ঐতিহাসিক রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থটি মধ্যযুগে রচনাকৃত একমাত্র স্বীকৃত ইতিহাসমূলক বিখ্যাত গ্রন্থ। রাজতরঙ্গিনী পিডিএফ জ্ঞান পিপাসু পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করা হলো আজকের এই আর্টিকেল। এই অমূল্য প্রাচীন গ্রন্থে প্রাচীন ভারতের কাশ্মীর সাম্রাজ্যের সনাতনী আলোকজ্বল শাসনের ইতিহাস ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। খ্রিষ্টীয় ৭ম শতক থেকে ১২ শতক পযর্ন্ত কাশ্মীরের ধারাবাহিক হিন্দু রাজাদের শাসনের বর্ণনা আছে এই গ্রন্থে। মূলত কাশ্মীরের ইতিহাস এর বিষয়বস্তু হলেও, প্রতিবেশী রাজাদের তথ্যও এখানে বিদ্যমান।
রাজতরঙ্গিনী কার লেখা?
কাশ্মীরের বিখ্যাত ঐতিহাসিক কলহন এই গ্রন্থের রচয়িতা। যতটুকু জানা যায়, কহলন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। কলহনের পিতা ছিলেন চম্পক (তিনি সম্ভবত কাশ্মীর নৃপতি হর্ষের রাজ কর্মচারী ছিলেন)। রাজা জয়সিংহের শাসনামলে কহলন রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ রচনার কাজ সম্পন্ন করেন। বহু পরিশ্রমের মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষায় রচিত ঐতিহাসিক এই গ্রন্থ ৮ খন্ডে বিভক্ত ও ৭৮২৬টি শ্লোক নিয়ে গঠিত।
ধারণা করা হয়, কাশ্মীরের বিখ্যাত ঐতিহাসিক কহলনের রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থের রচনা কাল ১১৪৮-১১৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। ঐতিহাসিক কহলন, অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের পূর্বপুরুষ রচিত ইতিহাসের ঘটনাগুলো সংগ্রহ করে রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে এই গ্রন্থ কাশ্মীরের রাজাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক দলিল মনে হতে পারে, তবুও এই মূল্যবান দলিল থেকে পাওয়া তথ্যে ৭২৩-৮০৬ খ্রিষ্টাব্দের কাশ্মীরের গৌরবময় ইতিহাস বিশ্ববাসীর সামনে উঠে এসেছে।
উল্লেখ্য, সংস্কৃত ভাষায় ‘কা’ শব্দের অর্থ জল। ‘শিমিরি’ শব্দের অর্থ ‘শুষ্ক’ করা। অর্থাৎ জল শুকিয়ে যে স্থলভাগের উৎপত্তি, তা-ই ‘কাশ্মীর’। সনাতনী পৌরণিক গ্রন্থ অনুযায়ী, ঋষি কাশ্যপ জলসেচন করে শুষ্ক করেছিলেন। তার নাম থেকেই নামকরণ কাশ্মীর অঞ্চলের।
রাজতরঙ্গিনী পিডিএফ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়
ভারতবর্ষের কাশ্মীর রাজ্যের ইতিহাস মূলত রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত্য মুক্তিপিদাকে নিয়ে পরিপূর্ণ তথ্য সহ ৫২ জন হিন্দু রাজাদের শাসনব্যাবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
রাজতরঙ্গীনি গ্রন্থে বিখ্যাত কাশ্মিরী ঐতিহাসিক কলহন ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার সঙ্গে আরবীয় যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন– “দোর্দণ্ডপ্রতাপ লালিতাদিত্যের ক্রোধ তখনই শান্ত হত, যখন তাঁর শত্রু রাজারা হাত জোড় করে তাঁর বিজয়কে স্বীকার করে নিতেন। তাঁর রণবাদ্যের শব্দে শত্রুদেশের জনতা এবং সৈন্যবাহিনী চরম আতংকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত, এমন এক দৃশ্য যেন প্রাণভয়ে ভীত রমণীরা তাদের গর্ভের ভার মোচন করে ফেলেছে।”
ঐতিহাসিক কলহনের বর্ণনা অনুযায়ী ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার রাজত্বকাল ছিল ৩৬ বছর, ৭ মাস এবং ১১ দিন পযর্ন্ত। অর্থাৎ তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী ললিতাদিত্য ৭০০-৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন।
ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা একমাত্র হিন্দু রাজা, যিনি প্রবল বিক্রমে একের পর এক আগ্রাসী মুসলিম রাজ্যগুলোকে আক্রমণ করেন এবং প্রতিবারই পরাজিত করেন। তাঁর কাশ্মীর রাজ্যকে বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করে ভারতের আলেকজান্ডার হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় সামরিক অভিযানে ব্যয় করেছিলেন। একমাত্র তাঁর ভয়ে ভারতভূমিতে প্রায় ৩০০ বছর কেউ আক্রমণ করতে সাহস পায় নি!
ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা শুধু একজন মহান বীর যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি একজন প্রজাদরদী শাসক এবং সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্প,স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের মহান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি স্থাপত্য বিদ্যার অপূর্ব নিদর্শন রেখেছেন, তাঁর শাসনামলে নির্মিত বেশকিছু মন্দির ও স্থাপত্য এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য দেয়।
তাঁর শাসনামলে ক্ষুদ্র কাশ্মীর রাজ্য, বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়ে সনাতনী শিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞান এবং স্থাপত্যের একটি বড় কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত লাভ করে। তিনি কাশ্মীরে অনেকগুলো শিক্ষাকেন্দ্র ও গুরুকূল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেগুলো উগ্র ইসলামিক আগ্রাসনে ধ্বংস হয়েছে। ললিতাদিত্যের শাসনামলে কাশ্মীর স্বর্ণযুগ হিসাবে পরিণত হয়, সেখানে শিল্প, স্থাপত্য এবং শিক্ষার বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছিল।
রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থটি শুধু ঐতিহাসিক সত্তা নয়, সংস্কৃত ভাষার উপর কলহনের বিশেষ জ্ঞানের পরিচয় দেয়। এই ঐতিহাসিক রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ যদি কলহনের পরিবর্তে কোনো ফার্সি, ইসলামি, ব্রিটিশ অথবা অন্য কোনো বিদেশী লেখক রচনা করত, তাহলে হয়তো ভারতীয় ইতিহাসে বিখ্যাত এই হিন্দু রাজাগণ ও ঐতিহাসিক কহলনের একটু স্থান হতো।
ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার মৃত্যুর প্রায় ৫০০ বছর পরে রচিত ঐতিহাসিক রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থকে আজও কাশ্মীর তথা ভারতের ইতিহাসে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। যদিও এই গ্রন্থ বিদেশী ঐতিহাসিকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
অনেক পরে ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার মধ্য এশিয়া বিজয় নিয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অধ্যাপক আন্দ্রে উইঙ্ক -এর AL Hind, Making of Indo-Islamic world ছাড়াও কোরিয়ান বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হায়েচোর বিবরণ (খুব সম্ভবত তাঁর ভারত ভ্রমণ ৭২৫ খ্রিষ্টাব্দে ছিল) থেকেও ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় যেগুলো ঐতিহাসিক কলহনের রচিত রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থের সঙ্গে একমত পোষণ করে।
জার্মান ইতিহাসবিদ ও গবেষক, হারমান গোয়েটজ কলহনের রচিত এই ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘রাজতরঙ্গিনী’ সম্পর্কে বলেছেন- ‘রাজতরঙ্গিনী’ শুধুমাত্র ঐতিহাসিক গ্রন্থ না, এটি ভারতবর্ষের আলেকজান্ডার ললিতাদিত্য মুক্তিপিদার বিশাল সাম্রাজ্য গঠনের ঐতিহাসিক দলিল!
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ সর্ব প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করে বিশ্বের দরবারে পৌছে দেন অরেল স্টেইন। এর ফলে বিদেশী ঐতিহাসিকগণ ললিতাদিত্য মুক্তিপিদাকে Alexander of India উপাধি প্রদান করে। অরেল স্টেইন এর কল্যাণে বিশ্ববাসী জানতে পারে প্রাচীন ভারতবর্ষের মহান রাজা সম্রাটদের। জানতে পারে এক সময়ের হিন্দু রাজ্য কাশ্মীরের গৌরবময় সনাতনী শাসনামল সম্পর্কে। তিনি কলহনের রচিত রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থের ঐতিহাসিক বিবরণের মাধ্যমে পরবর্তী বিজয়গুলোকে “সুস্পষ্টভাবে কিংবদন্তী” হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।
ঐতিহাসিক সি ভি ভি বৈদ্য -এর মতে, কহলনের এই বিবরণ প্রথমে কাল্পনিক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর ‘চার্চ নামা’ -তে পাওয়া যায়, মুহাম্মদ বিন কাসিমকে রাজা দহির সম্বোধন করে এই লেখার একটি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “কাশ্মীরে এমন এক হিন্দু রাজা আছে, যার কাজে সবাই নতজানু হয়, তাকে বিদেশিগণ পর্যন্ত সম্মান করে, তাঁর সামনে মারকান, তুরানি সহ প্রভৃতি শাসকরা পযর্ন্ত তাঁর চরণ বন্দনা করে”।
এবার ২য় রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থের বিষয়ে একটু আলোচনা! এই বিখ্যাত গ্রন্থ ললিতাদিত্যের মৃত্যুর অনেক সময় পরে জনরাজ নামের একজন সংস্কৃত কবি ও ঐতিহাসিক কাশ্মীরের ইতিহাস বিষয়ক এই বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। লেখকের বিষয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। জনরাজের অকাল মৃত্যু হওয়ায় কারণে তিনি এই গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করতে পারেন নাই। শ্রীভারা নামক তাঁর এক ছাত্র এই গ্রন্থ রচনার কাজ শেষ করেন এবং তৃতীয় রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ রচনা করেন।
২য় রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ থেকে কাশ্মীরের কসাই হিসাবে পরিচিত সিকান্দারের কর্মকাণ্ডের একটু বিবরণ ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে উল্লেখ করা হলো— “এমন কোনো লোকালয় এমন কি জঙ্গলও ছিল না যেখানে সনাতনী দেব দেবীদের মন্দির ধ্বংস করা হয়নি। যখন সুরেশ্বরী, বরাহ সহ সকল দেব দেবীর প্রতিমা ভাঙচুর করা হচ্ছিল, তখন সমগ্র পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল, কিন্তু এই নিষ্ঠুর রাজার মনে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ে নাই। তিনি তাঁর সকল রাজকার্য ভূলে গিয়েছিলেন এবং সারা দিবারাত শুধু বিগ্রহ ধ্বংসের মাধ্যমে আনন্দ খুঁজে পেতেন।”
কাশ্মীরের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে, সিকান্দারের নাম সবার প্রথমে চলে আসে। কারণ, তিনি সমস্ত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন।
রাজতরঙ্গিনী পিডিএফ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
উপসংহার
ভারতের ভূস্বর্গ হিসাবে পরিচিত কাশ্মীরের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের জন্য রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ পাঠের বিকল্প নেই। এই মহামূল্যবান ঐতিহাসিক গ্রন্থকে জাতীয় পাঠ্যসূচীর অর্ন্তভুক্ত করা হলে, নব প্রজন্ম প্রকৃত জ্ঞান আহোরণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ হবে। সনাতনী বিক্রমী এই রাজাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে দেশপ্রেম জাগ্রত ও বহিঃশক্তির আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষা করতে অপরিসীম ভূমিকা পালন করবে।
Pingback: ভারতের আলেকজান্ডার ললিতাদিত্য মুক্তিপিদা | কাশ্মীরের ইতিহাস