রাজা মিহির ভোজ যিনি প্রতিহার বংশের কনৌজের শ্রেষ্ঠ রাজা, একজন মহান ব্যাক্তি, তেজস্বী, গুণী ও পরাক্রমী ছিলেন; কিন্তু ঠিক ততটাই উপেক্ষিত হয়েছেন আমাদের ইতিহাস বিস্মৃত হবার কারণে!
তৎকালীন ভারতবর্ষে বহু কিংবদন্তী, রাজা ও সম্রাট ছিল।
ঠিক এই রকম একজন মহান রাজা ছিলেন মিহির ভোজ, যাঁর স্থান ভারতবর্ষের আলোকিতময় ইতিহাসের পৃষ্ঠায়!
ইতিহাসবিদদের মতে, কমপক্ষে ২০ বার সিন্ধু অঞ্চলে আরব বাহিনীর সঙ্গে রাজা মিহির ভোজের যুদ্ধ হয়েছিল এবং প্রতিবারই আরবীয়দের চরমভাবে পরাজিত করেছিলেন রাজা মিহির ভোজ।
গান্ধীজীর মতাদর্শ ও কংগ্রেস পালিত বাম ইতিহাসবিদদের কারণে এবং ইংরেজদের অপশাসনের ফলে বর্তমানে ভারতের ইতিহাস গ্রন্থে রাজা মিহির ভোজের নাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
রাজা মিহির ভোজের জন্ম ও সিংহাসন লাভ
প্রায় ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে মিহির ভোজ জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম ভোজ নামেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন রামভদ্র এবং মাতার নাম আপা দেবী।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি রাজা হয়েছিলেন ও রাজা মিহির ভোজ নামে পরিচিত ছিলেন। চন্দ্রভট্টারিকা দেবী রাজা মিহির ভোজের স্ত্রী ছিলেন।
রাজা মিহির ভোজ প্রবর্তিত রুপা ও তামার মুদ্রায় দেখা যায়, তিনি “শ্রীমদাদিবরাহ” (মতান্তরে “আদিভারহ”) উপাধি পেয়েছিলেন।
এই “আদিভারহ” উপাধির বিষয়ে গোয়ালিয়র শিলালিপিতে বর্ণনা করা আছে।
ইতিহাসবিদদের মত, রাজা মিহির ভোজের “প্রভাস” নামক আরেকটি উপাধি ছিল।
তিনি তাঁর শাসনামলে আরবীয়দের আক্রমণ থেকে ভারতবর্ষকে বহুবার রক্ষা করেছিলেন।
প্রতিহার বংশের প্রতিষ্ঠাতা
রাজা হরিচন্দ্র প্রতিহার বংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তাঁর শাসনামলে বিজ্ঞ পন্ডিত/ইতিহাসবিদ না থাকায় এবং ভারতের ভূমি ও ঐতিহ্য বিদেশী লুটেরাদের আগ্রাসী আক্রমণে বহুবার আক্রান্ত হওয়ার কারণে এই রাজাদের সম্পর্কে খুব সামান্য তথ্যই পাওয়া যায়।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ইতিহাসবিদদের বর্ণনা, ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পরবর্তীতে উত্তর ভারতে সর্বশেষ কেন্দ্রীয় শক্তির পতন হয়।
এরপর যেসব আঞ্চলিক শক্তিগুলোর উৎপত্তি হয়েছিল, তাদের মধ্যে বাংলার পাল বংশ ও প্রতিহার বংশ ইতিহাসে বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল।
প্রতিহার বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক মিহির ভোজ
প্রতিহার বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন রাজা মিহির ভোজ।
তাঁর শাসনামলে প্রতিহার বংশের রাজশক্তি তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল।
তিনি প্রতিহার রাজবংশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছিলেন। তিনি প্রতিহার বংশের গৌরব অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
তাঁর শাসনামলের ৪৯ বছরকে প্রতিহার বংশের স্বর্ণযুগ হিসাবে বলা হয়।
বহুবার আরবীয় আক্রমণ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশকে রক্ষা করা প্রতিহার রাজবংশের সবচেয়ে শক্তিশালী এই রাজা মিহির ভোজ,
যার শাসনামলে প্রতিহার রাজবংশ সর্বদিকে বিজয় অর্জন করেছিল।
সিংহাসনে বসেই রাজা মিহির ভোজ প্রথমে প্রতিহার বংশের শক্তি বৃদ্ধি করেন। তাঁর ক্ষমতা আহোরণের পূর্বে বুন্দেলখণ্ড ও রাজপুতানায় প্রতিহার বংশের শক্তির দুর্বলতা হয়েছিল,
পরবর্তীতে তিনি এই দুর্বলতা দূর করেন। পৈতৃক রাজ্যে পুনরায় অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
বৎসরাজ, নাগভট্ট ও দ্বিতীয় নাগভট্টের শাসনামলে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাওয়া এলাকা, উদ্ধার করে প্রকৃত মালিককে দান করেন।
মোটকথা, রাজা মিহির ভোজ তাঁর পৈত্রিক রাজ্যের ওপর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিহার বংশের শক্তি বৃদ্ধি করেন।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ বলেছেন,
“রাজা ভোজ চল্লিশ বছর ধরে মহিমান্বিত হয়েছিলেন।
গজনির মোহাম্মদের বাহিনী এবং অন্যান্য আরবীয় মুসলিম বাহিনীদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ, তাঁর অসাধারণ রণকৌশল ও দক্ষতা বিশেষ পারদর্শিতার প্রকাশ।”
তবে, ভিনসেন্ট এই কথা রাজা মিহির ভোজ নাকি রাজা ভোজকে উল্লেখ করেছেন, সেটা অস্পষ্ট।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্মিথ রাজা মিহির ভোজ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন,
“ভোজের এত চমৎকার শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য লিপিবদ্ধ করার জন্য মেগাস্থিনিস অথবা বাণভট্টের মত কাউকেই তখন পাওয়া যায়নি,
ভারতীয় ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য।”
প্রতিহার বংশের শেষ রাজা
রাজা হরিচন্দ্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রতিহার বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন রাজা মিহির ভোজ, যিনি প্রথম ভোজ নামেও পরিচিত ছিলেন।
ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বে সবচেয়ে বড় সফলতা তিনি অর্জন করেছিলেন।
রাজা মিহির ভোজ প্রতিহার বংশের একমাত্র রাজা, যিনি তাঁর রাজ্যের রাজধানী কনৌজে স্থাপন করেছিলেন। আর এই প্রতিহার বংশের শেষ রাজা ছিলেন রাজ্যপাল।
কনৌজের রাজা মিহির ভোজ
কনৌজের সর্বশ্রেষ্ঠ মহান রাজা ছিলেন মিহির ভোজ। তবে তাঁর বংশ পরিচয় নিয়ে ইতিহাসে প্রকৃত তথ্য পাওয়া দুষ্কর! কয়েকটি সম্প্রদায়ের দাবি, রাজা মিহির ভোজ তাদের বংশের।
দাবিকৃত এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রধান সম্প্রদায় দুইটি রাজপুত এবং গুর্জ্জর। বেশিরভাগ পন্ডিতের মতে, প্রতিহার বংশের ছিলেন তিনি।
কিছু বিশ্লেষকের মতে, ছত্রিয় রাজবংশ- সূর্যবংশী, চন্দ্রবংশী, অগ্নিবংশী, ঋষিবংশী, নাগবংশী, ভৌমবংশী সহ বেশকিছু বংশে বিভক্ত। যতটুকু জানা যায়, গুর্জর সম্প্রদায় সূর্যবংশী ছিল।
বর্তমান ভারতের গুর্জর, জাট, প্যাটেল, পতিদার, মীনা, রাজপুত, চৌহান, প্রতিহার, সোলাঙ্কি, পাল, চান্দেল, মারাঠা, চালুক্য, তোমর… এরা সবাই ছত্রিয় রাজবংশের অন্তর্গত।
অসাধারণ রণদক্ষতা ও প্রবল বিক্রমের জন্য রাজা মিহির ভোজ ইতিহাসে বিশেষ স্থান পেয়েছেন।
রাজা মিহির ভোজের শাসনামলে রাজ্যের অবস্থা
রাজা মিহির ভোজের শাসনামলে রাজ্যের অবস্থা অত্যন্ত ভালো ছিল। তাঁর রাজ্যে সোনা, রূপার শিল্প যথেষ্ট প্রসিদ্ধ ছিল। তাঁর রাজ্যে ধূলিকণার মত রূপা বিনিময় করা হতো বলে জানা যায়।
ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ সমৃদ্ধশালী হয়েছিল তাঁর রাজ্য। দস্যু, চোর, ডাকাতের ভয় ছিল না।
অপরাধের মাত্রা প্রায় ০% থাকার ফলে, জনসাধারণ শান্তিতে বসবাস করত।
রাজা মিহির ভোজের ধর্মীয় পরিচয়
সনাতন ধর্মের এই রাজা মিহির ভোজ শিবের ভক্ত ছিলেন। তিনি উজ্জয়নের মহাকালের আরাধনা করতো।
অনেকের মতে, তিনি বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন। কিছু গ্রন্থে পাওয়া যায়, তিনি দুর্গাদেবীর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন।
তবে এই মত দুইটি প্রশ্নবিদ্ধ! কারণ তাঁর সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্রে দেওয়া রণধ্বনি, শিবের ভক্তের পরিচয় প্রদান করে।
রাজা মিহির ভোজকে ইসলামের কট্টর শত্রু বলেন অনেকেই, কিন্তু এই উপাধি পরাজিত হওয়া আরবীয়গণ দিয়েছিল।
প্রকতপক্ষে তিনি বিদেশী আক্রমণকারী দের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসাবে গণ্য করতেন। এখানে তাঁর মাতৃভূমির প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তি প্রকাশ পেয়েছে।
কনৌজ যুদ্ধ
রাজা মিহির ভোজ তাঁর রাজ্যসীমা বিস্তারের জন্য পূর্বদিকে গাঙ্গেয় উপত্যকার দিকে নজর দেন।
এরপরে কালাঞ্জর, দক্ষিণ রাজপুতানায় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে কনৌজে আধিপত্য স্থাপন করেন।
তখন পাল রাজা দেবপাল বাঁধা দিলে, গুর্জর-প্রতিহার রাজ্যের সন্মিলিত রাজা মিহির ভোজের এই সেনাবাহিনী দক্ষিণ দিকে নর্মদা পার হয়ে দাক্ষিণাত্যে অভিযান পরিচালনা করেন।
এইসময় রাষ্ট্রকূট রাজ্যের দ্বিতীয় ধ্রুবর কাছে তিনি বাঁধা প্রাপ্ত হন।
ত্রিশক্তি দ্বন্দ
রাজা দেবপালের মৃত্যুুর পরে পাল শক্তি পরাক্রমী নেতৃত্ব সংকটে কিছুটা দুর্বল হয়। সেইসঙ্গে দক্ষিণের রাষ্ট্রকূট শক্তির সঙ্গে পূর্ব চালুক্যদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
তখন রাজা মিহির ভোজ, তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে পুনরায় পূর্বদিকে যুদ্ধযাত্রা করেন গাঙ্গেয় উপত্যকা ও কনৌজ জয় করার উদ্দেশ্যে।
জনশ্রুতি আছে, এই যুদ্ধে তিনি গোরক্ষপুরের চেদি এবং গুহিলোৎ শক্তির সহায়তা নিয়েছিলেন।
কনৌজের এই যুদ্ধে রাজা মিহির ভোজ পাল শক্তিকে পরাজিত করে কনৌজ রাজ্য নিজ অধীনস্থ করেন।
তারপর তিনি রাষ্ট্রকূট দ্বিতীয় কৃষ্ণকে পরাজিত করেছিলেন এবং মালব ও গুজরাটের একটা বড় অংশ জয় করেন।
এরপরে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের দ্বিতীয় কৃষ্ণ, রাজা মিহির ভোজকে পুনরায় বাঁধা দেয় এবং উজ্জয়িনীর যুদ্ধে রাজা মিহির ভোজ পুনরায় রাষ্ট্রকুট শক্তিকে পরাজিত করেন এবং গুজরাট ও মালবে তিনি তাঁর আধিপত্য বজায় রাখেন।
রাজা মিহির ভোজের যুদ্ধ ও মিত্রদের রক্ষা
রাজা মিহির ভোজ, বাংলার রাজা দেবপালের পুত্র নারায়ণ লাল এবং দক্ষিণের রাষ্ট্রকূটের রাজা অমোঘ বর্ষকে পরাজিত করে তাঁদের রাজ্য নিজ অধীনস্থ করেছিলেন।
সিন্ধুর আরবীয় শাসক ইমরান বিন মুসাকে পরাজিত করে সিন্ধু অঞ্চলকে নিজের রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন।
তিনি মুলতানের মুসলিম শাসককে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন করেছিলেন।
পূর্বে কনৌজ রাজ্যে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গভূমির পাল, উত্তর ভারতের প্রতিহার এবং দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূট শাসকগণ প্রায় ১০০ বছর ধরে সংগ্রাম করেছিল। ইতিহাসে এই সংগ্রাম ‘ত্রিকোণ সংগ্রাম’ নামে পরিচিত।
রাজা মিহির ভোজ, আগ্রাসী লুটেরাদের থেকে তাঁর বন্ধুদের রক্ষার জন্য নিজের সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিছেন।
পন্ডিতদের মতে, রাজা মিহির ভোজ কাবুলের রাজা লালিয়া শাহীকে তুর্কি আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন সেনাবাহিনী পাঠিয়ে।
অপরদিকে, নেপালের রাজা রাঘবদেবও তিব্বতের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন রাজা মিহির ভোজের কল্যাণে।
বিভিন্ন সুত্র মতে, তিনি দক্ষিণের শক্তিশালী রাজা রাজেন্দ্র চোলার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে নিজ রাজ্যকে শক্তিশালী করেছিলেন।
রাজা মিহির ভোজ শুধু একজন সনামধন্য শাসক ছিলেন না; পণ্ডিত, কবি, চিন্তাবিদ এবং মহান দাতা সহ বহুবিধ গুণে গুণান্বিত একজন বিশেষ ব্যাক্তি ছিলেন। লেখক হিসাবে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল।
তাঁর রাজ্যে তৎকালীন সময়ের প্রভাবশালী সংস্কৃত ভাষা ব্যাবহার করা হতো। শিক্ষার প্রতি তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
রাজা মিহির ভোজ নির্মিত তাম্রশাসন প্লেট আজও জাদুঘরে দেখা যায়।
ভোপালের আশেপাশে ভোজেশ্বর মন্দিরের এলাকায়, রাজা মিহির ভোজের শাসনামলে নির্মিত স্থাপত্য আজও তাঁর মহত্ত্বের পরিচয় প্রদান করে।
তিনি ভেজপুরার (বেয়াওয়া নদীতে) একটি বাঁধ নির্মাণ করে, যেটা ঐ সময়ের একটি অনন্য কৃতিত্ব।
ঐতিহাসিক কিছু সুত্র অনুযায়ী, রাজা মিহির ভোজের মিত্রদের তালিকায় ছিল- কাবুলের রাজা লালিয়া শাহী, কাশ্মীরের রাজা অবন্তী বর্মণ, নেপালের রাজা রাঘব দেব এবং আসামের রাজা।
রাজা মিহির ভোজের বিদেশী শত্রুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- আরবের খলিফা মৌতসিম ওয়াসিক, মুতভাক্কল, মুনতাশির, মৌমিদাদি।
এসব আরবীয়দের সেনাবাহিনী বহুবার আক্রমণ করেও রাজা মিহির ভোজের বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ করতে পারেনি।
রাজা মিহির ভোজের বাহিনী হর হর মহাদেব ও জয় মহাকালের ধ্বনিতে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের ধ্বংস করে দিত।
কখনো রণক্ষেত্রে ভীনমল, কখনো হাকরা নদীর তীরে, কখনো ভারুচ ও বল্লভী নগর পর্যন্ত আরব আক্রমণকারীদের সাথে যুদ্ধ হতো।
কনৌজ রাজ্যের সীমানা
রাজা মিহির ভোজের অধীনে কনৌজ রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত হয়েছিল- মূলতান থেকে পশ্চিমবঙ্গ (সমগ্র বঙ্গভূমি) এবং কাশ্মীর থেকে কর্ণাটক পর্যন্ত।
তাঁর রাজ্যের সীমান্ত ছিল দক্ষিণে রাষ্ট্রকূট রাজ্য, পূর্বে বাংলার পাল সাম্রাজ্য এবং পশ্চিমে মূলতান।
হিমাচল, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, গুজরাট ও উরিষ্যা পর্যন্ত।
প্রতিহার বংশের শ্রেষ্ঠ এই রাজা মিহির ভোজের রাজধানীর অবস্থান নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও, বেশিরভাগ ঐতিহাসিকদের মত তিনি কনৌজকে তার বিশাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন।
অর্থাৎ তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল কনৌজ। রাজা মিহির ভোজের রাজসভার কবি ছিলেন রাজশেখর।
রাজা নাগভট্ট প্রতিহার তাঁর উত্তরাধিকারী ছিলেন। প্রতিহার নাগভট্টর শাসনামল থেকে সৈন্যদের মাসিক বেতন নগদে দেওয়ার নিয়ম প্রবর্তন হয়েছিল।
যোধপুর শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ঐতিহাসিকদের মত, রাজা মিহির ভোজ চন্দেল রাজা জয়শক্তিকে পরাজিত করে কালিঞ্জর রাজ্য নিজ অধীনস্থ করেছিলেন।
মন্দোরের রাজা বউককে পরাজিত করে গুজরাট রাজ্য নিজের শাসনে এনেছিলেন। তখন দক্ষিণ রাজপুতানার চাহামনা রাজবংশ রাজা মিহির ভোজের শাসনে ছিল।
কালাচুরি শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই কালাচুরি রাজবংশ রাজা মিহির ভোজের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
চাটসু শিলালিপির বর্ণনা, হর্ষরাজ গুহিল গৌড় নরেশকে পরাজিত করেছিলেন এবং পূর্ব ভারতের রাজাদের নিকট থেকে নিয়মিত কর আদায় করতেন।
রাজা মিহির ভোজকে উপহার হিসাবে ঘোড়া দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, গুহিল নরেশ রাজা মিহির ভোজের অধীনে ছিল।
৮৮২ খ্রিস্টাব্দে পাওয়া পেহোয়া শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে পন্ডিতদের মত, হরিয়ানা রাজা মিহির ভোজের শাসনে ছিল।
তিনি প্রথমদিকে পাল,রাষ্ট্রকূট এবং কালাচুরিদের কাছ থেকে বাঁধা প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
কিন্তু রাজা মিহির ভোজের রণকৌশলী সামরিক নেতৃত্বের দক্ষতা ও ত্রিশক্তি দণ্ডের প্রভাবে এই পরিস্থিতি বদলে যায়।
রাজা মিহির ভোজ, পাল শাসক নারায়ণপালকে পরাজিত করে তাঁর রাজ্যের পশ্চিম অংশ নিজ রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন।
৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ ভ্রমণে আসা আরবীয় পর্যটক সুলেমানের “সিলসিলি-ই-তোয়ারিশ” গ্রন্থে রাজা মিহির ভোজের বিষয়ে উল্লেখ আছে।
এই গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, উট, হাতি, ঘোড়া সহ ৩৬ লক্ষ সেনার একটি বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল রাজা মিহির ভোজের।
তবে তাঁর মতে, রাজা মিহির ভোজের অশ্বারোহী বাহিনী সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল।
আরবীয় এই পর্যটক সুলেমান, তার ভ্রমণকাহিনীতে উল্লেখ করেছেন, গুর্জারদের রাজা মিহির ভোজ যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন,
ততদিন আরবীয় যোদ্ধাদের সেখানে যুদ্ধ যাত্রা করা ভয়ংকর বিপদের কারণ হবে।
তাঁর মতে, সেই সময়ে উত্তর ভারতে রাজা মিহির ভোজের থেকে ক্ষমতাবান মহারাজা আর কেউ ছিলেন না।
সিন্ধু অঞ্চল পর্যন্ত তাঁর শাসনে ছিল। হর্ষের থেকেও বড় রাজা বলা হতো রাজা মিহির ভোজকে।
তৎকালীন সময়ের কাশ্মীর রাজ্যের রাজকবি কালহানা তাঁর রচিত রাজ তরঙ্গিণী গ্রন্থে রাজা মিহির ভোজের বর্ণনা লিখেছেন।
৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ ভ্রমণকারী বাগদাদের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আল মাসুদি, তিনিও রাজা মিহির ভোজের রাজ্যসীমা, রাজ্যের সেনাবাহিনী এবং নিশ্চিন্তে বাসযোগ্য সুন্দর ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া মধ্যযুগের বেশকিছু ঐতিহাসিক রাজা মিহির ভোজ সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছেন।
রাজা মিহির ভোজের রাজ্য বিস্তার
উত্তরে পাঞ্জাব ও অযোধ্যা রাজ্য তাঁর অধীনস্থ ছিল। কাশ্মীরের শঙ্কর বর্মণ কঠোর প্রতিরোধ করলে, কাশ্মীর পূর্ণভাবে নিজ অধীনস্থ করতে পারেন নি।
তবে, ঐতিহাসিক মতে কাশ্মীরের বড় একটা অংশ রাজা মিহির ভোজের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
কয়েকটি রাজ্য ব্যাতীত, সমগ্র উত্তর ভারত তাঁর অধীনে ছিল।
রাজ্যসীমা বর্ধনের পরে রাজা মিহির ভোজ তাঁর রাজধানী কনৌজে স্থাপন করেন।
কিছু পন্ডিতদের মতে, রাজা মিহির ভোজ তাঁর রাজ্যসীমা সিন্ধু অতিক্রম করে দক্ষিণ দিকে নর্মদা নদী, উত্তর-পশ্চিম দিকে সুতলজ নদী এবং পূর্ব দিকে বাংলা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে নর্মদা নদী পর্যন্ত একটি বৃহৎ অঞ্চল নিয়ে এবং উত্তর প্রদেশের বর্তমান ইটাওয়া জেলাকে সংযুক্ত করেছিল।
কিছু পন্ডিতদের মতে, গুর্জার রাজ্য তাঁর শাসনে ছিল এবং গুর্জ্জর অঞ্চল বর্তমানের গুজরাট রাজ্য।
বরাহ তাম্রফলক থেকে জানা যায়, রাজা মিহির ভোজ ৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গুজরাট এবং পূর্ব রাজপুতানার উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রাজা মিহির ভোজের সঙ্গে আরবীয় বাহিনীর যুদ্ধ
রাজা মিহির ভোজের সঙ্গে আরবীয় বাহিনীর প্রথম যুদ্ধ সংগঠিত হয় ৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে।
তখন আরবীয় সেনাবাহিনীর ইমরান বিন মুশার বাহিনী সিন্ধু দেশ আক্রমণ করে।
ভারতবর্ষ রক্ষার্থে তৎপর হয়ে সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করে, পাল্টা প্রতিঘাত করে ইমরানের বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন রাজা মিহিরভোজ।
প্রায় ৩ লক্ষ সেনার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে এই যুদ্ধ করেছিলেন রাজা মিহির ভোজ।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে আরবীয় এই বাহিনী রাজা মিহির ভোজের সেনাবাহিনীর কাছে করুণ পরিণতি প্রাপ্ত হয়।
মূলতান এবং মনসূরা অঞ্চলে ছিল আরবীয় আধিপত্য থাকার ফলে মনসূরায় অভিযান পরিচালনা করেন রাজা মিহির ভোজ।
এই সংবাদ আরবে পৌঁছে যায় এবং আরব থেকে রাজা মিহির ভোজকে, তাঁদের কট্টর শত্রু হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
নিজের সাম্রাজ্যের সীমান্ত রক্ষার্থে রাজ্যের বিভিন্ন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেন রাজা মিহির ভোজ। এজন্য সহজেই লুটেরাদের গোয়েন্দা ও তাঁদের সৈন্যদের গতিবিধি নজরে থাকত।
রাজা মিহির ভোজের এই পাল্টা আঘাত লুটেরা আরবীয় বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল।
এক বছরের মধ্যে আরবীয়গণ
পুনরায় পশ্চিম দিক থেকে ভারতবর্ষ আক্রমণ করার চেষ্টা করে।
তখনও সিন্ধুর গভর্নর ছিলেন ইরমান ইবনে মুসা।
তিনি রাজা মিহির ভোজের রাজ্যের উপর একটি বিশাল আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু এই আক্রমণ সহ পরবর্তী প্রায় ২০টি আরবীয় আক্রমণ ব্যর্থ করে দেন রাজা মিহির ভোজ।
খলিফাগণ সিন্ধুর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং ৮৩৩ থেকে ৮৪২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আরবদের ঐ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা হয়।
মিত্রতা স্থাপন করে শুধুমাত্র মুলতান ও মনসুরা অঞ্চল তাঁদের শাসনের অধীন ছিল।
আরবদের বর্ণনা অনুযায়ী সিন্ধুর প্রায় ৪৮০ মাইল এলাকা রাজা মিহির ভোজের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
দশম শতকে ভারত সফরকারী বাগদাদের আল মাসুদি রাজা মিহির ভোজকে কনৌজ রাজ্যের প্রভু এবং সিন্ধুর অন্যতম প্রধান রাজা হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
তাঁর বর্ণনায়, এই রাজার চর্তুদিকে বিশাল সেনাবাহিনী ছিল এবং বাতাসের চার ভাগ অনুযায়ী ছিল।
প্রতিটি বাহিনীতে সেনাসদস্যের সংখ্যা ছিল ৭-৯ লক্ষ।
সীমান্তে মোতায়েন করা এসব বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণ থাকত সহায়তার জন্য। কিছু পন্ডিতদের মতে, এই জনসাধারণের মধ্যে মুসলিমও থাকত।
একটা বিষয়ে স্পষ্ট, তিনি প্রথমদিকে রাজ্য বিস্তারে বাঁধাপ্রাপ্ত হলেও,
পরবর্তীতে চৌকস রণকৌশলের মাধ্যমে তাঁর রাজ্যকে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত লুটেরাদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেছিলেন।
ঐতিহাসিকদের মতামত- আরবীয়দের বহু আগ্রাসী আক্রমণ প্রতিরোধ করে পাল্টা আঘাত করে তাদের করুণ পরিণতি বরণে বাধ্য করা,
এটাই সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব রাজা মিহির ভোজের।
তাঁর সাহসী সামরিক দক্ষতার কারণে, পরাজিত আরবীয়গণ কনৌজ সামন্তদের আদেশ অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
ঐতিহাসিক মতে, আরবীয় আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে কমপক্ষে ২০ টি যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে ভারতবর্ষ নিরাপদ রেখেছিল এই হিন্দু বীর মহান রাজা মিহির ভোজ।
তাঁর তলোয়ার প্রতিটি যুদ্ধেই ঝলসে উঠত আগ্রাসী শত্রুর বিরুদ্ধে এবং ভারতভূমি রক্ষার্থে।
রাজা মিহির ভোজের শেষ জীবন
রাজা মিহির ভোজ প্রায় ৪৯ বছর বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করার পরে
তার পুত্র মহেন্দ্রপালকে রাজ্যের শাসনভার প্রদান করেন এবং নিজেকে নিয়োজিত করেন ধর্ম চর্চায়।
ইতিহাসবিদদের বর্ণনা, রাজা মিহির ভোজ ৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ৮৮২-৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের কোনো একটি সময়) ৭২ বছর বয়সে নর্মদা নদীর তীরবর্তী এলাকায় মৃত্যু বরণ করেছিলেন।
সনাতনীদের পৌরণিক গ্রন্থ স্কন্দপুরাণের প্রভাস অংশে, রাজা মিহির ভোজের বীরত্ব, সাহসিকতা ও পরাক্রম সম্পর্কে বর্ণনা করা আছে।
Pingback: ইতিহাস কি? | ইতিহাসের জনক কে? | ইতিহাস কেন পড়বো