্র লক্ষ্মণ সেন উপাধী ধারণ করেছিলেন “অবরিরাজ মদন শংকর ” নামে।

লক্ষ্মসেনের ধর্মীয় উপাধী ছিল – ”পরম বৈঞ্চব” এবং নরসিংহ। পিতা বল্লাল সেনের মতো লক্ষ্মণ সেন গৌড়েশ্বর উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য অভিষেকের সময় হতে একটি নতুন সাল গণণা শুরু হয়। এটি ছিল লক্ষ্মণাব্দ। বখতিয়ার খলজির নেতৃত্বে মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের পরে ও এই সাল গনণা অব্যাহত ছিল।

এখনও মিথিলায় এই সাল গণনা করা হয়ে থাকে। লক্ষ্মণ সেনের আমলে বাংলা মুসলমানদের আমলে বাংলায় মুসলমানদের আগমনের কারণে তিনি প্রকটভাবে উচ্চারিত একজন শাসক।

লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য জয় :

(১) গৌড় রাজ্য জয় :

গৌড় রাজ্য জয়ের পরে
লক্ষ্মণ সেন গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করেছিলেন।
লক্ষ্মণ সেনের ভাওয়াল ও মাধাইনগর লিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি গৌড় রাজ্য জয় করেছিলেন।

গৌড় রাজ্য জয়ের সময় গৌড়ের রাজা দ্রুত পলায়নে বাধ্য হন। যতদূর ধারণা করা যায় তিনি তার পিতামহ বিজয় সেনের শাসনামলে গৌড়রাজ্য জয় করেছিলেন।

এ কারণে লক্ষণ সেনের নামনুসারে গৌড়ের রাজধানীর নাম লখনাবতী রাখা হয়েছিল।

২)কামরূপ রাজ্য জয় :

কামরূপ রাজ্য জয় করেছিলেন লক্ষ্মণ সেনের আমলে না তার পিতামহ বিজয় সেন এর আমলে এই নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

কামরুপ রাজ্যর রাজা ভীত হয়ে লক্ষ্মণ সেনের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন। ধারণা করা যায় যে,
বিজয়সেন কামরুপ রাজাকে বিতাড়িত করলে ও বিজয় সফলতা সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারেন নি।

পরবর্তীতে রাজা লক্ষ্মণ সেন কামরূপ রাজ্য সম্পূর্ণভাবে বিজয় সম্পন্ন করেন।

(৩)কলিঙ্গ রাজ্য জয় :

লক্ষ্মণ সেনের ভাওয়াল ও বাধাইনগর লিপি থেকে যানা যায়, লক্ষ্মণ সেন যৌবনে কলিঙ্গ দেশ অভিযান পরিচালনা করেন।

 

অর্থাৎ লক্ষণ সেন পিতামহ বিজয় সেনের সঙ্গে কলিঙ্গ অভিযানে অংশগ্রহণ করে সফল হন।
পরবর্তীতে কলিঙ্গ দেশ সেন বংশের অধীনে কতদিন ছিল, সে সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যায় না।

(৪)গাহড়বাল রাজ্য জয় :

বিজয় সেন ইতিপূর্বে নৌ অভিযানের মাধ্যমে গাহড়বাল অভিযান করেছিলেন।
সেন শাসনামলে গাহড়বাল রাজাদের সঙ্গে সেনদের সম্পর্ক ভালো ছিল না এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল।

লক্ষ্মণ সেন গাহড়বাল রাজা জয়চন্দ্রকে পরাজিত করে রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।

(৫)ম্লেচ্ছ রাজার পরাজয় :

লক্ষণ সেনের সভাকবি শরণ ও উমাপতিধর রচিত শ্লোক থেকে বলা হয়, ম্লেচ্ছ রাজাকে লক্ষ্মণ সেন পরাজিত করেছিলেন।

ড.নীহারঞ্জন রায় অনুমান করেন যে, বখতিয়র খলজি কর্তৃক নদীয়া জয়ের পূর্বে লক্ষ্মণ সেন ম্লেচ্ছ রাজার বিরেুদ্ধে জয়লাভ করেছিলো।

কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ম্লেচ্ছ বলতে,
আরাকানী মগধেরকে বুঝায় তাদের ধারণা মগধরা হয়ত বাংলায় আগমন করেছিলে এবং লক্ষ্মণ সেন তাদেরকে পরাজিত করেন।

বখতিয়ার খলজীর আক্রমণ :

20221116 195401
বখতিয়ার ও তার ১৮ জনের সেনাদল

লক্ষ্মণ সেনের শেষ জীবন সুখের হয়নি! উত্তর ভারতের রাজ্যগুলো একে একে তুর্কিদের হাতে দখল হতে থাকে।
ক্রমে তুর্কিরা বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে।

ইসলামি আগ্রাসনে নারী দাসীদের ইতিহাস

১২০৪ খ্রিঃ বখতিয়ার খলজী ( দিল্লী সালতানাতের তুর্কী সেনা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী) লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করেন।

 

বৃদ্ধ লক্ষ্মন সেন তখন নদীয়ায় অবস্থান করেছিল। বখতিয়ার খলজী অনেক কুটিল বুদ্ধির সৈনিক ছিলেন।

বাংলায় অভিযানের পূর্বেই  তিনি বাংলার আভ্যন্তরীণ অবস্থা, বাংলার রক্ষাব্যবস্থা, বাংলায় প্রবেশের বিভিন্ন পথ সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন।

তিনি বাংলার প্রবেশের সহজ পথ বর্জন করে দুর্গম পাহাড়ের পথ দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন।
অর্থাৎ অরণ‍্য অঞ্চল গয়া ও ঝাড়খন্ডের মধ্যে দিয়ে নদীয়া এসে পৌছান।

তবাকাত -ই- নাসিরী গ্রন্থে বর্ণনা থেকে জানা যায়,
বখতিয়র খলজী আরব অশ্ব বিক্রেতার ছদ্মবেশে মাত্র ১৮ জন অশ্বরোহী নিয়ে লক্ষ্মণ সেনের প্রাসাদের সামনে বিনা বাধায় উপস্থিত হয়ে প্রাসাদরক্ষীদের হত্যা করা শুরু করেন।

তখন শহরে শোরগোল শুরু হয়ে যায়। এই সময় ছিল দুপুর, সৈন্য / সামন্তরা কেউ কেউ দুপুরের খাবার খাওয়া কিংবা খাবারের পরের আলস্যতায় মগ্ন ও অসচেতন ছিল।

রাজা লক্ষ্মণ সেন ও এসময় মধ্যাহ্নভোজনে বসেছিলেন।
এই সময় প্রাসাদ এ শোরগোল ও উচ্চকন্ঠে আর্তনাদ শুনে রাজা লক্ষণ সেন ভীত হয়ে পড়েন।

এক্ষেত্রে জ্যেতিষী পন্ডিদের ভবিষ্যদ্বানী ও তুর্কি জাতি কর্তৃক বঙ্গ অভিযানের কথা তার স্মৃতিতে ছিল বিধায়,
রাজা কাল বিলম্ব না করে অন্য কোন উপায়ের চিন্তা না করে প্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে পলায়ন করেন
এবং নৌকাযোগে পুর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

এর ফলে রাজা লক্ষ্মণ সেনের বিপুল ধনসম্পদ ও বহুসংখ্যক হাতি বখতিয়ার খলজীর হস্তগত হয়।
অতএব বখতিয়ার খলজীর পক্ষে বাংলা অভিযানে আর বাধা রইল না।

গ্রান্ড ট‍্যাঙ্ক রোডের সত‍্যতা!

ইতিমধ্যেই বখতিয়ার খলজীর পেছনে থাকা সৈন্য বাহিনী তার সাথে যোগ দিয়েছে।

20221116 231736
বখতিয়ারের বাংলা দখল

এই ভাবে নদীয় বিজয় সম্পন্ন হয়। উত্তর ও পশ্চিম বাংলা বখতিয়ার সহজেই অধিকার করে নেন এবং লক্ষ্মণাবতীকে কেন্দ্র করে বংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

লক্ষ্মণ সেনের  সাহিত্যনুরাগ :

লক্ষ্মণ সেন শাস্ত্রচর্চায় পিতার উপযুক্ত পুত্র ছিল। সাহিত্যেকর্মে তিনি অনেক উৎসাহী ছিলেন।

তাঁর পিতা বল্লাল সেন রচিত ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ গ্রন্থের অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করেন।

সম্রাট লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় প্রখ্যাত ধর্মনিষ্ঠ বৌদ্ধ শ্রমণ পুরুষোত্তম রচনা করেন বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ ‘লঘু বৃত্তি’ বা ‘ভাষা বৃত্তি’।

গোবর্ধন “আর্য সপ্তদর্শী” জয়দেব “গীতগোবিন্দ” এবং ধোয়ী পবনদূত রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন।

তাঁর রাজসভায় নারায়ণ দত্ত রচনা করেন ‘ত্রিকাণ্ড শেষ’ নামক গৌড়ীয় ভাষার অভিধান। লক্ষ্মণ সেন একজন কবি ও সুপন্ডিত ছিলেন।

তার রচিত কয়েকটি শ্লোক পাওয়া গেছে। তার রাজ সভায় বহু পন্ডিত ও জ্ঞানীজনের সমাবেশ ঘটেছিল।

 

লক্ষ্মণ সেন পিতা ও পিতামহের মতো বাংলার সেন বংশের গৌরবময় শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলার সর্বশেষ হিন্দু রাজা।

তিনি ছিলেন সেন বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। তার সময়ের মুসলিম সেনাপতি বখতিয়ার খলজী বাংলা দখল করে বাংলায় মুসলিম শাসন সূচনা করেন।

১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট লক্ষণ সেনের মৃত্যুর পর তাঁর তিন পুত্র বাংলার তিন অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করে।

বরেন্দ্রভূম অঞ্চলে, মহারাজাধিরাজ মাধব সেন – রাজধানী গৌড়।

রাঢ়ভূম অঞ্চলে, মহারাজাধিরাজ কেশব সেন – রাজধানী রাজনগর।

বঙ্গভূম অঞ্চলে, মহারাজাধিরাজ বিশ্বরূপ সেন – রাজধানী বিক্রমপুর ।

সেনবংশ ও তার পরবর্তী দেববংশ এরপর প্রায় ৩০০ বছর ধরে বাংলায় হিন্দু স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে এবং
দিল্লি সালতানাতের বাহিনীকে একাধিক যুদ্ধে পরাজিত করে বারবার সনাতনী ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করেন।

লক্ষ্মণ সেনের কনিষ্ঠ পুত্র বিশ্বরূপ সেন ১২১২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিসকে পরাজিত করে
বারাণসী বিজয় করে শিবমন্দির পুনরুদ্ধার করেন এবং বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন।

তারপর কাশীকে শিবের পবিত্র স্থান হিসেবে ঘোষণা করেন।
১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন সেন আওয়াধের নবাব শের খানকে পরাজিত করে মগধ পুনরুদ্ধার করেন এবং
বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক ধ্বংস হওয়া নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুদ্ধগয়া পুনর্নির্মাণ করেন।

অবরিরাজ মদনশঙ্কর নরসিংহ গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণ সেন নামে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে আজও বাংলার সর্বশেষ হিন্দু রাজা হিসাবে উজ্জ্বল হয়ে আছেন!