প্রাচীন ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত হিন্দুবীর ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিংহ, যিনি মেবারের সিংহ নামে ভারতীয় ইতিহাসে বিখাত ছিলেন!
শৌর্য এবং বীরত্বের এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন হিন্দু রাজপুত শাষক রাজা মহারাণা প্রতাপ।
যাকে দেখে ভয়ে সামাজ্রবাদী মুঘলেরা ভয়ে কাঁপত। একজন মহান হিন্দুবীর, ক্ষত্রিয়চূড়ামণি মেবারের কুলতিলক মহারানা প্রতাপ সিংহ ছিলেন একজন মহান হিন্দুবীর যোদ্ধা, সহনশীল নেতা।
বীর হিন্দু রাজা মহারানা প্রতাপ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।
এই মহান বীর যোদ্ধা মহারানা প্রতাপ সিং আমৃত্যু পর্যন্ত শত্রুর বশ্যতা স্বীকার করেননি, প্রতি মুহুর্তে দেখেছেন স্বাধীনতার স্বপ্ন, আর এই স্বপ্ন নিয়েই তিনি নিজের জীবনকাল পূর্ণ করেন।
মহারানা প্রতাপ সিং ছিলেন মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আদায়ে বিরামহীন প্রচেষ্টার মূর্ত প্রতীক। একাধিকবার মোঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে সমগ্র ভারতবর্ষকে মুক্তির লক্ষ্যে এক নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছিলেন মহারানা প্রতাপ।
মহারাণা প্রতাপকে ভারতের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়, কারণ তিনি কখনই মুঘল সম্রাট আকবরের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি।
তিনি ছিলেন একমাত্র রাজপুত যোদ্ধা, যিনি আকবরের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সাহস প্রদর্শন করেছিলেন।
মুঘল দরবারের কবি আবদুর রহমান মহারাণা প্রতাপ সম্পর্কে লিখেছিলেন, এই পৃথিবীতে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। ধনসম্পদ শেষ হয়ে যাবে, তবে একজন মহান ব্যক্তির গুণাবলী পৃথিবীতে সর্বদা জীবিত থাকবে। তিনি হলেন মেবারের ( মেওয়ার ) সিংহ মহারানা প্রতাপ।
দুরদর্শী এই কবিরের ভাষার সত্যতা এখনো পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস এখনো প্রমাণ করে, ইতিহাসে মহারাণা প্রতাপের জীবনী আজও অম্লান!
পূর্বের কিছু আর্টিকেলে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের ইতিহাস গ্রন্থে মুঘল রাজাদের বীরত্বের কাহিনীতে পরিপূর্ণ। বিদেশী লুটেরা মুঘল রাজাদের বেশি মহান হিসেবে দেখানো হয়েছে।
কিন্তু ভারতবর্ষের হিন্দু রাজাদের সম্পর্কে তথ্য নামমাত্র। এক্ষেত্রে অনেক ইতিহাসবিদ দের মত, মুঘল শাসনের পরে ইংরেজ শাসন চলে এসেছিল। যার ফলে বিতর্কিত ইতিহাস রচিত হয়।
মুঘল শাসনকে উপড়ে ফেলার পর হিন্দু রাজগণ ধীরে ধীরে হিন্দু সংস্কৃতির বিকাশ করতে শুরু করেছিল। এর কিছু সময় পর ইংরেজরা ব্যাবসার সূত্রে এসে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিল।
সময় টা আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগের ভারতবর্ষের!
ভিনদেশি দখলদার বাহিনীর শাসকরা একের পর এক বিশাল সৈন্যবাহিনী, অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশ একের পর এক আক্রমণ করে দখল করে নিচ্ছে।
এদের মধ্যে আগ্রাসী উদ্দেশ্য পুরণে সফল হয়েছে আফগান, তুর্কি ও মোঘল গণ। বহু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা তাদের ইসলামী শাসনের ভিত যথেষ্ট শক্ত করেছে।
ঐ সময় লুটেরা শাষক গণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে ইসলামী শাসন কায়েম করার উদ্দেশ্যে কখনও যুদ্ধ, কখনও সন্ধির নাটক করতেছিল।
এরকম সংঘাতময় পরিস্থিতিতে একটি রাজ্য এই বিদেশী লুটেরা শাষকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তার নাম মেবার।
মেবারের ইতিহাস:
মেবারের ( মেওয়ার ) অবস্থান ছিল বর্তমানে উত্তর ভারতের রাজস্থানের অন্তর্গত। ইতিহাসে এই মেবার বহু ঐতিহাসিক ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু।
এই ইতিহাস খ্যাত মেবারের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক নায়ক ছিলেন বীর যোদ্ধা মহারানা প্রতাপ সিং। যে নাম আজও ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আজও উজ্জ্বল!
মেবারের সিংহ নামে পরিচিত এই মহারানা প্রতাপ ভারতবর্ষের মুক্তিসংগ্রাম ও দেশপ্রেমের অপর একটি নাম।
মোঘলদের বিরুদ্ধে একাধিকবার প্রতিরোধ করে সমগ্র ভারতবর্ষে বিদেশী আগ্রাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এক নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেন তিনি!
ভারতের ইতিহাসে এই দুর্দান্ত বীরের সাফল্য যুগে যুগে যেকোনো স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য প্রেরণার অন্যতম উৎস!
জন্ম ও মৃত্যুকে জয় করা এক প্রবল পরাক্রমী মহাযোদ্ধা মহারানা প্রতাপের জন্ম ১৫৪০ সালের ৯ মে ভারতের রাজস্থানের কুম্বলগড়ে সিসোড়িয়া রাজপুত বংশে।
তার পিতা ছিলেন মেবারের রাজা মহারানা দ্বিতীয় উদয় সিং। তার রাজধানী ছিল চিতোর। মহারানা প্রতাপের মা ছিলেন মহারানী জয়ন্ত বাঈ।
মহারাণা প্রতাপের শৈশবের নাম ছিল কিকা। ঐতিহাসিক মতে, প্রতাপের মায়ের প্রতি পিতা রানা উদয় সিংয়ের অনুরাগ কম ছিল।
যার কারণে প্রতাপ রাজ মহলের থেকে বেশি সময় ছিলেন ঘরের বাইরে সাধারণ সমাজে।
রাজমহল থেকে দূরে থাকায় তিনি নিজেকে অন্য ভাবে তৈরি করেছিলেন, সে গুণগুলো একজন সাধারণ রাজার থেকে তাঁকে আলাদা করে।
মহারানা প্রতাপ সাধারণ জনতার মধ্যে বড় হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ মানুষের চারিত্রিক গুণগুলো আপন করে নিয়েছিলেন মহারানা প্রতাপ।
তিনি বড় হয়েছিলেন আদিবাসী জনজীবনের সঙ্গে। যার কারণে খুব সহজেই পর্বতে আহরোণ, ঘোড়ায় চড়া, সাঁতার কাটা, নৌকা চালানো, জঙ্গলে শিকার করার মত সাধারণ গুণগুলো আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন।
তিনি নিজেকে কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন। মহারাণা প্রতাপ শৈশব থেকেই সাহসী এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
তিনি সাধারণ শিক্ষার চেয়ে খেলাধুলা, অস্ত্রশস্ত্র তৈরি এবং শিল্প শেখার প্রতি আগ্রহ বেশি ছিল। সম্পদের থেকে শ্রদ্ধা পছন্দ করতেন। তবে কখনও নিঃসঙ্গ ছিলেন না।
জঙ্গল এবং পাহাড় তাঁর চরিত্রকে মজবুত করে তুলেছিল। আর এভাবেই সকলের অলক্ষ্যে তিনি এক বড় যোদ্ধায় পরিণত হন।
তার পিতা উদয় সিং বিদেশী আক্রমণকারীদের থেকে নিজ রাজ্যকে রক্ষা করতে হিমশিম খেয়ে আসছিলেন।
তাই জোষ্ঠ পুত্র হবার কারণে উত্তরাধিকার হিসেবে রাজার মুকুট ও সিংহাসনের সাথে এক বিশাল দায়িত্ব এসে পরে মহারানা প্রতাপ সিং এর উপর।
১৫৭২ সালে উদয় মহারানা প্রতাপের পিতা উদয় সিং এর মৃত্যুর পরে রানী ধীর বাই তাঁর পুত্র জগমলকে তাঁর উত্তরসূরী করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন।
তবে রাজ্যের প্রবীণ ব্যাক্তিগণ ও রাজসভার সবাই উদয় সিংয়ের বড় ছেলে মহারানা প্রতাপ কেই পছন্দ করেছিলেন।
তাই উদয় সিংয়ের মৃত্যুর পর রাজকুমার মহারানা প্রতাপ সিসোড়িয়া রাজপুত বংশের ধর্মীয় রীতি মেনে মেওয়ারের ৫৪ তম শাসক হিসাবে হিসাবে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।
এই ঘটনায় অসন্তুষ্ট জগমাল প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মঘল সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আজমীরের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
সাহায্যের বিনিময়ে উপহার হিসাবে জাহাজপুর শহরকে জাগির হিসাবে পেয়েছিলেন।
মহারানা প্রতাপের সময় দিল্লিতে মুঘল সম্রাট আকবরের ইসলামিক শাসন ছিল তাই সর্বদা মোঘলদের আক্রমণের ভয় এবং রাজ্যের পাথুরে ভূমি পেয়েছিল রাজমুকুটের সাথে।
পারিবারিক ষড়যন্ত্র সহ বহুবিধ সমস্যার মুখে পরেন মহারানা। কিন্তু তাতে আশাহত হননি মহারানা প্রতাপ।
বিশ্বস্ত রাজ কর্মচারী ও সৈন্যদের নিয়ে তৈরি হয়েছিলেন যুদ্ধের জন্য।
চিতোর দূর্গের রাজ বংশের রাজাগণ বিশেষ করে মহারানা প্রতাপ ছিলেন বীর যোদ্ধা এবং প্রজা দরদি শাসক যাঁরা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে প্রাণ হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতো।
নিজ রাজ্যকে মাতৃভূমি মনে করে মায়ের মর্যাদা দিত। মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করত।
মহারানা প্রতাপ রাজকীয় গুণাবলীতে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। ঘোড়সওয়ারী, অস্ত্রচালনা ও যুদ্ধনীতি বিষয়গুলোতে একেবারে জীবনের প্রথম থেকেই শিক্ষা নিয়েছিলেন।
সেইসঙ্গে একই সাথে উদারতা ও নির্ভয়তার এক অনন্য গুণ তার মধ্যে লক্ষনীয় হয়ে ওঠে। রাজসভার কর্মকর্তা থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই তার যথেষ্ট প্রশংসা করত।
মহারানা প্রতাপ সিং ১৭ বছর বয়সে বিয়ে করেন বিজোলিয়ার সামন্ত বংশীয় আজাদবে পানওয়ারকে।
কিছু ইতিহাসবিদ দের মতে মহারানী আজাদব সহ আরও দশজন রানী ছিলেন। তার সন্তান দের মধ্যে ছিল ১৭ পুত্র ও ৫ কন্যা।
১৫৬৭ সালে মুঘল সম্রাট আকবর ৬০,০০০ সৈন্যের একটি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে চিতোরের দুর্গ অবরোধ করেন। তখন মহারানা প্রতাপের পরিবার নিজেদের ঐ দূর্গ ছেড়ে গোগুন্ডার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
এই দুর্গের বিশেষ গুণ, এটি ৫৯০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত। এর দেয়ালগুলো যথেষ্ট চওড়া।
আগেও অনেক বিদেশী আক্রমণকারী এই দুর্গ দখল করার ব্যার্থ চেষ্টা করেছিল। তবে আকবরের হাতে এর পতন হয়।
তিনবার যুদ্ধের মুখে পরে এই দূর্গ। শত্রু সেনাদের ভোগ্যপণ্য না হয়ে জীবন বলিদানের উদ্দেশ্যে বহু সংখ্যক নারী ( ঐতিহাসিক দের মতে প্রায় ৬০০০০) একসঙ্গে জলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেয়।
আর এই প্রথাকে জওহর বলে। তিনবার এই দূর্গের নারীগণ জওহর করেছিল।
রাজপুত নারীদের নিয়ম ছিল শেষ পথ হিসেবে এই আত্মহনন বেছে নেয়া।
ঐতিহাসিক মতে, চিতোর দুর্গে প্রথম জওহর হয় রানী পদ্মাবতীর সময় ও রানী কর্নাবতীর সময় হয় দ্বিতীয় বার এবং প্রতাপ সিং এর আমলে ঘটে তৃতীয় বার।
চিতোরের দূর্গ পতনের সময়। সেদিন ৬০,০০০ মোঘল সৈন্যের বিপরীতে দুর্গে ছিল মাত্র কয়েক হাজার রাজপুত সেনা!
এই কয়েক হাজার রাজপূত সেনা প্রাণপণ যুদ্ধ করেও দুর্গ বাঁচাতে ব্যর্থ হয়। বাধ্য হয়ে সম্ভ্রম বাঁচাতে ৫,০০০ নারী জ্বলন্ত আগুনে আত্নাহুতি দেন!
নিজ চোখে এই মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে ২৭ বছর বয়সী প্রতাপ সিং ভীষনভাবে মর্মাহত হন।
মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে তার পিতা উদয় সিং এর চলমান শত্রুতা তখন তার নিজের ও শত্রুতায় পরিণত হয়।
দেশকে মোঘলদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করাই হয় তার লক্ষ্য।
উদয় সিং চিতোর থেকে এসে উদয়পুরে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। ১৫৭২ সালে উদয় সিং মৃত্যুবরণ করেন।
তখন রাজ মুকুট পরেন মহারানা প্রতাপ সিং। পিতার মৃত্যু এবং পিতার জীবদ্দশায় আর চিতোর দেখতে পেলেন না, এই আক্ষেপ প্রতাপকে গভীরভাবে ব্যাথিত করত।
তবে এই পীড়াগ্রস্ত তিনি একাই ছিলেন না, স্বয়ং সম্রাট আকবর ও এই পীড়া অনুভব করত!
তখন ভারতের মেবার রাজ্য বিদেশী আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ এবং প্রতিঘাতে যে পরিমাণ শক্তি, সাহস, মনোবল আর স্বদেশ প্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তা আজও দেশপ্রেম, হিন্দুত্ববোধ এবং ইতিহাসকে গৌরবময় করে তুলেছে।
মুঘল সম্রাট আকবর চিতোর দখল করেছিলেন, কিন্তু সম্পূর্ণ মেবারের উপর তার আধিপত্য ছিল না।
যতদিন মেবারের জনসাধারণ মহারানা প্রতাপের প্রতি অনুগত ছিল, ততদিন পর্যন্ত সমগ্র হিন্দুস্তানের একক বাদশা হবার শখ পরিপূর্ণ করা আকবরের অসম্ভব ছিল।
বিদেশী লুটেরা মুঘলদের প্রতিরোধে রাজপুতগণ সর্বাত্মক শক্তি ও যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগ করেছিল।
রাজপুতদের সৎসাহস, মনোবল এবং বিশেষ যুদ্ধকৌশল মুঘলদের বার বার বিচলিত ও নাস্তানাবুদ করেছিল।
মুঘল সম্রাট আকবর বুঝেছিলেন যে রাজপুতগণ শত্রু হিসাবে প্রবল বিধ্বংসী, কিন্তু মিত্র হিসাবে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য।
তাই আকবর তার শাসনকালে রাজপুতদের সাথে সন্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন। কিছুটা যুদ্ধের মাধ্যমে এবং কিছুটা বিবাহ সূত্রে তিনি তারএই প্রচেষ্টা সফল করেছিলেন।
ভগবান দাস নামে অম্বরের এক রাজা মুঘল সম্রাট আকবরের রাজসভার একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন।
ভগবন দাসের পুত্র রাজা মানসিংহ আকবরের সেনাবাহিনীর একজন সেনাপতি ছিলেন।
রাজা টোডরম্ল ছিলেন আকবরের অর্থমন্ত্রী। আরেকজন রাজপুত বীরবল ছিলেন আকবরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
বেশীরভাগ রাজপুত রাজ্য যখন মুঘল সম্রাট আকবরের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল, তখন একমাত্র মেবারের রাজপুত রাজা মহারাণা উদয় সিংহ মুঘলদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
চিতোরের পতনের পর তিনি উদয়পুর থেকে মেবার শাসন করতেন।
উদয় সিংহের সুযোগ্য পুত্র মহারাণা প্রতাপ সিংহ সারা জীবন মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছিলেন। মুঘল সম্রাট আকবর তাঁর শাষনামলে একমাত্র মেবারের রাজপুতদের জয় করতে পারেননি।
ভাইদের প্রবল হিংসার মধ্যেও মহারাণা প্রতাপ তাঁদের সবসময় কল্যাণ করেছেন।
তাঁরা সম্রাট আকবরের সঙ্গে যোগসূত্র করে মহারাণা প্রতাপের বহু ক্ষতি করলেও মহারানা প্রতাপ তাঁদের কখনও ক্ষতি করেননি।
অবশেষে মহারানা প্রতাপের মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত ভাইদের মন পরিবর্তন হয় এবং তাঁরা মহারাণা প্রতাপের পক্ষ নিয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবস্থান করেন।
মহারানা প্রতাপ তাঁর রাজ্যে কৃষি কাজ ও জলের লাইন তৈরিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল।
কারণ ওই পাহাড়ি এলাকায় অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। মহারানা প্রতাপ নিজের ভবনকে সাহিত্য এবং শিল্পকলার এক অনবদ্য স্থান হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
মহারানা প্রতাপ দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পরেই মেওয়াড়ের সঙ্গে মোঘলদের যুদ্ধ হয়।
মোগল সম্রাট আকবর চেয়েছিলেন হলদিঘাটের নিয়ন্ত্রণ, গুজরাট পর্যন্ত সহজে ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধার জন্য।
কিন্তু কোনভাবেই মাতৃভূমি ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না মহারানা প্রতাপ।
মহারাণা প্রতাপ মুঘল সম্রাটের দাসত্ব কখনও মেনে নেননি আর সেই কারণেই আমেরের মানসিংহের সাথে রানা প্রতাপের বিচ্ছেদ হয়।
এর ফলে মানসিংহের প্ররোচনায় আকবর নিজেই মানসিংহ এবং সেলিমকে (জাহাঙ্গীর) সেনাপতি করে মেওয়ার আক্রমণ করার জন্য একটি বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
তার আগে মুঘল সম্রাট আকবর একাধিকবার প্রতাপের কাছে সন্ধির জন্য দূত পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু মহারানা প্রতাপ শুধু এমন চুক্তিতেই আগ্রহী ছিলেন যাতে মেবারের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব থাকে।
আকবরের দূত প্রতাপকে আধিপত্য স্বীকার করে নিতে অনুরোধ করে, তাহলে তাঁকে ভারতবর্ষের অর্ধেক দিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু মহারানা প্রতাপ সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। সম্পূর্ণ পৃথিবী দিলেও তিনি কারও সামনে মাথা নত করবেন না, এমনটাই জানান।
আকবরের পাঠানো সন্ধির দলের সর্বশেষ প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দেন আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপতি মান সিং। মান সিং নিজে রাজপুত ছিলেন।
একজন রাজপুত হয়েও রাজপুতদের উপর হেনস্তাকারী আকবরের পক্ষ গ্রহণ করাতে মান সিং এর উপর ক্রোধিত হন প্রতাপ সিং।
উল্লেখ্য, এই প্রতিনিধি দল ও ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়।
আর এই ব্যর্থতা, যুদ্ধ এবং শান্তির মধ্যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তখন আকবর বুঝতে পারেন সন্ধির পরিবর্তে যুদ্ধই এখন শ্রেয়!
এদিকে দুরদৃষ্টি সম্পন্ন মহারানা প্রতাপও বুঝে যায়, আগ্রাসী আকবরের পরবর্তী ভাষা অস্ত্র।
তাই রণকৌশল গ্রহণ করেন মহারানা প্রতাপ।
যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে প্রতাপ তার রাজধানী নিজ জন্মস্থান কুম্বলগড়ে সরিয়ে নেন এবং সাধারণ জনগণকে নির্দেশ দেন তাদের সবকিছু নিয়ে আরাবল্লি পর্বতের পেছনে অবস্থান করতে।
প্রতাপের পরিকল্পনা ছিল যুদ্ধ আরাবল্লির পাহাড়ি এলাকায় করার।
কারণ এ ধরণের ভূমিতে রাজপুতরা লড়াইতে অভ্যস্ত, কিন্তু বিদেশী লুটেরা মোঘলদের দল একেবারেই অনভ্যস্ত ছিল।
আর এ সুযোগটাই মহারানা প্রতাপ কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন।
তার সেনাবাহিনীর একটি অংশ সবসময় হলদিঘাটি গিরিপথের উপর নজর রাখতো। কারণ উত্তর দিক থেকে উদয়পুর প্রবেশের একমাত্র রাস্তা হলদিঘাটি।
মহারানা প্রতাপ উচ্চতায় প্রায় ৭ ফুট ৫ ইঞ্চি লম্বা ছিলেন। কম উচ্চতার জন্য আকবর কোনোদিনই প্রতাপের মুখোমুখি হোন নি।
মহারানা প্রতাপ শরীরে যে বর্ম ( যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রের আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য বিশেষ পোশাক / রক্ষা কবচ ) ধারণ করতেন, তার ওজন প্রায় ১১০ কেজি।
কিছু ঐতিহাসিক গ্রন্থে পাওয়া যায়, এই বর্মের ওজন ছিল ২০৮ কেজি। মহারাণা প্রতাপের যুদ্ধে ব্যাবহৃত তলোয়ার ছিল ২০ ও ২৫ কেজি ওজনের।
এই ওজনের দুটি তলোয়ার তিনি যুদ্ধে ব্যাবহার করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাবহার করা তাঁর বর্শার ওজন ছিল ৮০ কেজি।
তার পায়ের জুতার ওজন ছিল ১০ কেজি। রাজস্থানের উদয়পুরের একটি যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে মহারাণা প্রতাপের ব্যবহৃত অবাক করা এসব সামগ্রী!
ভারতীয় ইতিহাসে বিখ্যাত হলদিঘাটির যুদ্ধ। যদিও এই যুদ্ধ সম্পর্কে ইতিহাস গ্রন্থে খুব সামান্যই বর্ণনা পাওয়া যায়।
হলদিঘাটির যুদ্ধ
ঐতিহাসিক সুত্র অনুযায়ী হলদিঘাটির বিখ্যাত যুদ্ধ হয় ১৫৭৬ সালের ১৮ জুন মতান্তরে ২১ জুন।
প্রতিপক্ষ আকবরের সেনাপতি মান সিং এবং আমের আসফ খানের নেতৃত্বে ৮০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল সেনাবাহিনী।
এই বিশাল বাহিনীর বিপক্ষে মহারানা প্রতাপের সৈন্য ছিল মাত্র ২০,০০০ রাজপুত সেনা।
মতান্তরে, মুঘলদের সৈন্য ছিল দু লক্ষ, অন্যদিকে মহারানা প্রতাপের মাত্র ২২ হাজার সৈন্য।
গোয়ালিয়রের রাম শাহ তানওয়ার এবং তার তিন ছেলে ছিল ছিলেন মহারানা প্রতাপের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি।
এছাড়াও হাকিম খান শূরের নেতৃত্বাধীন আফগান সেনার একটি দল এবং ভিল আদিবাসী গোষ্ঠীর একটি তীরন্দাজ বাহিনী ছিল প্রতাপের নেতৃত্বে।
ইতিহাস বিখ্যাত হলদিঘাটের এই যুদ্ধে মহারাণা প্রতাপ গেরিলা যুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। প্রায় ছয় ঘণ্টার কিছু বেশি সময় ধরে চলে এই যুদ্ধ।
যুদ্ধের প্রথমদিকে মোঘল বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দেয় রাজপুত সেনাবাহিনী। প্রতাপ সিং লোনা ও রাম প্রসাদ নামক দুটি হাতি নামিয়ে দেন যুদ্ধের ময়দানে।
তীর ও গোলার আঘাতকে অগ্রাহ্য করে এরা মোঘল বাহিনীকে তছনছ করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।
শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে এক একটি ঘোড়াকে তুলে ছুঁড়ে ফেলে এরা মোঘল সৈন্যদের লাশের উপর দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত এদের মাহুত মোঘল সেনাদের হাতে নিহত হয়।
মহারানা প্রতাপ প্রবল বিক্রমে শত্রুদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
আকবরের এক সেনাপ্রধান বেলাল খানের ( কিছু ঐতিহাসিক দের মতে, বেহ লল খান নাম ছিল এবং এই ঘটনা দেওয়ারের যুদ্ধে ) মাথা তিনি তলোয়ারের আঘাতে দ্বিখন্ডিত করেন।
সীমিত সৈন্য নিয়ে প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করেন মহারানা প্রতাপ। হাতির পিঠে বসে যুদ্ধের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেছিল মান সিং।
বাম ও ডান অর্থাৎ উভয় দিকের সৈন্যদের ধ্বংস হতে দেখে মাঝের সৈন্যদলটি নিয়ে এগিয়ে যান তিনি। কিন্তু তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা মাত্রই ছুটে আসেন মহারানা প্রতাপ।
নিজের ঘোড়া চেতকের মাথায় হাতির মতো একটি নকল শুঁড় লাগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। ভয়ানক দেখতে এই ঘোড়াটি সরাসরি চালিয়ে সরাসরি মান সিং এর হাতির উপরে ঝাঁপ দিয়ে আক্রমণ করেন।
অনেকটা ঈগলের মত লাফিয়ে উঠেছিল চেতক। প্রতাপের বর্শার আঘাত থেকে অল্পের জন্যে বেঁচে যান মান সিং।
পরবর্তীতে চেতক নামক প্রতাপের এই ঘোড়াটি যুদ্ধে মারা যায়। ঐতিহাসিক মতে, মেওয়াড়ের সেনাপতি মান সিংয়ের অনুরোধে তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে যান।
তাই মহারানা প্রতাপকে বন্দি করতে পারেনি মোঘলরা। মোঘল সেনাবাহিনী যদিও পিছু ধাওয়া করে, তবুও ঘোড়া চেতকের কারণে প্রতাপকে ধরতে পারেনি।
চেতক মহারানা প্রতাপকে বহন করে প্রায় ২৭ ফুট দীর্ঘ নালা পার করেছিল, যে নালা যুক্ত পথ মুঘল সেনাবাহিনীর কোন অশ্বারোহী অতিক্রম করতে পারেনি।
তারপর চেতক প্রাণ ত্যাগ করে। মহারাণা প্রতাপ এই যুদ্ধে আহত হন।
পরাজিত হলেও সম্রাট আকবরের অধীনতা তিনি স্বীকার করে নেননি। প্রতাপ শেষ সময় পযর্ন্ত আকবরের সাথে চুক্তি না করে সম্মানের সাথে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন।
মহারানা প্রতাপ প্রিয় ঘোড়া চেতকের মাধ্যমে নিরাপদে পাহাড়ে ফিরে যান এবং আরও একটি মহাযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য নিজেকে তৈরি করতে থাকেন।
প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে মহারাণ প্রতাপের সাহসীতার প্রশংসা যতটা রয়েছে, ঠিক ততটাই প্রশংসা পাওয়া যায় তার ঘোড়া চেতকের।
চেতক বেশ কয়েক ফুট উঁচু একটি হাতির মাথা পযর্ন্ত লাফাতে পারত।
চেতকের সাহসিকতার যথেষ্ট প্রশংসা আছে হিন্দি কবি শ্যামনারায়ণ পান্ডয়ের বীর রস কবিতা চেতকের বীরত্বে।
মহারানা প্রতাপের প্রিয় হাতি রামপ্রসাদকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়, মুঘল সম্রাট আকবরের কাছে। কিন্তু সেখানে হাতি রামপ্রসাদ খাবার ত্যাগ করে দেহত্যাগ করে।
এই দৃশ্য দেখে সম্রাট আকবর বলেছিলেন, মহারানা প্রতাপ দূরদেশে অথচ তাঁর হাতিও মাথানত করল না।
এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষ মোঘলদের দশগুণ বেশি সেনা থাকার পরেও, সেই যুদ্ধে মহারানা প্রতাপের মাত্র ১২ হাজার সৈন্য নিহত হয়।
অপরদিকে মোঘলদের ৯০ হাজার সেনা নিহত হয়েছিল।
কিছু গ্রন্থে পাওয়া যায়, এই যুদ্ধে সম্রাট আকবর এবং মহারানা প্রতাপ এ দুজনের কেউ পরাজিত হননি।
মোঘলদের সেনাবাহিনী পর্যাপ্ত ছিল এবং মহারানা প্রতাপের কৌশমূলক যুদ্ধের পর্যাপ্ত শক্তি ছিল।
ঐতিহাসিক এই হলদিঘাটির যুদ্ধ মুঘলদের জন্য একটি নিরর্থক বিজয় ছিল, কারণ মুঘল সেনাবাহিনী উদয়পুরে মহারাণা প্রতাপ সিং অথবা তার পরিবারের কোনও সদস্যকে হত্যা করতে বা জীবিত ধরতে পারেনি।
স্কুল কলেজের ইতিহাস গ্রন্থে বলা হয়, হলদিঘাটের এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর।
কিন্তু এটা বাম ইতিহাসবিদ দের মত ব্যাতীত প্রকৃত ইতিহাসবিদ দের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
কিছু ঐতিহাসিক মতে, হলদিঘাটের যুদ্ধের সময় এক রাজপুত সেনার পরামর্শে মোগল বাহিনীকে এড়িয়ে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে জঙ্গল পরিবেষ্টিত পাহাড়ে ভীলদের মাঝে চলে যান মহারানা প্রতাপ।
সেখানে জীবন ধারণ করেন ফলমূল ও ঘাসের রুটি খেয়ে।
পরবর্তীতে ভীলদের সংগঠিত করে নতুন উদ্যমে পুনরায় ফিরে আসেন যুদ্ধে, মুঘল বিনাশের ডাক দিয়ে।
পরবর্তীতে নতুন এক যুদ্ধ কৌশল তৈরী করেন ছাপামার নামে।
হলদিঘাটের যুদ্ধের পরে আকবর আরও একাধিকবার মেবার দখলে নিতে বহু চেষ্টা করেন।
কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হন। এই সংঘাতময় সময়ের মধ্যেও প্রতাপ চিতোর পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকেন।
কিন্তু বিশাল মোঘল বাহিনীর প্রতিরোধে প্রতাপের বাহিনী এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।
পাশাপাশি সেনাবাহিনী পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকট হয়। এমন সংকটময় অবস্থায় ভামা শাহ এগিয়ে আসেন এবং মহারানা প্রতাপকে বহু পরিমাণ অর্থ দান করেন।
এই অর্থ দিয়ে মহারানা প্রতাপ ১২ বছর ধরে মেবারের ২৫০০০ সৈন্যের বাহিনীকে পরিচালনা করেন।
১৫৮৭ সালের পরে মূঘল সম্রাট আকবর উত্তর পশ্চিম ভারত ও পাঞ্জাবের দিকে দৃষ্টি দেন।
হলদিঘাঁটির যুদ্ধের পর ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাসে দিবের মতান্তরে দেওয়ারের যুদ্ধ হয়।
Battle of Dewair
শারদীয় দূর্গা পূজার বিজয়া দশমী ছিল সেদিন।
মা দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে মা ভবানীকে স্মরণ করে মহারানা প্রতাপ শুরু করেন মুঘলদের বিরুদ্ধে ভীষণ যুদ্ধ।
মহারানা প্রতাপের পুত্র অমর সিং মুঘল সেনাপতির উপর প্রচণ্ড শক্তির সাথে ভাল ( তৎকালীন সময় যুদ্ধে ব্যাবহৃত অস্ত্র )
নিক্ষেপ করেন।
এত শক্তি দিয়ে নিক্ষেপ করা হয়েছিল ভাল, যে ঘোড়া সহ সেনাপতি মাটিতে গেঁথে যায়।
মহারানা প্রতাপ এই দেওয়ারের যুদ্ধ বিশেষ রণকৌশলে তার সেনাবাহিনী নিয়ে মোঘলদের পরাজিত করার পর চিতোর বাদে মেওয়ারের বেশিরভাগ এলাকা পুনরায় দখল করেছিল।
মুঘল সম্রাট আকবর মহারাণা প্রতাপকে পরাজিত করার জন্য বহু রণকৌশল অবলম্বন করেছিল, কিন্তু মহারাণা প্রতাপ শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে গিয়েছিলেন।
কিন্তু চিতোর তিনি আর জয় করতে পারেননি। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি চিতোর পুনরুদ্ধারের আশা ত্যাগ করেননি এবং লড়াই থেকেও পিছপা হননি।
মুঘল সম্রাট আকবর তাকে পরাজিত করার জন্য বহু পরিকল্পনা অবলম্বন করেছিলেন, কিন্তু মহারানা প্রতাপকে পরাজিত করতে পারেননি।
শেষ পর্যন্ত অপরাজেয় থেকে যান প্রতাপ। অপরদিকে প্রতাপকে হারাতে না পারায় আকবরের মনে থেকে যায় গভীর আক্ষেপ!
মৃত্যু: আজ থেকে প্রায় ৪২৫ বছর আগে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৫৯৭ সালে এক শিকার অভিযানে গিয়ে সময় দুর্ঘটনায় আহত হন মহারানা প্রতাপ। এই দুর্ঘটনা পরবর্তীতে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২৯ জানুয়ারী, ১৫৯৭ মেবারের সিংহ নামে ভারতীয় ইতিহাসে বিখ্যাত, মহান বীর যোদ্ধা, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা বীরলোকে গমন করেন।
দূতের মাধ্যমে মহারানা প্রতাপের মৃত্যু সংবাদ পায় মুঘল সম্রাট আকবর।
কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, চরম শত্রু মহারানা প্রতাপের দেহত্যাগে সম্রাট আকবর আনন্দের সাথে অনেকটাই ব্যাথীত হয়েছিল।
অশ্রুজলে সম্রাট আকবর তাঁর শেষ শ্রদ্ধা জানান মহারানা প্রতাপকে।
কারণ মহারানা প্রতাপ তাঁর শৌর্য, বীরত্বের মাধ্যমে জীবন ও মৃত্যু জয় করেছিলেন। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পালিত পশুদের ও মন জয় করেছিল।
তবে, এই বর্ণনা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ! কেননা, সম্রাট আকবরের নির্মমতা ও আগ্রাসী ভূমিকার যথেষ্ট উদাহরণ রয়েছে।
তাই এগুলো বাম ইতিহাসবিদ দের গল্প ছাড়া আর কিছুই না!
যাইহোক, মহারানা প্রতাপ যুগে যুগে ভারতীয় ইতিহাসে মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের চিরন্তন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন তিনি।
নারীগণকে মহারাণা প্রতাপ যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন!
একবার আবদুল রহিম খান ই খানা নামে এক ব্যাক্তি আকবরের কর্মকর্তার সাথে মহারাণা প্রতাপের বিরুদ্ধে প্রচার করতেছিল।
তখন মহারাণার পুত্র অমর সিং রহিমের শিবিরের সমস্ত মহিলাকে বন্দী করে কারাগারে নিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে অমর সিং বন্দী অবস্থায় মহারানার সামনে এনেছিলেন।
মহারানা প্রতাপ তৎক্ষণাৎ তাঁর পুত্রকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সমস্ত মহিলাকে নিরাপদ ভাবে তাদের শিবিরে দিয়ে আসতে।
কারণ নারীগণ মহারানা প্রতাপের কাছে সব সময় শ্রদ্ধার পাত্র!
মেবারের মহারাণা প্রতাপ সিংহ। নামটা উচ্চারণের সঙ্গে পরিলক্ষিত হয় ভারতের বিশাল স্বদেশ প্রেমের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ভারত ভ্রমণে আসতে চাইলে, তাঁর মা তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন হলদিঘাটের মাটি আনতে।
অতএব, এটা স্পষ্ট যে, এই মাটি আব্রাহাম জননীর কাছেও পরম শ্রদ্ধার ছিল!
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বীর যোদ্ধা মহারানা প্রতাপ সিংহ সম্পর্কে বলেছেন-
তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ কর, ঐ যে দেখি বসুন্ধরা কাঁপল থরথর।
বাজল তূর্য আকাশ পথে, সূর্য আসেন অগ্নিরথে, আকাশপথে, এই প্রভাতে দখিন হাতে বিজয়খড়্গ ধর। ধর্ম তোমার সহায়, তোমার সহায় বিশ্ববাণী।
অমর বীর্য সহায় তোমার, সহায় বর্জ্রপাণি। দুর্গম পথ সগৌরবে, তোমার চরণচিহ্ন লবে, সগৌরবে। চিত্তে অভয় বর্ম, তোমার বক্ষে তাহাই পর।
অতএব, ভারতের মেবারের সিংহ মহারানা প্রতাপের নাম ইতিহাসে এক নক্ষত্র রুপে বিরাজমান!
দ্যা গ্রেট
যদি মুঘল সম্রাট আকবরের নামের সঙ্গে দ্য গ্রেট (মহান) শব্দ যুক্ত হয়, তাহলে মেবারের রাজা মহারাণা প্রতাপের সঙ্গে কেন এটা যুক্ত হবে না?
মহারাণা মেবার অঞ্চলে যে শৌর্য ও মহানুভবতার উদাহরণ রেখে গেছেন, সেটা কোন অংশে কম?
অতএব, এই প্রসঙ্গে সকল ইতিহাসবিদদের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধারের আহ্বান জানান প্রয়োজন।
প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই মহান হিন্দু বীর, মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষত্রিয় চূড়ামণি, শৌর্য ও মহানুভবতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মহারানা প্রতাপের নামের সঙ্গে দ্যা গ্রেট শব্দ যোগ করা উচিত!
অসাধারণ
ধন্যবাদ! মূল্যবান মতামত দিয়ে পাশে থাকবেন!
চমৎকার লেখনী।
ধন্যবাদ! পাশে থাকবেন!
Pingback: ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের শাসন এর ইতিহাস | Shivrupi
Pingback: প্রথম অস্ত্রোপচারের জনক মহর্ষি সুশ্রুত |
Pingback: রাজা প্রতাপাদিত্য | বাংলার শিবাজী | বাংলার বারোভুঁইয়া ও রাজা প্রতাপাদিত্য