আলোচিত সংবাদইতিহাসইসলাম ধর্ম

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব | ঔরঙ্গজেব এর ধর্মীয় নীতি

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব। 
Spread the love

বাম ও বিকৃত ইতিহাসবিদের কারণে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব তথা ঔরঙ্গজেব ও অন‍্যান‍্য মুঘল সম্রাটদের মতো এই উপমহাদেশে কীর্তিমান শাষক হিসাবে বিখ্যাত হয়ে আছেন। মূলত তিনি অন‍্যান‍্য আরবীয়, মুঘল শাষকদের মতো ভারতবর্ষের ইতিহাসে একজন প্রথম সারির কালো তালিকাভুক্ত অন্যতম শাসক। 

বেশকিছু পন্ডিতদের মতে- তিনি খিলজি, গজনী, ঘোরি, বিন কাশিমদের থেকেও বেশি আগ্রাসী ছিলেন। বহু আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন এই ঔরঙ্গজেব কে আদর্শ হিসাবে ধারণ করে। ঔরঙ্গজেব এর কট্টর ধর্মীয় নীতির কারণে বলি হয়েছে লক্ষ লক্ষ সনাতনী ও তাদের উপাসনালয়। তাঁর শাসনামলে সংখ্যালঘু দমন, অপশাসন ও দুর্নীতির মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি | ঔরঙ্গজেব এর ধর্মীয় নীতি

ধর্মান্ধ সুন্নি মুসলমান এই মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর মতে ভারতবর্ষ ছিল হিন্দুদের দেশ এবং তাঁর ইচ্ছে ছিল মুসলমানদের দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার। তিনি ছিলেন একজন ধর্মান্ধ কট্টরপন্থী শাষক এবং তিনি শরীয়া আইন বাস্তবায়ন করে ভারতবর্ষকে একটি ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। 

সোমনাথ মন্দির থেকে শুরু করে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির পর্যন্ত তিনি হিন্দু মন্দির ধ্বংসের অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।  উইল ডুরাণ্ট এর মতে, রাজ‍্যের প্রজাদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রতি নজর না দিয়ে, হিন্দু মন্দির ধ্বংস করাই তাঁর রাজধর্ম হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। 

তবে বেশকিছু ঐতিহাসিক এর মতে, এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ‍্যেও ঔরঙ্গজেবের শাসন আমলেই ভারতবর্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মন্দির তৈরী হয়েছিল। 

এর কারণ হিসাবে তাঁরা বলেছেন, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ এর ধারাবাহিক সংগ্রাম ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের মনে অসম্ভব জেদ সৃষ্টি করে। শিবাজী মহারাজকে দমন করতে এই মুঘল সম্রাট দীর্ঘদিন রাজধানী দিল্লি ছেড়ে দাক্ষিণাত‍্যে ছিলেন।  আর এই সময়েই ভারতবর্ষ ও বঙ্গভূমির গ্রামাঞ্চলে বেশকিছু নতুন মন্দির তৈরী হয়েছিল।

আওরঙ্গজেব এর জীবনী

মূলত এই মুঘল সম্রাট, একজন ইসলামী ধর্মান্ধ ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে জনসাধারণের মধ্যে। ১৯৪৬ সালে ভারতের অন‍্যতম সেক‍্যুলারপন্থী নেতা জওহরলাল নেহরুর প্রকাশিত ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে আওরঙ্গজেবকে একজন গোঁড়া ব্যক্তি হিসাবে উল্লেখ করেছেন। 

যিনি হিন্দু ও বৌদ্ধদের ঘৃণা করতেন, অগণিত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছেন, ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম ইসলামী শরীয়া আইন অনুযায়ী অমুসলিম দের উপর অতিরিক্ত জিজিয়া কর প্রবর্তন করেন।

কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতদের কাছে হিন্দুদের উপর এই মুঘল শাসকদের অত্যাচারের কথা শুনে, তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলায় ঔরঙ্গজেবের রোষের মুখে পড়েন শিখ গুরু তেগ বাহাদুর।  তেগ বাহাদুরকে আটক করে ভয়াবহ নির্যাতন করেন ও ইসলাম গ্রহণ করতে আদেশ দেন।

কিন্তু এই নবম শিখ গুরু বাহাদুর স্বধর্ম ত‍্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করায় নির্মম নির্যাতনে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেব হিন্দুদের প্রাচীন তীর্থ নগরী বেনারস এর নাম পরিবর্তন করে মুহাম্মদাবাদ নাম রাখেন। 

ভারতবর্ষে হিন্দুদের পবিত্র তীর্থভূমি কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির, কেশব দেও মন্দির এবং সোমনাথ মন্দির ভেঙ্গে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে সেই ভূমিতে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। ১৬৭৯ সালে তিনি বেশকিছু পুরোনো ও জনপ্রিয় হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন।

 

সম্রাট আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি

 

বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এবং গবেষক এম. এ. খান তাঁর রচিত ‘জিহাদ’ গ্রন্থে এবং ইবনে বতুতা যিনি কঠোরভাবে আরবীয় জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামিক শরীয়া আইন ধারণ করতেন, তারাও তাঁদের ভারতবর্ষ ভ্রমণের গ্রন্থে লিখেছেন- আওরঙ্গজেব ১৬৫৯ সালে মাত্র একবছরের মধ‍্যেই ৫ থেকে ৬ হাজার হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। 

আওরঙ্গজেব ক্ষমতা দখল করে নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য পুরণে নিজের বড় ভাইকে পর্যন্ত হত‍্যা করেছেন। তিনি তাঁর বৃদ্ধ পিতার জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর আগ্রার দুর্গে বন্দী করে রেখেছিলেন। 

বিকৃত চরিত্রের অধিকারী এই আওরঙ্গজেব কে, সালাহউদ্দীন উমর ইবনুল খাত্তাব ও ইউসুফ ইবনে আইয়ুবের মত খলিফাদের সঙ্গে তুলনা করে থাকে মুসলিমগণ।

বিখ্যাত মার্কিন ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রাশকে তাঁর রচিত গ্রন্থে এই বিতর্কিত মুঘল সম্রাটকে জটিল চরিত্র হিসাবে উল্লেখ করেছেন- যার সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক গতিশীল, কৌশলগত এবং দ্বন্দ্বমূলক।

ঔরঙ্গজেব ধর্মান্ধতার গোঁড়ামি কারণে ছলনার মাধ্যমে ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের ওপর আক্রমণ শুরু করেছিলেন। তাঁর শাসনামলের প্রথম বছরেই তিনি বেনারসের এক মন্দিরের পুরোহিতকে জানিয়েছিলেন যে, নতুন কোনো মন্দির নির্মাণের অনুমতি তাঁর ধর্ম অনুমোদন করে না। তবে পুরাতন মন্দির ধ্বংস করতে কোনো নিষেধ নেই। 

১৬৪৪ সালে তিনি গুজরাটের সুবাদার থাকাকালীন সময়ে আহমেদাবাদের নব নির্মিত একটা মন্দিরকে অপবিত্র করেছিলেন, ঐ মন্দিরের অভ‍্যন্তরে গরু জবাই করে। এরপর ঐ মন্দিরকে একটা মসজিদে রুপান্তর করেন। সেই সময়ে তিনি ঐ অঞ্চলের আরও বেশকিছু মন্দির ধ্বংস করেছেন। 

আওরঙ্গজেব pdf পড়তে এখানে ক্লিক করুন!

তাঁর শাসনামলের প্রথম সময়ের দিকে জারি করা একটা আদেশের মাধ্যমে তাঁর স্থানীয় কর্মকর্তাগণ উড়িষ্যা থেকে কটক পর্যন্ত শহর এবং গ্রামের অসংখ্য মন্দির ধ্বংস করেছিল, কিন্তু ঐ অঞ্চলে কোনো নতুন মন্দির নির্মাণ করার অনুমতি দেওয়া হয় নাই। 

১৬৬৯ সনের ৯ এপ্রিল বিধর্মীদের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয় ধ্বংসের একটা সাধারণ আদেশ জারি করেছিলেন আওরঙ্গজেব। 

এরপর তাঁর বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড শুরু হয় ভারতের বিখ্যাত বিখ্যাত তীর্থগুলোর দিকে, যেসব তীর্থ হিন্দুদের দৃষ্টিতে পরম শ্রদ্ধার ছিল। যেমন- সোমনাথের দ্বিতীয় মন্দির, বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির, এবং মথুরার কেশব রাই মন্দির।

আগ্রা ও দিল্লির মধ‍্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি মথুরা নগরী বহুবার ধর্মান্ধ মুসলমান শাষকদের গোঁড়ামির বিশেষ শিকার হয়েছিল। ঐ অঞ্চলের হিন্দুদের দমন করতে মথুরায় ফৌজদার হিসেবে ঔরঙ্গজেব, আবদুন নবী নামের একজন ধর্মান্ধ মুসলিম নিয়োগ দিয়েছিলেন। 

দারাশিকো ১৬৬৬ সনের ১৪ অক্টোবর কেশব রাই মন্দিরকে একটা পাথরের রেলিং উপহার দিয়েছিল, এটা এই মুঘল সম্রাট জানতে পেরে সেই রেলিং সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর ১৬৭০ সালে এই মন্দিরকে ধ্বংস করতে নির্দেশ দেন এবং এই শহরের নাম পরিবর্তন করে ইসলামাবাদ রাখেন।

ত‍ৎকালীন সময়ের মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ সমস্ত শহর এবং মহকুমায় যেসব শাষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল, হিন্দুদের উপাসনালয়ের স্থানগুলো ধ্বংস করা তাদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য ছিল। 

১৬৮০ সালে জুন মাসে জয়পুরের রাজধানী অম্বর শহরের মন্দিরগুলোও ধ্বংস করা হয়। ১৬৭৪ সালে গুজরাট অঞ্চলের হিন্দুদের সব জমি বাজেয়াপ্ত করা হয় ধর্মীয় অনুদান হিসেবে।

সনাতনী মন্দির ধ্বংসের বিষয়ে কয়েকটি লোককথা এখনো শোনা যায়-

 ভারতের রাজস্থানের শিকার জেলায় ধনতারামগড় তেহসিলের রালাভাটা গ্রামের আরাবল্লী পাহাড়ে অবস্থিত জিনমাতা মন্দির মন্দির ধ্বংস করতে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করতে এসে মাথা নত করে ফিরে গিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব। 

অলৌকিক ভাবে হঠাৎ একঝাঁক মৌমাছি এসে সম্রাটের বাহিনীকে আক্রমণ করে। মৌমাছির কামড়ে অস্থির হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটে পালিয়েছিল তাঁর সেনাদল। এই ঘটনার পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঔরঙ্গজেব ঐ মন্দিরে দেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও করেন এবং কখনও ঐ মন্দিরে আক্রমণ করেননি।

উত্তরাধিকার যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের ভূমিকা 

উত্তরাধিকার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরে ঔরঙ্গজেবের অত্যাচারের ভয়ে তাঁর বড় ভাই ক্রাউন প্রিন্স দারা শিকোহ পালিয়ে গেলেও, তাকে খুঁজে বের করে নির্মম আচরণ করা হয়। দারা শিকোহ আর তার চৌদ্দ বছরের নাবালক কিশোর ছেলে সিফি শিকোহ কে, প্রচণ্ড গরমের আবহাওয়ার মধ‍্যে চর্মরোগে আক্রান্ত একটি হাতির পিঠে বসিয়ে দিল্লির রাস্তায় ভ্রমণ করানো হয়েছিল।

এসময় একজন সেনা তরবারি নিয়ে তাদের পাশে থাকতো, কারণ পালাতে চেষ্টা করলেই তাদের গলা কাটা হবে। তৎকালীন সময়ে ভারত ভ্রমণে আসা ব‍্যাক্তিদের মধ‍্যে ইটালীর ইতিহাসবিদ নিক্কোলাও মানুচ্চি উল্লেখযোগ্য। 

তিনি তাঁর রচিত ‘স্টোরি দ্যা মুঘল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- ‘যেদিন দারাশিকো মারা যায়, সেইদিন আওরঙ্গজেব তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, যদি ভাগ্য বিপরীত হতো, তাহলে ঠিক কী ঘটনা ঘটতো?

দারাশিকো উত্তর দিয়েছিলেন- তিনি আওরঙ্গজেবের শরীর চার অংশ করে প্রতিটি অংশ দিল্লির প্রধান চার সিংহ দরজায় ঝুলিয়ে রাখতো।

 

আওরঙ্গজেব
আওরঙ্গজেব

ঔরঙ্গজেব কত সালে জিজিয়া ধার্য করেন?

ইসলামিক রাষ্ট‍্রে বিধর্মীদের বসবাস করার জন‍্য সর্বপ্রথম “জিজিয়া কর” এর প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন মহানবী মোহাম্মদ।

এই কর পরিশোধ করতে হবে করদাতাকে খালি পায়ে এসে, আর কর গ্রহীতা বসে থাকবে। নারী, চৌদ্দ বছরের কম সন্তান এবং ক্রীতদাস ছাড়া সবাইকে এই কর দিতে হবে। অন্ধ, পঙ্গু এবং পাগল ব‍্যাক্তিগণকে এই কর দিতে হবে যদি তারা ধনী হয়ে থাকে। হিসাব অনুযায়ী, গরিব বিধর্মীদের উপর এই করের পরিমাণ ছিল তাদের মোট আয়ের শতকরা ৬ ভাগ।

এই জিজিয়া কর প্রবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিম্নবিত্তগণ। ধর্মীয় আশ্রয়ের বিনিময়ে বাৎসরিক এই করের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে এক বছরের খাবারের সমান অর্থ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ১৫৬৪ সালে মুঘল সম্রাট আকবর এই কর বাতিল করেছিলেন কিন্তু আওরঙ্গজেব এই কর পুনরায় ফিরিয়ে এনেছিলেন।

তাঁর নির্দেশে ১৬৭৯ সালের ২ এপ্রিলে ইসলামে অবিশ্বাসী অর্থাৎ বিধর্মীদের ওপর পুনরায় জিজিয়া কর প্রবর্তন করা হয়। দিল্লি ও এর আশপাশের অঞ্চলের সমগ্র হিন্দুরা একত্র হয়ে করুণভাবে আবেদন করে এই কর প্রত্যাহারের জন্য। কিন্তু এই মুঘল সম্রাট বিন্দুমাত্র দয়া প্রদর্শন করেন নাই।

পরবর্তী শুক্রবারের দিন দুর্গের দরজা থেকে জামে মসজিদ পর্যন্ত সমগ্র রাস্তা পূর্ণ হয় অসহায় হিন্দুদের ক্রন্দনে। সম্রাটের লোকজন বারবার স্থান ত‍্যাগের নির্দেশ দিলেও, অসহায় হিন্দুগণ স্থান ত‍্যাগ করেনি।

এরপর সম্রাটের নির্দেশে প্রতিবাদী জনতার উপর দিয়ে হাতি চালনা করা হয়। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ চিঠির মাধ্যমে এই কর বাতিলের অনুরোধ করলেও, ঔরঙ্গজেব তাঁর সিদ্ধান্ত পুনরায় বিবেচনা করে নাই। এই জিজিয়া কর প্রবর্তনের ফলে প্রচুর অর্থ আদায় হয়, শুধুমাত্র এক গুজরাট প্রদেশ থেকেই বার্ষিক ৫ লক্ষ অর্থ সংগ্রহ হয়।

রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয় যে- জিজিয়া কর প্রবর্তনের উদ্দেশ্য হলো, হিন্দু জনগোষ্ঠীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা।

তৎকালীন বেশকিছু গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বহু হিন্দু এই কর পরিশোধ অক্ষম হয়ে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিল। বেশকিছু ঐতিহাসিকদের মতে, সামরিক খাতে অতিরিক্ত খরচের জোগান দিতেই এই জিজিয়া কর আরোপ করেছিলেন। এই করের বোঝার ফলে দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যতা ব‍্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

ঔরঙ্গজেবের শাসনামলে প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতি ছিল। অধীনস্থ কর্মকর্তাগণ মাঝেমাঝেই তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনসাধারণের থেকে অর্থ সংগ্রহ করত।

১৬৬৫ সালে এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে হিন্দুদের উপর দমননীতির আরেকটি অধ‍্যাদেশ জারি করা হয়। সেটা হলো- পণ্যদ্রব‍্য বিক্রির উপর মুসলিম ২% কর ও হিন্দু ৫% কর দিতে বাধ‍্য থাকবে।

১৬৬৭ সালের মে মাসের ৯ তারিখে মুসলিম ব‍্যাবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানি কর সম্পূর্ণরুপে বাতিল করা হয়, কিন্তু হিন্দু ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে পূর্বের মতই বহাল রাখা হয়। 

অবিশ্বাসীদের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন‍্য এগুলো করা হলেও, দেখা যায় এতে রাষ্ট্রেীয় ক্ষতি বেশি হচ্ছে। কারণ, হিন্দু ব্যবসায়ীগণ পরিচিত মুসলিম ব‍্যাবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে তাঁদের পণ‍্য দেখিয়েই শুল্কমুক্তভাবে চালাতে লাগল। 

এরপর সম্রাটের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, বিধর্মীগণ ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলে পুরষ্কার পাওয়া যাবে। সরকারি চাকরি, কারাবাস থেকে মুক্তি, বিতর্কিত জমির উত্তরাধিকার… এসব পুরষ্কারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

১৬৭১ সালে আরেকটি অধ্যাদেশ জারি করা হয় যে, এখন থেকে সাম্রাজ্যের সমগ্র জমির খাজনা আদায়কারীগণ অবশ্যই মুসলমান ধর্মের হতে হবে। সেই সাথে সব সুবাদার ও তালুকদারদের নির্দেশ দেওয়া হয়, তাদের সব হিন্দু কেরানী, হিসাবরক্ষক ও সহকারীদের বরখাস্ত করার জন‍্য।

এরপর এসব রাজ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করে, তাদের পদে মুসলিম কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু হিন্দু কর্মচারিদের বরখাস্ত করার পরে প্রশাসন প্রায় অচল হয়ে যায়। এজন্য পরে সম্রাট পুনরায় আদেশ জারি করেন যে- এসব কর্মকর্তাদের মধ্যে অর্ধেক হিন্দু এবং অর্ধেক মুসলমান কর্মী হতে হবে।

বিতর্কিত এই মুঘল সম্রাটের শাসনামলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে, সম্রাটের আদেশে হাতির পিঠে বসিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় রাজ শোভাযাত্রা করা হতো এবং প্রতিদিন সর্বনিম চার আনা করে বৃত্তি প্রদান করা হতো। 

১৬৯৫ সনের মার্চ মাসে আরেকটি আদেশ জারি করে রাজপুত ব‍্যাতীত সব হিন্দুদের পালকি, হাতি, ঘোড়া সহ সকল পরিবহন এবং অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করেন। বিশেষ কিছু দিনে হিন্দুরা তাঁদের ধর্মীয় স্থান ও তীর্থের পাশে মেলার আয়োজন করত।

বহু হিন্দু নারী, পুরুষ ও শিশুদের অংশগ্রহণে মুখরিত হতো এসব মেলা। ১৬৬৮ সনে এই ধরনের সব মেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই অপ শাসকের আদেশে দীপাবলি এবং বসন্ত উৎসব অনেকটা সংযতভাবে পালন হতো।

দাক্ষিণাত‍্যে ঔরঙ্গজেব pdf

ঔরঙ্গজেবের আমলে বিদ্রোহ করেছিল কারা?

সনাতন ধর্মের উপর ঔরঙ্গজেবের এমন ক্ষমাগত আক্রমণ ও নিষেধাজ্ঞার ফলে মথুরা জেলার নির্যাতিত হিন্দুগণ বিদ্রোহ শুরু করে। 

মুঘলদের বিরুদ্ধে অসহায় নির্যাতিত হিন্দুদের প্রথম বিদ্রোহ সংগঠিত হয় ১৬৬৯ সালের প্রথম দিকে মথুরা জেলাতে। এই মুঘল সম্রাটের প্রাণনাশের কয়েকটি চেষ্টা করলেও, ব‍্যার্থ হয়।

১৬৬০ সালের আগস্ট থেকে ১৬৬৯ সালের মে পর্যন্ত আবদুন নবী খান নামে মথুরার ফৌজদার নিযুক্ত ছিলেন। ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকেই তিনি তাঁর প্রভু ঔরঙ্গজেবের পদলেহনে বিশেষ কৃতিত্ত্ব প্রদর্শন করেন। 

১৬৬১-৬২ সালে মথুরার কেন্দ্রস্থলে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করেন এবং হিন্দুদের উপর অত‍্যাচার অব‍্যাহত রাখেন।

এছাড়াও তাঁর শাসনামলে সেনাবাহিনীতে কয়েকটি বিদ্রোহ হয়েছিল এবং এই বিদ্রোহের কারণে সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে পড়ে।

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু কত সালে হয়?

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয় ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে। দাক্ষিণাত্যের আহম্মেদনগরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর থেকেই মুঘলদের সাম্রাজ্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায় এবং বাহাদুর শাহ মৃত্যুবরণ করলে এই পতনের গতি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনে আওরঙ্গজেব এর ভূমিকা | ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর কে সিংহাসনে বসেন?

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, এই ১৫০ বছরের মধ্যে ১২ জন মুঘল সম্রাট দিল্লীর সিংহাসনে বসেছিলেন। 

তাঁরা হচ্ছেন –

১. ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে প্রথমে সিংহাসনে বসেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র প্ৰথম বাহাদুর শাহ। তাঁর শাসনামল ছিল – ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।

২. এরপরে সিংহাসনে বসেন প্রথম বাহাদুর শাহের জোষ্ঠ পুত্র জাহান্দার শাহ। তিনি ১৭১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন।

৩. এরপর মুঘল সিংহাসনে বসেন ফারুক শিয়ার। তিনি ছিলেন প্রথম বাহাদুর শাহের ২য় পুত্র আজিম উস শানের পুত্ৰ। তাঁর শাসনামল ছিল ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত৷

৪. এরপর মুঘল সিংহাসনে বসেন রাফি উদ দৌলত। তিনি ছিলেন প্ৰথম বাহাদুর শাহের তৃতীয় পুত্র রাফি উসশানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁর শাসনামল ছিল ১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দে।

৫. এরপর মুঘল সিংহাসন আহোরণ করেন রাফি উদ দারজাত। তিনি ছিলেন প্ৰথম বাহাদুর শাহের তৃতীয় পুত্রের দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর শাসনামল ছিল ১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দ।

৬. এরপরে ১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দেই মুঘল সিংহাসনে বসেন নিকুশিয়ার। তিনি  ঔরঙ্গজেবের চতুর্থ পুত্ৰ আকবরের পুত্র ছিলেন।

৭. এরপরে মুঘল সিংহাসনে বসেছিলেন মহম্মদ শাহ। তিনি প্ৰথম বাহাদুর শাহের চতুর্থ পুত্ৰ জাহান শাহের পুত্ৰ ছিলেন। মহম্মদ শাহের শাসনামল ছিল ১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত।

৮. এরপরে মুঘল সিংহাসনে বসেন আহমদ শাহ। তিনি মহম্মদ শাহের পুত্র ছিলেন। তাঁর শাসনামল ছিল ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত৷

৯. তারপর মুঘল সিংহাসনে বসেন ২য় আলমগীর। তিনি প্রথম বাহাদুর শাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র জাহান্দর শাহের পুত্ৰ ছিলেন। তাঁর শাসনামল ছিল – ১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত।

১০. তারপরে মুঘল সিংহাসনে বসেন ২য় শাহ আলম। তিনি ২য় আলমগীরের পুত্র ছিলেন। তাঁর শাসনামল ছিল – ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত।

১১. এরপরে মুঘল সিংহাসনে বসেন ২য় আকবর। তিনি ২য় শাহ আলমের পুত্র ছিলেন। তাঁর শাসনামল ছিল – ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত।

১২. এরপরে মুঘল সিংহাসনে বসেন ২য় বাহাদুর শাহ। তিনি ২য় আকবরের পুত্র ছিলেন। তাঁর শাসনামল ছিল – ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত।

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব। 
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব।

 

 ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পৰ্যন্ত, এই দেড়শো বছরের এই সময় ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের যুগ। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকেই মূলত মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পরে এই পতন আরও গতিশীল হয়।

ঔরঙ্গজেবের স্বেচ্ছাচারিতা ও অপশাসনের ফলে পরবর্তীতে রাজ ক্ষমতার অধিকার নিয়ে বিভেদ, সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের ফলে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে যায়। এই সুযোগে মারাঠা ও শিখ সম্প্রদায় সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। 

এরপর ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের শাসনামলে নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে দিল্লীকে ধ্বংসস্তুপ করে ও মুঘল সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে নিয়ে যায়।

 

তথ্যসূত্র:

১ The Mughal Empire, John F. Richards, Cambridge University Press (২০১৬)।

২ The Fall of the Mughal Empire, Vol. 1-4, Jadu Nath Sarkar, Orient BlackSwan (২০০৭)।

৪ আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী, অতুল সুর (১৯৫৭)।)             

৫ ‘Aurangzeb’ The Life and Legacy of India’s Most Controversial King. Author: Audrey Truschke  is Professor of History at Rutgers University.

৬ Advanced Study in the History of Modern India: Vol.1: 1707 – 1813. J. L. Mehta. Sterling Publishers Pvt. Ltd. p. 47.

৭ Encyclopaedia of Indian Events & Dates। By S. B. Bhattacharje, Sterling Publishers Pvt. Ltd। p. A80–A81

৮ Ayalon, David, Studies in Islamic History and Civilisation। Brill। p. 271।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *