রাজা প্রতাপাদিত্য | বাংলার বারোভুঁইয়া ও বাংলার শিবাজী
মহারাষ্ট্রের শিবাজীকে নিয়ে ভারতবর্ষ গর্ব করে, কিন্তু বাংলার প্রায় সমতুল্য রণকুশল ও অনেক বেশি প্রজাবৎসল, বাংলার শিবাজী হিসাবে পরিচিত রাজা প্রতাপাদিত্য, যিনি পাঠ্যপুস্তকে বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম হিসাবে মুঘলদের অধীনতা স্বীকার করেননি, তাকে আমরা প্রায় ভূলতে বসেছি! তিনি আমৃত্যু পর্যন্ত বহিরাগত মুঘল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন নিজ মাতৃভূমি রক্ষায়।
শিবাজী মহারাজের চেয়ে অগ্রজ হওয়ার পরেও মহা রাজা প্রতাপাদিত্যকে সম্মান জানাতে আমরা ব্যার্থ! কবির ভাষায়, “সেদিন মুঘল-পাঠান দমিয়ে, উঠে দাঁড়ালে রাজা প্রতাপাদিত্য, বঙ্গের তুমি হলে মহারাজ, আজও জাগে ভয়শূন্য চিত্ত।” বাঙ্গালি হিন্দু জাতীয়বোধের রাজ শক্তি বলতে রাজা প্রতাপাদিত্যকেই বুঝায়! তেজস্বী বাঙ্গালীর হৃদয়ে বহিঃশত্রু মুঘল দমনকারী রাজা প্রতাপাদিত্যের আর্দশ আজও ইতিহাসে উজ্জল!
ভারতবর্ষের মধ্যযুগের ইতিহাসে বাংলার শাসক হিসাবে দেশীয় বীর রাজাদের থেকে বহিরাগত লুটেরা নবাবগণ অনেকটাই বেশি জায়গা পেয়েছেন, বাম ও বিকৃত ইতিহাসবিদ দের কারণে! বর্তমানে এই উপমহাদেশের পাঠ্যসূচীতে বহু কালজয়ী বীরের বীরত্ব মুছে দিয়ে, বীরত্বের ইতিহাসের থেকে দাসত্বের ইতিহাস বেশি পড়ানো হয়।
এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উদাহরণ হিসেবে একজন বাঙ্গালীকে জাহাঙ্গীর বা আকবরের বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলে সে খুব সহজেই বলে দেবে, তবে সম্রাট শশাঙ্ক, সম্রাট অশোকের জীবন পরিচয় সম্পর্কে বলতে হিমশিম খাবে।
ইংরেজরা ভারত ত্যাগ করেছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কারণে; কিন্তু বাম ও চাটুকার ইতিহাসবিদ কর্তৃক রচিত গ্রন্থে এমনভাবে দেখানো হয় যেন, ইংরেজরা নিজরাই ভারত ত্যাগ করেছিল! একইভাবে মুঘলদের পরাজিত করতে ভারতীয়দের বহু রক্তক্ষয় করতে হয়েছিল, কিন্তু ইতিহাস বিদেশী লুটেরা মুঘলদের চরণবন্দনা করতে ব্যাস্ত।
রাজা প্রতাপাদিত্যের জন্ম
মুঘলদের অত্যাচারে যখন বঙ্গভূমি সহ ভারতের হিন্দু সমাজে ভয় ও দুঃখের ছায়া তখন বাংলায় আবির্ভাব হয় এই মহা পরাক্রমী রাজা প্রতাপাদিত্যের। তিনি জমিদার থেকে শুরু করে হয়ে উঠেছিলেন এক মহান হিন্দু রাজা। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা প্রতাপাদিত্যের বিক্রমের খ্যাতি সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচারিত হয়েছিল, তাঁর ক্ষমতার নেপথ্যে অলৌকিক দৈব আশীর্বাদের গল্প জনশ্রুতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কুলীন কায়স্থ দশরথ গুহের বংশে মহা রাজা প্রতাপাদিত্যের জন্ম। তাঁর প্রপিতামহ রামচন্দ্র গুহ সপ্তগ্রামে কানুনগো দপ্তরে কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর তিন পুত্র; ভবানন্দ, গুণানন্দ ও শিবানন্দ ফার্সি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে ওই কানুনগো দপ্তরেরই চাকুরী করেন।
গৌড়ের নবাব আফগান শাষক দায়ুদ (মতান্তরে দাউদ) খাঁর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন ভবানন্দের পুত্র শ্রীহরি এবং গুণানন্দের পুত্র জানকীবল্লভ। তাঁরা বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী সুন্দরবন অঞ্চলে এক বিস্তীর্ণ এলাকার জায়গীর প্রাপ্ত হন এবং বনজঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করেন। এবং জানকী বসন্ত রায় নাম গ্রহণ করেন এবং তাঁদের জমিদারির সীমা ছিল যশোর, খুলনা ও চন্দ্রদ্বীপ (বাখরগঞ্জ) জেলার অধিকাংশ অঞ্চল।
বাংলার আফগান শাসক দাউদ খানের একজন প্রভাবশালী ও বিশ্বস্ত রাজ কর্মচারী ছিলেন রাজা প্রতাপাদিত্যের বাবা শ্রীহরি। পরবর্তীতে নবাবের কাছ থেকে মৃত চাঁদ খানের জমিদারি ও ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি লাভ করেন। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে দায়ুদের মৃত্যুর পর বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি তোডর মল্লের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাদশাহের নিকট হতে যশোর রাজ্যের শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত হন।
১৫৭৪ খ্রিষ্টাব্দে খুলনা জেলার বাওর এলাকায় নিজেকে ‘মহা রাজা বিক্রমাদিত্য’ হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৫৬০ (মতান্তরে ১৫৬১) খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহরি বিক্রমাদিত্যর ঔরসে বসু কন্যার গর্ভে একটি সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর নাম রাখা হয় প্রতাপ গোপীনাথ।
এই প্রতাপই বাংলার শিবাজী খ্যাত বঙ্গেশ্বর মহা রাজা প্রতাপাদিত্য। পুত্রের নাম রাখেন প্রতাপ গোপীনাথ। বৈষ্ণব মতে শ্রীহরির আর এক নাম ছিল গোপীনাথ। এই রাজপুত্রই পরে রাজা প্রতাপাদিত্য নামে বঙ্গভূমিতে পরিচিত হয়।
বর্তমান ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিন ২৪ পরগণা, যশোর, কুষ্টিয়া, নড়াইল, বরিশাল সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত রাজ্যে রাজা প্রতাপাদিত্য প্রবল প্রতাপে প্রায় ২৫ বছর রাজত্ব করেন। উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারি পেলেও প্রতাপের কৃতিত্ব, ধূমঘাটে নতুন রাজধানী স্থাপন ও মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ঘোষণা। ঐতিহাসিক সূত্র মতে, এই ধূমঘাটই পরে যশোহর নামে পরিচিত হয়, যে নাম গৌড়ের যশ হরণ থেকে উদ্ভূদ।
যশোহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যশোরেশ্বরী কালী মন্দির তাঁরই প্রতিষ্ঠিত। মা কালীর পরম ভক্ত ছিলেন তিনি।
রাজা প্রতাপাদিত্য জন্মের পরে জ্যোতিষীদের ভবিষ্যৎবাণী ছিল পিতৃদ্রোহিতার। রাম রাম বসু লিখেছেন, “জ্যোতিষিরা বলেছিলেন পুত্র সব বিষয়েই উত্তম হবে কিন্তু পিতৃদ্রোহী। মনের কষ্ট মনে রেখে রাজা অন্নপাশনে পুত্রের নাম রাখলেন “প্রতাপাদিত্য।” জন্মের দিন কয়েক পরে প্রতাপাদিত্যের জন্মদাত্রী মা মারা যান।
এইককারণে, শ্রীহরি ছেলে সম্পর্কে কিছুটা নিরাসক্ত হয়ে যান। শিশু প্রতাপাদিত্যকে বুকে তুলে নেয় কাকা বসন্ত রায় ও তাঁর স্ত্রী।
স্নেহময়ী এই কাকিমাকেই নিজের মা বলে জানতেন। রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজত্বে তাঁর কোন সহধর্মিণী নয়, এই কাকিমাই ‘যশোরের মহারানী’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন।
রাজা প্রতাপাদিত্যের শৈশব ও শিক্ষা লাভ :
শিশুকালে প্রতাপ শান্ত ও নিরীহ ছিলেন। স্নেহের প্রভাবে বাল্যকালেই প্রতাপ চঞ্চল ও দুরন্ত হয়ে উঠেন। এই সময় প্রতাপ বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান ও মেধাবী ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, ফার্সি ও বাংলা ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি সংস্কৃত ভাষায় স্তব অনেক সুন্দর ভাবে আবৃত্তি করতেন।
তিনি শাস্ত্র অপেক্ষা অস্ত্র শিক্ষায় পক্ষে ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে উত্তম শিক্ষক ছিলেন রাজা বসন্ত রায়। বাল্যকালে রাজা প্রতাপাদিত্য যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তিনি তরবারী, তীর চালনা ও মল্লযুদ্ধে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। শৈশব স্থানের কারণে, সুন্দরবনের সাথে প্রতাপের নিবিড় সম্পর্ক ছিল।
তিনি সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘ, হরিণ প্রভৃতি শিকার করতেন। বসন্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে মেধাবী প্রতাপ কয়েকটি ভাষা ও রাজনীতি সহ তরবারি, তীর চালনা এবং মল্লযুদ্ধ শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে ওঠে।
রাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে শোনা যায়, তিনি ছোট বয়সেই বাঘের সাথে যুদ্ধ করে নিজের বাহুবলে চোয়াল ছাড়িয়ে দিতেন।
রাজা প্রতাপাদিত্য দেবভাষা সংস্কৃত ও বেদ চর্চায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। অল্প বয়সেই দেখা যায় নেতৃত্বের লক্ষণ, যার জন্য বসন্ত রায় উৎসাহ নিয়ে প্রতাপকে রাজ্য শাসনের শিক্ষাও দিতে শুরু করেন।
কিন্তু অতিরিক্ত মৃগয়া (জঙ্গলে শিকার) প্রবণ হয়ে ওঠার কারণে শ্রীহরি ও বসন্ত রায়, কিশোর প্রতাপকে শান্ত করতে বিয়ে দিয়ে দেন।
রাজা প্রতাপাদিত্যের বিবাহ :
প্রথমে কুলীন কায়স্থ জগদানন্দ রায়ের (বসু) কন্যার সাথে ও পরে ১৫৭৮ সালে অব্যল্য জিতামিত্র নাগের কন্যা শরৎকুমারীর সঙ্গে বিবাহ হয়।
দ্বিতীয় স্ত্রী শরৎকুমারী নাগ ছিলেন প্রধান মহিষী। তৃতীয় বিবাহও হয়েছিল, তবে তা প্রতাপের রাজা হবার অনেক পরে। কিন্তু সুন্দরী গুণবতী স্ত্রী পেয়েও রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রতাপের শিকারপ্রিয়তা ও উদ্দামে লাগাম পরানো যায়নি।
১৯৭৮-এর শেষের দিকে আগ্রায় সম্রাট আকবরের রাজ দরবারে প্রতাপাদিত্য কে যশোহরের প্রতিনিধি করে প্রেরণ করেন পিতা শ্রীহরি।
টোডর মলের মাধ্যমে বাদশার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিন বছর সেখানে অবস্থানের কারণে মোগলদের বিশাল সাম্রাজ্য শাসন ও রাজপুত বীরদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচয় হয়।
রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্য লাভ :
১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে টোডর মল বঙ্গের জায়গীরদারদের বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে প্রায় এক বছর বাংলার শাসনভার সামলান।
প্রতাপাদিত্যের ব্যক্তিত্বে সম্ভবত সম্রাট আকবরও যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। হয়তো তাই টোডর মলের অনুপস্থিতিতে প্রতাপ কৌশলে যশোর রাজ্যের সনদ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। সম্রাটের অনুকম্পা লাভ করলেও মুঘল আধিপত্য থেকে মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা জাগ্রত হয় তখন থেকেই।
১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে আগ্রা থেকে যশোরের সনদ নিয়ে প্রতাপ বাড়ি ফিরলে রাজা বিক্রমাদিত্য, রাজ্যের ৫/৮ ভাগ পুত্র প্রতাপাদিত্য ও ৩/৫ অংশ ভাই বসন্ত রায়ের মধ্যে ভাগ করে দেন। রাজা প্রতাপাদিত্য দেখলেন সম্রাট আকবর আগ্রার রাজদরবার, রাজনীতি ও রাজপরিবারের অন্তর্কলহ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে সমগ্র ভারতবর্ষে বিদ্রোহের সৃষ্টি হচ্ছে।
এই সুযোগে রাজা প্রতাপাদিত্য শক্তি সঞ্চয় করেন ও সীমান্ত রক্ষার জন্য সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করেন। এজন্য তিনি নতুন রাজধানীর প্রস্তুতি নিতে লাগলেন এবং মুঘলদের বিতাড়নের উপায় নিয়ে বাংলার অন্য ভুঁইয়াদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। ভুঁইয়াদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতাপের এই বিদ্রোহী চেতনার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করলেও অনেকেই দূরত্ব বজায় রাখেন।
রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্যভিষেক :
এরপর ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর যশোর নগরের ৮-১০ মাইল দক্ষিণে যমুনা নদী ও ইছামতী নদীর সঙ্গমস্থলে সুন্দরবন সংলগ্ন ধুমঘাট নামক স্থানে নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানেই ১৫৮৪ সালে রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক হয়।
জনশ্রুতি আছে, প্রতাপের রাজ্যাভিষেক উৎসবে এক কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। তাঁর অভিষেকে বারোভুঁইয়াদের অনেকে যশোর গিয়েছিলেন এবং বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে ধূমঘাটে রাজধানী স্থানান্তরে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মুঘলদের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করতে পাঠানদের সঙ্গে মিত্রতা করেন। শত্রুদের হাত থেকে রাজ্য রক্ষা করতে গড়ে তোলেন সেনাবাহিনী, সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় নৌশক্তির উপর।
অশ্বরোহি, তীরন্দাজ, গোলন্দাজ সহ মোট ৯ ভাগে বিভক্ত ছিল সেনাবাহিনী।
রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাবাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে একাধিক পাঠান সেনানায়ক ছিল। ১৫৮৭ সালে ধুমঘাটের দূর্গ নির্মাণ শুরু হলে, দুর্গ দেখভালের প্রধান দায়িত্ব ছিল পাঠান সেনাপতি কমল খোজার উপর। বর্তমানে দুর্গটির ধ্বংসাবশেষ তীরকাটি জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যায়।রাজা প্রতাপাদিত্য তার শাসনামলে তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী বহু স্থানে দূর্গ নির্মাণ করেন।
এই দূর্গসমূহ পশ্চিমে হুগলী নদী থেকে পূর্বে বলেশ্বর নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল নির্মিত হয়েছিল। তাঁর তৈরী বেশ কয়েকটি প্রসিদ্ধ দূর্গের নাম ; যশোর দূর্গ, ধূমঘাট দূর্গ, কমলপুর দূর্গ, বেদকাশী দূর্গ, শিবসা দূর্গ, জগদ্দল দূর্গ, সালিখা দূর্গ, সাতলা দূর্গ, আড়াই বাকী দূর্গ, মনি দূর্গ, রায়মঙ্গল দূর্গ, তকশ্রী দূর্গ ইত্যাদি…।
এই সমস্ত দূর্গের বেশিরভাগ গভীর অরণ্যে অবস্থিত ছিল। কালের বিবর্তনে ধ্বংস হলেও, এখনও কিছু দূর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। যদিও মুঘলদের সঙ্গে প্রথমে বিরোধিতা করেননি, বরং তাদের সামন্তরাজ হয়ে কয়েকবার যুদ্ধযাত্রা করেন।
এর মধ্যে মানসিংহের সঙ্গে উড়িষ্যা অভিযান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উড়িষ্যা থেকেই গোবিন্দদেবের বিগ্রহ এবং উৎকলেশ্বর থেকে শিবলিঙ্গ এনে গোপালপুর ও বেদকাশীতে স্থাপন করেন। উড়িষ্যা থেকে ফেরার পথে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং মোঘলদের বিরুদ্ধাচারণ শুরু করেন।
রাজা প্রতাপাদিত্যের চোখে বঙ্গভূমিতে হিন্দু শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ক্রমেই জাগ্রত হতে থাকে। সমগ্র যশোর রাজ্যের অধিকার লাভ করে প্রতাপাদিত্য ‘মহারাজ’ উপাধি ধারণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের পর তিনি যথেষ্ট প্রজাবৎসল শাসক হিসাবেই খ্যাতি লাভ করেন।
নিজের নামে মুদ্রা প্রবর্তন করেন তিনি। প্রতাপের রাজ্যে তখন নৃশংস মগ, ফিরিঙ্গি (পর্তুগীজ) ও জলদস্যু হার্মাদদের উপদ্রব ছিল।
দস্যুদের অত্যাচার থেকে প্রজাদের রক্ষা করা সহ মুঘলদের সাথে বিরোধ করে, বিপদ তিনি নিজেই আহ্বান করেছিলেন।
উল্লেখ্য, ‘হার্মাদ’ শব্দ এসেছে স্প্যানিশ শব্দ ‘আর্মাডা’ থেকে, যার অর্থ ‘নৌবহর’। ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবর হুগলী নদীর তীরে (বর্তমান ব্যান্ডেল) পর্তুগিজদের বসতি করতে দিয়েছিলেন। তখন বাংলায় এটাই ছিল পর্তুগিজদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। বর্ষাকালে তারা বাংলায় ব্যবসা করতেন, বর্ষার পরে গোয়াতে চলে যেতেন।
তখন ভারতবর্ষে গোয়া অঞ্চলটি ছিল পর্তুগিজদের মূল ঘাঁটি। মূলত পর্তুগিজরা চাইত একচেটিয়াভাবে বাণিজ্য করতে, তাই বিপক্ষের জাহাজ দেখা মাত্রই লুঠ করত। বিশেষ করে চট্টগ্রাম আর সপ্তগ্রামে সবচেয়ে বেশি জাহাজ তারা লুঠ করেছিল। আর এই কারণেই সবাই তখন পর্তুগিজ জলদস্যু বা হার্মাদদের সমুদ্রের ত্রাস মনে করত। চট্টগ্রামের আরাকান আর মগ জলদস্যুরাও পর্তুগিজদের সঙ্গে যৌথভাবে লুঠপাট করত। রাজা প্রতাপাদিত্যের কাকার মৃত্যুর সময় ও পরে বাংলা ও উড়িষ্যার মুঘল ও পাঠানদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল।
রাজা প্রতাপাদিত্য মোগলদের প্রতিহত করতে ছিলেন পাঠানদের পক্ষে। সেই সময় তাঁর মনে বাংলায় একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের আশা বিকশিত হচ্ছিল।
রাজা প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধাভিযান ও বিজয় :
১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজা প্রতাপাদিত্য মুঘলদের সঙ্গে তিনবার যুদ্ধ করেছিলেন।
তিনটি যুদ্ধে হিজলপতি ঈশা খাঁ, মুঘল সেনাপতি শের খাঁ ও ইব্রাহিম খাঁকে পরাজিত করেছিলেন।
প্রতাপকে সামান্য ভূস্বামী মনে করে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিয়ে আক্রমণ করেছিল তাই, যশোহর বাহিনীর নিকট পরাজয় স্বীকার করে পিছু হঠে।
মহা রাজা প্রতাপাদিত্য জানতে পারেন,
পার্শ্ববর্তী বিক্রমপুরের শাসনকর্তা চাঁদ রায় ও তাঁর ভাই কেদার রায় স্বাধীন রাজ্য করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন
এবং রাজা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে রচিত মিত্রতা সম্পর্ক ছিন্ন করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই রাজা প্রতাপাদিত্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সেনাপতিদের সঙ্গে নিয়ে বিক্রমপুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাজা প্রতাপাদিত্য।
চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লো বিক্রমপুর। এই আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলেন না চাঁদ রায়।
পরাজয় নিশ্চিত জেনে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করলেন বিক্রমপুরের শাসনকর্তা চাঁদ রায়।রাজা প্রতাপাদিত্য সন্ধি করেন চাঁদ রায়ের সঙ্গে।
উজবেকিস্তান থেকে আসা দখলদার মুঘল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য লড়াইয়ে আর একজন সঙ্গী পেলেন তিনি।
এবার রাজা প্রতাপাদিত্য মূল লক্ষে নজর দেন।
ঘনিষ্ঠ মহলের সঙ্গে বহু আলাপ আলোচনার পর রাজা প্রতাপাদিত্য বুঝলেন,
মুঘল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হতে হলে,
পূর্বভারতের সমস্ত মুঘল বিরোধী স্থানীয় শক্তির বৃহত্তর মৈত্রী স্থাপন করা প্রয়োজন।
এই উদ্দেশ্যে বাল্যবন্ধু শঙ্কর চক্রবর্তীকে তিনি প্রেরণ করেন পার্শ্ববর্তী উড়িষ্যা ও বিহার প্রদেশে মুঘল বিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য।
ধীরে ধীরে সুন্দর ভাবে অগ্রসর হতে থাকেন বুদ্ধিদীপ্ত শঙ্কর চক্রবর্তী।
উড়িষ্যার তৎকালীন একজন প্রধান শাসনকর্তা রামচন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা সফল হয়।
বিহারের বিদ্রোহী পাঠান সেনানায়ক কতলু খাঁ ও ওসমান খাঁর সঙ্গে পরবর্তী রণপ্রস্তুতি নিয়ে কয়েকবার আলোচনা চলতে লাগলো।
এরই মধ্যে শঙ্কর গিয়ে উপস্থিত হলেন মিথিলায়। এখানে গণ্ডক নদীর তীরে তিনি দেবী ভগবতীর প্রতিমা সংস্থাপন করেছিলেন।
এরপর তিনি রাজমহল প্রদেশে একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় উদ্ধত প্রকৃতির মুঘলশাসনকর্তা শের খাঁর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন।
শের খাঁ আগে থেকেই গুপ্তচরের মাধ্যমে শঙ্কর চক্রবর্তীর উদ্দেশ্য জানতেন এবং যেকোন অজুহাতে তাঁকে বন্দী করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন।
রাজদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত এক ব্রাহ্মণকে শঙ্কর আশ্রয় দিয়েছেন,
এই মিথ্যা অভিযোগ এনে, শের খাঁ কূটকৌশলে শঙ্কর চক্রবর্তীকে বন্দী করে ফেললেন।
এই খবর পাওয়া মাত্র রাজা প্রতাপাদিত্য অত্যন্ত সর্তকতার সঙ্গে কারারক্ষীদের উপঢৌকন দিয়ে,বাল্যবন্ধু শঙ্কর চক্রবর্তীকে মুক্ত করেন (মতান্তরে শঙ্কর কারাগার থেকে পালিয়ে যায়)।
আরও পড়ুন…
কারামুক্ত শঙ্কর চক্রবর্তী দ্রুত গতিতে যশোরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
শের খাঁ শঙ্করের পালানোর খবর পেয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি
এগিয়ে চললেন যশোরের দিকে শঙ্কর ও রাজা প্রতাপাদিত্যকে উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য।
এরকম ঘটনা যে ঘটতে পারে, প্রতাপাদিত্য তা আগেই অনুমান করতে পেরেছিলেন।
এজন্য রাজা প্রতাপাদিত্য আগেই তাঁর সৈন্যবাহিনীকে তিনভাগে বিভক্ত করে, শের খাঁর সম্মুখীন হবার জন্য এগিয়ে চললেন।
অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে শের খাঁর সামনে আসে শঙ্কর এবং পূর্ব পরিকল্পিত রণকৌশল অনুযায়ী তিনি প্রথমে শের খাঁর কাছে হেরে গিয়ে পালাতে শুরু করলেন।
শের খাঁ বিপুল উৎসাহ নিয়ে তাড়া করলেন শঙ্করকে এবং এখানেই সবচেয়ে বড় ভুল করেন।
শঙ্কর চক্রবর্তীর লুকিয়ে রাখা মূল বাহিনী, ঠিক সেই সময়েই যুদ্ধে এসে সংহারমূর্তি ধারন করে।
শুরু হয় মরণপণ যুদ্ধ। ঠিক তখনই ডানদিক থেকে রাজা প্রতাপাদিত্য এবং বাঁ দিক থেকে সূর্যকান্ত গুহ তাঁদের বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শের খাঁর মুঘল বাহিনীর উপর।
তার মধ্যে যোগ হল, ফ্রান্সিসকো রডার গোলন্দাজ বাহিনীর ভয়ঙ্কর গোলাবর্ষণ। শের খাঁ বুঝলেন তিনি শত্রুর দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়েছেন।
কোনোক্রমে পালিয়ে গেলেন তিনি। এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
ফলে সমগ্র পূর্ব ভারত জুড়ে মুঘল সাম্রাজ্যে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা।
কর দেওয়া বন্ধ করা থেকে, মুঘল সেনাছাউনি আক্রমণ, রাজস্ব লুট,
গেরিলা কায়দায় মুঘল সেনাবাহিনীর যাতায়াতের রাস্তা নষ্ট করে দেওয়া ইত্যাদি চলতে থাকল অবাধে।
যশোর অধিপতি রাজা প্রতাপাদিত্যের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় সমগ্র বঙ্গদেশে।
সম্রাট আকবর ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন।
সম্রাট আগেই, কচু রায় এবং তাঁর ভগ্নিপতি ও অবিভাবক রূপরাম বসুর মাধ্যমে রাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিয়েছেন।
তিনি নিজেও রাজা প্রতাপাদিত্যকে দেখেছেন। অনেক চিন্তাভাবনার পর সম্রাট আকবর, সেনাপতি ইব্রাহিম খাঁকে পাঠালেন রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য।
ইব্রাহিম খা়ঁ দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে, প্রচুর রসদ ও সৈন্যবাহিনী বাংলার দিকে যাত্রা করলেন।
কিন্তু ইব্রাহিম খা়ঁ পারলেন না রাজা প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করতে।
জলপথে পর্তুগীজ ফ্রান্সিসকো রডা তাঁর দুর্ধর্ষ নৌ ও সেনাবাহিনী এবং কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুঘল বাহিনীর উপর।
সম্পূর্ণ অজানা দুর্গম পরিবেশে, চারদিক থেকে রাজা প্রতাপাদিত্যের সৈন্যবাহিনীর বিক্ষিপ্ত চোরাগোপ্তা আক্রমণে পরাজিত হয় ইব্রাহিম খাঁ।
প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পরাজয় মেনে নিয়ে তিনি সেনাবাহিনীকে পিছু যাওয়ার নির্দেশ দেন।
রাজা প্রতাপাদিত্যের বাহিনী কালান্তক যমের মত পিছু ধাওয়া করে।
বহুকষ্টে পালিয়ে যান ইব্রাহিম খাঁ। বিজয়ী প্রতাপ যশোরে ফিরে এলেন।
রাজা প্রতাপাদিত্য বুঝেছিলেন, পরপর এত পরাজয় সম্রাট আকবর মেনে নেবেন না।
তাই ‘আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়’ এই বাক্য স্মরণ করে তিনি নিজেই মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণের জন্য মনোযোগ দেন।
নিজের অনুপস্থিতির কারণে কোন বিশৃঙ্খলা না হয় তাই তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব ভবানীদাস এবং লক্ষীকান্ত নামক দুই জন বিশ্বস্ত কর্মচারীর হাতে অর্পণ করেন।
এই লক্ষীকান্ত বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের আদি পুরুষ। সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে রাজা প্রতাপাদিত্য বেরিয়ে পড়লেন।
প্রথমে তিনি অতর্কিত আক্রমণ করেন বন্দর নগরী সপ্তগ্রামের উপর। সপ্তগ্রামের মুঘল সেনাঘাঁটি ছিল একটু দুর্বল, তারপর অপ্রস্তুত।
তাই খুব সহজেই সপ্তগ্রাম দখল করেন প্রতাপ। এরপর গঙ্গা নদীর উপর দিয়ে রাজা প্রতাপাদিত্য যান রাজমহলের দিকে।
অবরোধ করেন রাজমহল, দীর্ঘ প্রতিরোধ করেও রাজমহলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারল না মুঘল সেনাগণ।
বাধ্য হয় আত্মসমর্পণ করতে।
তারপর রাজা প্রতাপাদিত্য পাটনা অভিমুখে যান। পথে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয় বিদ্রোহী পাঠান সেনানায়কগণ।
উড়িষ্যা থেকে আসা মিত্র রাজাগণ পূর্বেই যোগ দিয়েছিলেন।
পাটনায় মুঘল দুর্গ অবরোধ করেনন রাজা প্রতাপাদিত্য।
এবারও পাটনা দুর্গের পতন ঘটিয়ে বিজয় অর্জন করেন প্রতাপ।
রাজা প্রতাপাদিত্যের এই বিজয় বার্তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
সমগ্র পূর্ব ভারতে যশোর অধিপতি রাজা প্রতাপাদিত্য হয়ে উঠলেন একজন কিংবদন্তী।
বিভিন্ন এলাকার ভুঁইয়ারা তখন প্রতাপের সঙ্গে মৈত্রী করে মুঘল বাদশাহের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করতে সংকল্প করেন।
১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আকবরের অধীনতা অস্বীকার করে রাজা প্রতাপাদিত্য যশোরের সর্বাত্মক স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
এমন মহান হিন্দু রাজার বীরত্ব ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়লে, হিন্দু সম্প্রদায় অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলো দেখতে শুরু করে।
এই সময় রাজা প্রতাপাদিত্যের ছেলে উদয়াদিত্যের সঙ্গে শ্রীপুরের জমিদার সারদারঞ্জন পাল চৌধুরীর মেয়ে বিভাপাল চৌধুরীর বিবাহ হলে,
সেই সূত্রে শ্রীপুরেও তাঁর যোগাযোগ তৈরি হয়।
মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় ছাড়াও রাজা প্রতাপাদিত্যের কৃতিত্ব জলদস্যু দমন।
রাজদন্ড গ্রহণ করেই বঙ্গোপসাগরের উপকূল এলাকায় মগ ও পর্তুগীজ় জলদস্যুদের অত্যাচার দমনে নজর দেন।
তাদের রুখতে রাজা প্রতাপাদিত্য নৌসেনা গঠনে উদ্যোগী হন। নির্মম মগজাতি যেখানে যেত, একেবারে ধ্বংসস্তূপ করে দিত।
আর বঙ্গোপসাগরে হার্মাদ জলদস্যুরা এদেশের নারী পুরুষ ধরে নিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করতো।
বন্দীদেরকে হাতের তালুতে ছিদ্র করে সরু বেত ঢুকিয়ে, বেঁধে জাহাজের পাটাতনের নীচে বোঝাই করে পৈশাচিক পদ্ধতিতে মানুষ পাচার করত তারা।
বর্তমান ভারতের ভাগীরথী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত তাদের দৌরাত্ম ছিল।
রাজা প্রতাপাদিত্য এই বেপরোয়া নৃশংস দস্যুদের দমনে শুধু জয়ী হননি,
কয়েকজনকে বশীভূত করে তিনি নিজের সেনাবাহিনীতেও নিযুক্ত করেছিলেন।
তাই এসব কারণে, রাজা প্রতাপাদিত্যের শাসনামলে রাজ্যবাসী জনসাধারণ সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনযাপন করত।
ঐতিহাসিক সুত্র অনুযায়ী, তার রাজসভায় নয়জন বিশিষ্ট কবি ছিল।
ইতিহাসে এদেরকে ‘নবরত্ন’ বলা হয়। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন কবি কালিদাস।
তিনি শুধু ভারতের না, তিনি সারা পৃথিবীর এক অন্যতম প্রধান কবি।
সতীশচন্দ্রের মতে প্রধানত যে সকল কারণে রাজা প্রতাপাদিত্য যুদ্ধ করেছিলেন –
১। আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রাধান্য স্থাপন করা।
২। পাঠানদের পক্ষ সমর্থন করা, যারা মুঘলদের নিকট পরাজিত হয়েছিলেন।
৩। বঙ্গদেশে হিন্দু রাজ শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
৪। শুধু মুঘলদের নয়, মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুদের পাশবিক নির্যাতন থেকে তার রাজ্যের মানুষকে রক্ষা করা।
আকবরের মৃত্যুর পরে সেলিম নুরুদ্দীন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর নাম নিয়ে সিংহাসনে আহোরণ করলে, তার কাছে রাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে অভিযোগ যায়।
জাহাঙ্গীর রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমন করতে মানসিংহকে সেনাবাহিনী সহ প্রেরণ করেন।
১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহের নেতৃত্বে মুঘলদের বিশাল সেনাবাহিনী যশোর অভিমুখে ধাবিত হয়।
ভবানন্দ মজুমদার নামে এক জমিদার মুঘলদের সব রকম সাহায্য করায়, মান সিংহ ধূমঘাট দুর্গ দখল করতে সমর্থ হন।
ইতিপূর্বে সুন্দরবনের জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশ রাজা প্রতাপাদিত্যকে মুঘলদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ও প্রতিহত করতে যথেষ্ট সুবিধা দিয়েছিল।
উড়িষ্যা অভিযানে বীরত্বের জন্য মানসিংহ প্রতাপকে পছন্দ করতেন,
তারপর যশোর যুদ্ধে প্রতাপের রণকুশলতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।
তাই যুদ্ধে জয়ী হয়ে রাজা প্রতাপাদিত্যকে বন্দী পরবর্তীতে সন্ধি করলেন।
চুক্তি অনুযায়ী যশোর রাজ্যের দশ আনার শাসক ও মুঘল অধীনস্থ সামন্ত রাজা হিসাবে প্রতাপাদিত্য স্বীকৃতি পান।
পরিবর্তে রাজা প্রতাপাদিত্যকে নিজের প্রবর্তিত মুদ্রা ও স্বাধীনতার ধ্বজাটি বিলুপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে সম্পর্কের উন্নতির জন্য ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজা প্রতাপাদিত্য মুঘল সুবেদার ইসলাম খানের কাছে প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে প্রতিনিধি হিসাবে নিজ পুত্র সংগ্রামাদিত্যকে প্রেরণ করেন।
কিন্তু ইসলাম খান রাজা প্রতাপাদিত্যকে স্বয়ং হাজির হওয়ার শর্ত দিয়ে সংগ্রামাদিত্যকে আটকে রাখেন।
বাধ্য হয়ে ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা প্রতাপাদিত্য আত্রাই নদীর তীরে সুবেদার ইসলাম খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
মুঘলদের পক্ষ হয়ে রাজা প্রতাপাদিত্য ও পুত্র সংগ্রামাদিত্য পাঠান মুসা খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন, এই শর্তে প্রতাপাদিত্য মুক্ত হন।
কিন্তু পরবর্তীতে সেই কথা না রেখে মুঘলদের সঙ্গে রাজা প্রতাপাদিত্য পুনরায় সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন।
এরমধ্যেই আফগান, পাঠান ও পর্তুগীজ় সৈন্য দ্বারা নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন।
ক্ষুব্ধ মুঘল বাহিনী রাজা প্রতাপাদিত্য ও তাঁর জামাতা রামচন্দ্রর রাজধানী একসঙ্গে আক্রমণ করে, যাতে জামাই শ্বশুরকে সাহায্য করতে না পারে।
কিন্তু যমুনা এবং ইছামতি নদীর সঙ্গমস্থল এলাকায় প্রতাপের আরেক পুত্র উদিত্য নারায়ণ, প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করে মুঘল বাহিনীকে পিছু হঠতে বাধ্য করেন।
মুঘল সেনাবাহিনীর গোলা বর্ষণে যশোর বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
তখন উদিত্য নারায়ণ পালাতে বাধ্য হন। মুঘলদের পক্ষে জামাল খান তাঁকে তাড়া করেন।
রাজা প্রতাপাদিত্যের পরাজয় :
মুঘলরা বুঝতে পারে বাংলা থেকে বড় একটি রাষ্ট্রবাদী শক্তির উত্থান হচ্ছে, যেটা ভারতে বিদ্যুতের বেগে ছড়িয়ে পড়ছে।
বেশকিছু সময়ে রাজা প্রতাপাদিত্যের কাছে পরাজিত হওয়া ভারতের কিছু লোভী রাজাদের সঙ্গে নিয়ে মুঘলরা প্রতাপাদিত্যের উপর আক্রমন করেন।
১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে এই যুদ্ধের ক্ষেত্র ছিল খাগড়াঘাট খাল এবং যমুনার সঙ্গম স্থান। মুঘলদের বিশাল সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিপরীতে এই যুদ্ধে প্রবল বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে,
নিজের পরিবারকে বলিদান দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি।
পতন ঘটে এক মহান হিন্দু শাসকের সময়কাল।
তখন রাজা প্রতাপাদিত্যের এক বিশ্বাসঘাতক কর্মচারী যিনি, প্রতাপের বিরুদ্ধে মুঘলদের সাহায্য করতেন, সেই ভবানন্দ মজুমদারকে সিংহাসনে বসানো হয়।
এভাবেই নদিয়া রাজ পরিবারের সূচনা। উল্লেখ্য, মুঘল আগ্রাসন থেকে বাংলাকে বাঁচাতে রাজা প্রতাপাদিত্য বারবার সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করেছেন,
কিন্তু ভবানন্দের কারণে সেই মুঘলদের অধীনে চলে যায় বাংলা।
কিন্তু মুঘল সেনারা যুদ্ধ বিজয় অর্জন করলেও, যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। খাগরাগড় যুদ্ধের পরে মুঘলরা একটা সন্ধির প্রস্তাব দেয়।
প্রকতপক্ষে রাজা প্রতাপাদিত্যকে ধরার ফাঁদ ছিল এটা।
চুক্তি অনুযায়ী রাজা প্রতাপাদিত্যকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেও,
গিয়াস খানের কাছে আত্মসমর্পণ করার সঙ্গেই তাঁকে বন্দী করে ইসলাম খানের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়।
মহারাজ প্রতাপাদিত্যের জীবনের শেষ দিনগুলি সম্পর্কে কোনও প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়নি।
কিছু মুঘল সূত্র থেকে জানা যায়, বন্দী অবস্থায় দিল্লী নিয়ে যাওয়ার পথে বেনারস থেকে পুনরায় পালিয়ে গিয়েছিলেন।
সেখান থেকে বাংলায় ফেরার পথে তিনি মারা যান। অর্থাৎ রাজত্ব হারালেও মৃত্যু হয়েছিল স্বাধীন অবস্থায়।
রামদাস স্বামীর ভাষায়,
“বলিলে যে বঙ্গদেশী প্রতাপের কথা, শুন গুরম্মত্ব তার।
তেজোবীর্য্যগুণে প্রতাপ প্রস্তুত ছিল স্বাধীনতা লাভে, কিন্তু তা’র জাতি, দেশ না ছিল প্রস্তুত;
জ্ঞাতিবন্ধু বহু তা’র ছিল প্রতিকূল, তাই হল ব্যর্থ চেষ্টা।
মূঢ় সেই নর, দেশ, কাল, পাত্র মনে না করি’ বিচার, একা যে ছুটিতে চায়; চরণস্খলনে নাহি রহে কেহ ধরি’ উঠাইতে তারে।।”
রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্য সরাসরি জয় করে মুঘলরা তাঁকে সিংহাসন ভ্রস্ট করতে চায়নি।
তিনি চাইলে স্বচ্ছন্দে মুঘল সাম্রাজ্যের একজন করদ রাজা হয়ে প্রজাদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে নিজে রাজকীয় জীবনযাত্রা বজায় রাখতেই পারতেন,
যেভাবে অন্যান্য বাংলার ভুঁইয়াদের অনেকেই ছিলেন।
কিন্তু রাজা প্রতাপাদিত্য কোন শর্তেই মুঘল সাম্রাজ্যের কোনরকম অধীনতা মানতে রাজি ছিলেন না।
রাজা প্রতাপাদিত্য উৎসব:
ইতিহাসে যথোচিত মূল্যায়ন না পাওয়া এই রাজাকে স্মরণ করে বাংলার তরুণ প্রজন্মে হিন্দু বাঙালি জাতীয়তাবোধ তৈরির উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গে ২০ এপ্রিল পালিত হয় ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’।
বাঙালি যে ভীরু রণবিমুখ নয়, অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা ছাড়াও বাঙালির একটা রাজকীয় ক্ষাত্রিয় ইতিহাস আছে, আত্মবিস্মৃত বাঙালী হিন্দুকে,
তার সেই অতীত সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে।
এখনও সাম্প্রদায়িক বিভাজনে অন্যায়ভাবে কোণঠাসা আত্মঘাতী হিন্দু বাঙালি যে প্রয়োজনে প্রতিরোধ এমনকি প্রতিশোধ নিতেও সক্ষম,
সেই বার্তা দেওয়াই ছিল অনুষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য।
অসম সাহসিকতা, বীরত্ব ও ক্ষাত্রিয় শক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই “পশ্চিমবঙ্গের জন্য” সংগঠনটি ২০১৯ থেকে চালু করে “মহা রাজা প্রতাপাদিত্য বীর-পদক ও সম্মান”।
পুরস্কারের উদ্দেশ্য “সৎ কাজে, ন্যায়ের পথে বাঙ্গালী যুবকদের মধ্যে সাহসিকতা ও ক্ষত্রিয় তেজের পুনর্জাগরণ”।
বঙ্গ মহারাজ প্রতাপাদিত্য জীবদ্দশায় শত্রুর সাথে লড়াই করে; বিদেশী মগ, মুঘল, পর্তুগীজ এবং পাঠানদের বারবার পরাজিত করেছেন।
জীবনে একটিমাত্র যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন, আর সেটাই ছিল তাঁর শেষ যুদ্ধ।
ঐ যুদ্ধে তাঁর কর্মচারী বিশ্বাসঘাতকতা না করলে বাংলার ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হত।
ভারতের মহারাষ্ট্রের শিবাজি মহারাজের জন্মের বহুপূর্বে রাজা প্রতাপাদিত্য এই বঙ্গের বিখ্যাত রাজা ছিলেন।
এজন্য তাকে বাংলার শিবাজি বলা হয়৷ যশোরের ইতিহাস বলতেই রাজা প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস।
অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ মহাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর বিখ্যাত ‘অন্নদামঙ্গল’ মহাকাব্যে মহা রাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে লিখেছেন,
“যশোর নগর ধাম
প্রতাপ আদিত্য নাম
মহারাজা বঙ্গজ কায়স্থ।
নাহি মানে পাতশায়
কেহ নাহি আঁটে তাঁয়
ভয়ে যত নৃপতি দারস্থ॥
বরপুত্র ভবানীর
প্রিয়তম পৃথিবীর
বায়ান্ন হাজার যার ঢালী
ষোড়শ হলকা হাতী অযুত তুরঙ্গ
যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী..."
১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস নিয়ে একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন, “বৌ ঠাকুরানীর হাট” নামে।
এই উপন্যাস আজও বাঙ্গালির নিকট ব্যাপক সমাদৃত।
মুঘল সেনাকে তিন বার পরাজিত করা এই বাংলার মহান বীর মহা রাজা প্রতাপাদিত্যের বীরত্বের ইতিহাস শুনে
শিবাজী মহারাজ ছত্রপতি শিবাজি হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
এছাড়াও সুভাষচন্দ্র বসু সহ কয়েকজন স্বাধীনতা সংগ্রামী মহারাজা রাজা প্রতাপাদিত্যর ইতিহাস পড়ে দেশকে স্বাধীন করার জন্য অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
তবে দুঃখের বিষয়, মহারাষ্টের জনসাধারণ শিবাজী মহারাজকে আজও শ্রদ্ধা করে,
রাজস্থানের জনগণ মহারানা প্রতাপ কে মনে রেখেছে, কিন্তু বাংলার মানুষ তাদের মহান হিন্দু রাজাদের ভুলে গেছে।
Pingback: মহারাণী ভবশঙ্করী বাংলায় রায় বাঘিনী - ভূরশুট রাজ্য | Rani Vavashankari History - shivrupi
Pingback: প্রথম মহিলা দার্শনিক ঋষিকা মৈত্রেয়ী | ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ীর ইতিহাস - shivrupi
Pingback: বাংলা সনের প্রবর্তক কে? | বাংলা সনের ইতিহাস | বাংলা মাসের উৎপত্তি - shivrupi
Pingback: লাচিত বরফুকন এর জীবনী | লাচিত বরফুকন এর বিষয়ে বাংলা রচনা
Pingback: ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা | কাশ্মীরের ইতিহাস