বিজয়নগর সাম্রাজ্য | বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও শ্রেষ্ঠ শাসক
দক্ষিণ ভারতের দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলে অবস্থিত বিজয়নগর সাম্রাজ্য, যাকে কর্ণাট রাজ্যও বলা হয়। 1336 সালে সঙ্গমা রাজবংশের দুই ভাই হরিহর এবং বুক্কা রায় প্রতিষ্ঠা করেন।
এই সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয়েছে রাজধানী শহর বিজয়নগরের নামে। দক্ষিণ ভারতে মুসলিম আক্রমণ প্রতিরোধ করতে মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা সুলতানি যুগের ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
বিজয়নগর সাম্রাজ্য প্রায় তিনশো বছর ধরে বিদেশী মুসলমানদের আক্রমণ থেকে দক্ষিণ ভারতকে রক্ষা করে।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সুদক্ষ শাসকগণ শাসনব্যবস্থাকে সামরিক প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে এক শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা তৈরী করেন।
পিতা সঙ্গমার নামানুসারে এই রাজবংশ সঙ্গমবংশ নামে পরিচিত পেয়েছে।
হরিহর ও বুব্ধ ব্যাতীত সঙ্গমের অপর তিন পুত্র কম্প, মুরপ্পা ও মুদল্লা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে অংশ গ্রহণ করতেন।
সঙ্গমবংশের শাসন শুরু করেন রাজা হরিহর ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে।
তবে কয়েকটি গ্রন্থে পাওয়া যায়, হরিহর এবং বুদ্ধ রাজা উপাধি গ্রহণ করেননি।
প্রতিবেশী দুই শক্তিশালী রাজ্য মহীশূরের হোয়সল রাজা এবং মাদুরাই এর সুলতানি রাজ্যের ঈর্ষা থেকেই থেকে নিজ স্বাধীন রাজ্য তৈরির প্রচেষ্টা হিসাবে শক্তিসংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁরা রাজকীয় উপাধি গ্রহণে দ্বিধান্বিত ছিলেন।
তাদের মধ্যে সাহস, প্রচেষ্টা এবং ইচ্ছা শক্তি পর্যাপ্ত ছিল।
হরিহরের এটা জানা ছিল যে, অবিরত যুদ্ধের দ্বারাই তাঁকে নিজ রাজ্য রক্ষা ও বিস্তার করতে হবে।
সুযোগ ও সাফল্যের জন্য ধৈর্যধারণ, প্রচেষ্টা ও অধ্যাবসায়ের মত মহৎ গুণ তাঁর ছিল। তখনকার সময় মাদুরার সুলতান ছিল উচ্চাভিলাষী ও স্বেচ্ছাচারি।
তিনি এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হোয়সলরাজের তৃতীয় বীরবল্লালকে পরাজিত ও হত্যা করেন।
তারপর হরিহর ও বুব্ধ ধ্বংসপ্রাপ্ত হোয়সল রাজ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে উদ্যোগী হন।
ফলে মাদুরার সাথে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের যুদ্ধ শুরু হয়।
সঙ্গমার পুত্রগণ বীরত্বের সাথে মাদুরার আক্রমণ প্রতিহত করে ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র হোয়সল রাজ্যকে বিজয়নগরের অর্ন্তভুক্ত করেন।
জয় করা অঞ্চলের শাষন ক্ষমতা সঙ্গমের পুত্রগণ ও নিকট আত্মীয়দের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
হরিহরের হাতে থাকে হোয়সল রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিম অংশ। বুব্ধ পায় পূর্ব ও মধ্যভাগের দায়িত্ব।
কম্প পায় উদয়গিরির দায়িত্ব এবং উত্তর কানাড়া অঞ্চলের শাষনভার পায় মুরপ্পা।
মহীশূরের দক্ষিণ পশ্চিম অংশের শাসনভার পায় মুদগ্ধা।
অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র এই বল্টন ব্যবস্থাকে সমবায় লোকায়ততন্ত্র ধরনের শাসন বলে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণে কৃষ্ণা ও কাবেরী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল ও পূর্ব পশ্চিম দুই সমুদ্রের মধ্যবর্তী অঞ্চল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
মহামতি ফেরিস্তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, হরিহর পরাজিত হন বাহমনী রাজ্যের হাতে এবং তাঁর রাজ্যের কিছু অঞ্চল সুলতান বাহমন শাহকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
হরিহরের মৃত্যুর পর ১৩৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের সিংহাসনে বসেন বুব্ধ। তিনি ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজ্য পরিচালনা করেন।
বুক্কর প্রধান সাফল, প্রবিবেশী শত্রু রাজ্য মাদুরার বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সফল অভিযান চালিয়ে ওই রাজ্যের শক্তি নাশ করা।
যতটুকু জানা যায়, বুব্ধুর মৃত্যুর বছরে সম্পূর্ণ মাদুরা রাজ্য বিজয়নগরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
দক্ষিণে রামেশ্বরম্ পর্যন্ত তিনি রাজ্য বর্ধিত করতে সক্ষম হন।
একটি প্রাচীন লিপিতে তিনি নিজেকে পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণ সমুদ্রের অধিপতি বলে উল্লেখ করেছেন।
বুব্ধুর সময়কালে বাহমনী রাজ্যের সাথে বিজয়নগরের দীর্ঘ যুদ্ধের সূচনা হয়। রাজ্যের উত্তরদিকে মুসলিম শাসিত বাহমনী রাজ্য বিজয়নগরের সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।
১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক আফগান সৈনিক আলাউদ্দিন হাসান শাহ
বাহমনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে, বাহমান শাহ উপাধি গ্রহণ করেন।
তাই এই রাজ্য বাহমনী রাজ্য নামে পরিচিতি পায়।
মুসলিম শাসিত বাহমনী রাজ্যের সাথে হিন্দু শাসিত বিজয়নগর রাজ্যের সংঘাত ভারতবর্ষের ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি ছিল।
ভারতবর্ষের সনাতনীদের কেনো এই অধপতন?
স্বাভাবিকভাবেই এটা বলা যায় যে, হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের ধারক হিসেবে বিজয়নগর রাজ্য মুসলমান শাসিত বাহমনী রাজ্যের পতনের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল।
অপরদিকে বাহমনী রাজ্যের শাসকদের হিন্দুবিদ্বেষ মনোভাব অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা ছিল না।
কিন্তু ঐতিহাসিক মতে, শুধুমাত্র ধর্মীয় বিদ্বেষের জন্য এই দুটি রাজ্যের দীর্ঘদিনের সংঘাতের মূল কারণ ছিল না।
আপাতদৃষ্টিতে এই সংঘর্ষের লক্ষ্য ছিল দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক প্রাধান্য পাওয়া।
তবে সেই লক্ষ্য অর্থনৈতিক প্রয়োজনবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল।
তুঙ্গভদ্রা দোয়াব, কৃষ্ণা গোদাবরী বদ্বীপ ও মারাঠা রাজ্য এই তিনটি এলাকায় রাজত্ব স্থাপনের সাথে অর্থনৈতিক লাভক্ষতি জড়িত ছিল।
১ কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রা নদীর মধ্যবর্তী এলাকা তুঙ্গভদ্রা দোয়াব বা রায়চুর দোয়াব নামে পরিচিত ছিল।
প্রাচীনকাল থেকেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এই এলাকা নির্দিষ্ট করে দক্ষিণী রাজ্যগুলির মধ্যে যুদ্ধ হত।
ইতিহাসবিদ দের মতে, প্রাচীনকালে পশ্চিমি চালুক্য ও চোলদের মধ্যে এবং পরে যাদব ও হোয়সলদের মধ্যে এই ধরনের দীর্ঘ যুদ্ধ হয়েছিল।
মধ্যযুগে সেই সংঘাতের কারণ লক্ষ্য করা যায় বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের মধ্যে।
২ কৃষ্ণা গোদাবরী উপকূল এলাকার ভূমি অত্যন্ত উর্বর ও বাণিজ্যসমৃদ্ধ ছিল।
ঐ অঞ্চলে একাধিক সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর থাকার কারণে প্রচুর পণ্য আমদানি রফতানি হত। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসাবে এই অঞ্চলটির অনেক সুনাম ছিল।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই সমৃদ্ধ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে দক্ষিণ ভারতের এ দুটি বড় শক্তির মধ্যে সংঘাত অনিবার্য ছিল।
৩ কোঙ্কন ও পাশের অঞ্চল বিজয়নগর দখল ছিল এই যুদ্ধের ৩য় কারণ। পশ্চিমঘাট পর্বত ও সমুদ্রের মধ্যবর্তী কোম্বন এলাকা ছিল এই অঞ্চলের মধ্যে।
ঐসময় ভারতে ভালোজাতের ঘোড়ার জন্য ভারতীয় শাসকদের নির্ভর করতে হত মধ্য এশিয়ার ব্যবসায়ীদের ওপর।
গোয়া বন্দর মাধ্যমে ঘোড়া আমদানি সহজ ছিল।
তাই এই এলাকা সামরিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই প্রধানত এই তিনটি কারণে বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্য ঐ অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপনের লক্ষ্যে দীর্ঘ সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিল।
এই যুদ্ধে বহু প্রাণহানি হয় এবং বহু ধনসম্পদ ধ্বংস হয়।
তবে বিজয়নগরের রাজা বেসামরিক প্রাণহানি এড়িয়ে আক্রমণ করলেও, বাহমনী রাজ সবসময়ই করুণ আক্রমণ করত।
গ্রাম ও নগর দখল ও অগ্নিসংযোগ করত এবং স্ত্রী, পুরুষ ও শিশুদের বন্দি করে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করত।
১৩৬৭ খ্রিঃ বিজয়নগরের রাজ বুব্ধ রায়চুর দোয়াবে মুদগল দুর্গ আক্রমণ করলে এই যুদ্ধ দীর্ঘ সংঘাতের রুপ নেয়।
এই আক্রমণের জবাবে বাহমনী রাজ্যের সুলতান এক লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করার শপথ নিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন।
তিনি মুদগল দুর্গ উদ্ধার করেন এবং তুঙ্গভদ্রা অতিক্রম করে বিজয়নগর রাজ্যে প্রবেশ করেন।
এই যুদ্ধে উভয়পক্ষই প্রথমবারের মত কামান ব্যবহার করে।
তুলনামূলকভাবে রাজ্যের অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ সেনাবাহিনী বেশি দক্ষতার পরিচয় দেয়।
দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধের পরেও কেউ পরাজিত হয় না।
শেষে রণক্লান্ত উভয়পক্ষই সন্ধিস্থাপন করে।
সন্ধির শর্তমতে উভয়পক্ষ যুদ্ধপূর্ব অবস্থায় ফিরে যায় এবং দোয়াব অঞ্চল উভয়ের মধ্যে ভাগ হয়।
উভয় রাজাই যুদ্ধে নিষ্ঠুরতা পরিত্যাগ করার পক্ষে মতপ্রকাশ করে। সেইসঙ্গে এটাও নির্দিষ্ট হয়, ভবিষ্যৎ যুদ্ধে কোন বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করা হবে না।
ড. সতীশ চন্দ্র লিখেছেন, কখনো কখনো শর্ত ভঙ্গ হলেও এই সন্ধি দক্ষিণ ভারতের যুদ্ধবিগ্রহের মানবিকতা বোধকে জাগ্রত করতে সাহায্য করেছিল।
বুব্ধ রামেশ্বরম্ পর্যন্ত তাঁর রাজত্ব বর্ধিত করেছিল।
শাসক হিসেবেও তিনি অনেক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আঞ্চলিক শাসকদের ওপর তিনি কেন্দ্রের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আরোপে সক্ষম ছিলেন।
ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। তাঁর সময়ে বেদের নতুন ভাষ্য রচিত হয়।
তেলেগু ভাষার উন্নয়নে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। তেলেগু কবি নাচনা সোমা তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিলেন।
১৩৭৭সালে বুব্ধের মৃত্যুর পর সিংহাসন আহোরণ করেন তাঁর পুত্র দ্বিতীয় হরিহর।
তিনিই সর্বপ্রথম মহারাজাধিরাজ এবং রাজা পরমেশ্বর উপাধি গ্রহণ করেন।
বীর যোদ্ধা দ্বিতীয় হরিহর মাদুরাই দখল করে পূর্ব উপকূলের দিকে রাজ্যবিস্তারে নজর দেন।
ঐ অঞ্চলে কয়েকটি হিন্দু রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল।
এদের মধ্যে উচ্চ বদ্বীপ অঞ্চলে রেড্ডিরা এবং কৃষ্ণা গোদাবরী নিম্ন বদ্বীপ অঞ্চলে বরঙ্গল রাজ্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই পূর্ব উপকূলের দিকে উড়িষ্যা রাজ্য এবং বাহমনী রাজ্যের কর্তৃত্ব বিস্তারের ইচ্ছা ছিল।
বরঙ্গল রাজ্যের সাথে বাহমনী সুলতানের সন্ধি স্থাপনের ফলে হরিহরের সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি।
বরঙ্গল বাহমনী রাজ্যদ্বয় ৫০ বছরের কিছু বেশি সময় স্থায়ী ছিল। এরপরও দ্বিতীয় হরিহর বিজয়নগরের মর্যাদা ও প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হন।
তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল, তিনি বাহমনী সুলতানের কাছ থেকে পশ্চিমে বেলগাঁও এবং গোয়া দখল করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
গোয়া দখল করার ফলে বিজয়নগরের আর্থিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
যতটুকু জানা যায় তিনি, সিংহলের বিরুদ্ধেও তিনি একটি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
you may also like….
১৪০৬ খ্রিঃ দ্বিতীয় হরিহরের মৃত্যুর পর তাঁর সন্তান দের মধ্যে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিরোধ সৃষ্টি হয়।
প্রথমে বিরূপাক্ষ সিংহাসন দখল করেন। কিন্তু তার কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে সিংহাসন ভ্রস্ট করে ক্ষমতা দখল করেন দ্বিতীয় বুব্ধ।
১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দেই তাকেও অপসৃত করে স্থায়ীভাবে সিংহাসন দখল করেন প্রথম দেবরায়।
তাঁর শাষনামলে পুনরায় বাহমনী রাজ্যের সাথে সংঘাত হয়।
বাহমনী সুলতান ফিরোজ শাহ দেবরায়কে পরাজিত করে দশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা, বহু মুক্তা, হাতী সহকারে বিজয়নগর রাজকন্যার সাথে বাহমনী সুলতানের বিবাহ দিতে বাধ্য করেন।
এই বিবাহ উপলক্ষ্যে তিন দিন ধরে উৎসব চলে। তবে এই বৈবাহিক সম্পর্কও উভয় রাজ্যের মধ্যে স্থায়ী রাজনৈতিক মৈত্রী রক্ষা করতে ব্যার্থ হয়।
তার কিছুদিনের মধ্যেই দেবরায় বরঙ্গল রাজ্যের সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। তাঁদের উভয়ের লক্ষ্য ছিল রেড্ডি রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া।
বাহমনী মৈত্রীজোট থেকে বরঙ্গলের বেরিয়ে আসার ফলে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক শক্তির পরিবর্তন ঘটে।
দেবরায় বাহমনী সুলতান ফিরোজ শাহকে পরাজিত করে কৃষ্ণানদীর তীর পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ড নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।
১৪২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম দেবরায়ের পরে মাত্র কয়েক মাসের জন্য সিংহাসনে বসেছিলেন বিজয়রায়।
তারপর শুরু হয় সঙ্গমবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা দ্বিতীয় দেবরায় এর শাসন এবং সেটা ১৪৪৬ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত স্থায়ী হয়।
দ্বিতীয় দেব রায় শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিলেন।
তিনি বিদ্রোহী সামন্তদের এবং কালিকটের জামোরিন এবং দক্ষিণে কুইলনকে দমন করেন।
তিনি শ্রীলঙ্কা আক্রমণ করেন এবং পেগু এবং তানাসেরিমে বার্মার রাজাদের অধিপতি হন।
১৪৩৬ সালের মধ্যে কোন্ডাভিডুর বিদ্রোহী প্রধান এবং ভেলামা শাসকদের সফলভাবে মোকাবেলা করেন এবং বিজয়নগরের আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য করেন।
কয়েক বছরের শান্তির পর ১৪৪৩ সালে বাহমানি সালতানাতের সাথে কিছু সাফল্য এবং কয়েকটি বিপরীতমুখী যুদ্ধ হয়।
পারস্যের দর্শনার্থী ফিরিশতা দ্বিতীয় দেব রায়ের যুদ্ধের কারণ হিসাবে বলেছেন,
মুসলিম তীরন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে তার সৈন্যবাহিনীকে সংঘাতের কারণ হিসেবে গড়ে তোলা।
সমসাময়িক পারস্যের রাষ্ট্রদূত আব্দুর রাজ্জাক,
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের কারণে সৃষ্ট বিভ্রান্তিকে পুঁজি করে বাহমানি সুলতানকে যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছেন, যার মধ্যে তার ভাইয়ের মাধ্যমে দেবরায়কে হত্যার চেষ্টা ও ছিল।
তাঁর শাসনামলে ও বাহমনী রাজ্যের সাথে সংঘাত অব্যাহত ছিল।
অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এই দ্বিতীয় দেবরায় বুঝতে পারেন,
সুদক্ষ তিরন্দাজ বাহিনী দেশের সেনাবাহিনীর সামরিক শক্তির অন্যতম প্রধান উপাদান।
ফেরিস্তা লিখেছেন, বিজয়নগর সেনাবাহিনীকে তিরন্দাজিতে অত্যন্ত দক্ষ করে তোলার জন্য দ্বিতীয় দেবরায় জায়গির দিয়ে ২০০০ মুসলিম প্রশিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন।
তবে ড. সতীশ চন্দ্রের মতে, পূর্বেই বিজয়নগরের সেনাবাহিনীতে বহু মুসলমান সৈন্য নিয়োজিত ছিল, যাদের মধ্যে দক্ষ তিরন্দাজ ও ছিল।
যাইহোক, সামরিক বহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করার পর তিনি রাজ্যজয়ে নজর দেন। এই লক্ষে দ্বিতীয় দেবরায় বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করেন।
১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাহমনী রাজ্যের অর্ন্তগত মুদগল, বাঁকাপুর সহ কিছু এলাকা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। দু রাজ্যের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
কিন্তু কোনোপক্ষই বিজয়ী না হওয়ায় পূর্বের অবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
ভারতবর্ষে ভ্রমণ করা পুর্তগীজ নুনিজ এর লেখা থেকে জানা যায়:
কুইলন, শ্রীলঙ্কা, পুলিকট, পেগু ( বর্তমানে মিয়ানমার )
ও তেনাসেরিম (মালয়) সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য দ্বিতীয় দেবরায়কে কর দিত।
তবে এসব রাজ্য বিজয়নগরের করদ রাজ্য ছিল বলে মনে হয় না।
ড. সতীশ চন্দ্রের মতে,
বিজয়নগর রাজ্যের নৌ বাহিনী এত বেশি দক্ষ ছিল না যে,
পেগু বা তেনাসেরিম এর মতো উপকূলবর্তী রাজ্য থেকে নিয়মিত কর আদায় করতে সক্ষম হত।
খুব সম্ভবত মৈত্রীর নিদর্শন হিসেবে তাঁরা বিজয়নগরে উপহার পাঠাতেন।
তবে সিংহলের বিরুদ্ধে বিজয়নগর রাজ্য কয়েকবার সফল অভিযান করে এবং জয় অর্জন করার ফলে,
সেখান থেকে বিজয়নগর রাজ্য নিয়মিত কর লাভ করত।
১৪৪৬ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় দেবরায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মল্লিকার্জুন বিজয়নগরের শাসনভার গ্রহণ করেন।
তাঁর সুদীর্ঘ ১৯ বছরের শাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল বাহমনী ও উড়িষ্যা রাজ্যদ্বয়ের মিলিত আক্রমণ।
অবশ্য মল্লিকার্জুন এই আক্রমণ প্রতিহত করে নিজ রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখেন।
এই সফলতায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখান চন্দ্রগিরির সালুভবংশীয় জনৈক সেনানায়ক নরসীমা।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই বিজয়নগর রাজ্যে নরসীমার প্রভাব ও মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পায়।
১৪৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মল্লিকার্জুনের পরে বিজয়নগরের সিংহাসনের বসেন তাঁর ভাই দ্বিতীয় বিরূপাক্ষ।
প্রায় দুই দশক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও, শাসক হিসেবে তিনি অদক্ষ ছিলেন।
ফলে সমগ্র রাজ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। বহু সামন্ত (রাজ কর্মচারী) তাঁর কর্তৃত্ব অস্বীকার করে স্বাধীন আচরণ করতে থাকেন।
উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যেও লোভ ও শোষণ প্রবণতা দেখা দেয়। প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা বাড়তে থাকে।
এই সুযোগে উড়িষ্যার রাজা পুরুষোত্তম গজপতি দক্ষিণদিকে তিরুভেন্নামেলাই পর্যন্ত ভূখণ্ড দখল করে নেন।
১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে ১ মাসে ৫০ লক্ষ হিন্দু বিতাড়নের নৃশংস ইতিহাস
বাহমনী রাজাও বিজয়নগরের ভূখণ্ড দখল করতে উদ্যত হন।
এই সময় চরম বিশৃঙ্খলা ও ভাঙনের মুহূর্তে সেনানায়ক নরসীমা রাজা দ্বিতীয় বিরূপাক্ষকে সিংহাসনচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন।
অবসান ঘটে সঙ্গমবংশের শাষন ও শুরু হয় সালুভবংশের শাসন।
সালুভবংশ :
১৪৮৬-১৫০৩ খ্রিষ্টাব্দ পযর্ন্ত সালুভবংশীয় শাসন ছিল।
প্রতিষ্ঠাতা রাজা নরসীমা হাত ধরে সতেরো বছর বছর পযর্ন্ত সালুভবংশের শাসনামল ছিল।
রাজ্যের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা তিনি কঠোর হাতে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে উড়িষ্যা ও বাহমনী রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ থেকে উদয়গিরি ও রাইচুর দোয়াব অঞ্চল তিনি পুনরায় অধিকার করতে ব্যর্থ হন।
তাঁর পুত্র ইম্মাদি নরসিংহের আমলে জনৈক সেনাপতি নরসনায়ক রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা হস্তগত করেন।
সিংহাসনে না বসলেও তিনিই ছিলেন প্রকৃত শাসক। নরসনায়কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বীর নরসিংহ পিতার ক্ষমতার অধিকারী হন।
তবে তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তাই ইম্মাদীকে অপসৃত করে তিনি নিজেকেই বিজয়নগরের রাজা বলে ঘোষণা করেন।
বিজয়নগর রাজ্যের দ্বিতীয় সামরিক অভ্যুত্থান ছিল এটা। ফলে সালুভবংশের শাসনের সমাপ্তি ঘটে এবং তুলভবংশের শাসনপর্বের সূচনা হয়।
তুলভবংশ :
বীর নরসিংহ অনেকটাই দক্ষ শাসকের মত ১৫০৫ – ১৫০৯ খ্রিঃ পযর্ন্ত তুলববংশ শাসন করেন।
কিন্তু তাঁর শাসনামলে রাজ্যে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও মুসলমানদের দ্বারা আক্রমণ বেশ সংকটপূর্ণ ছিল।
নরসিংহ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিদ্রোহী রাজ কর্মচারীদের দমন করেন।
এই সময় বাহমনী রাজ্য ভেঙে বিজাপুর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়।
বিজাপুরের শাসক ইউসুফ আদিল শাহ রায়চুর দোয়াব অঞ্চল দখল করতে উদ্যত হলে বিজয়নগরের রাজার সাথে সংঘর্ষ হয়।
এই যুদ্ধে বাহমনী সুলতান মামুদ শাহের প্ররোচনায় মুসলমানগণ বিজয়নগরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন।
বিজাপুর সুলতান রায়চুর ও মুদ্গল দুর্গ দখল করেন।
তবে বিজাপুর সুলতান বিজয়নগর রাজ্যের অভ্যন্তরে ক্ষমতাবিস্তারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
এসময় বীর নরসিংহ আরভিডু অঞ্চলের শাসক রাম রায় ও তাঁর পুত্র তিম্মার সাহায্য নিয়ে অনেক উপকৃত হন।
যুদ্ধ ব্যস্ততার মধ্যেও বীর নরসিংহ সামরিক বাহিনীর সংস্কার করেন।
তিনি এক চুক্তির মাধ্যমে পোর্তুগাল গভর্নর আলমিদারের আমদানিকৃত সব ঘোড়া কেনার ব্যবস্থা করেন।
যার কারণে বিজয়নগরের অশ্বারোহী বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়।
প্রজাদের উন্নতির জন্য তিনি কৃষি ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সংস্কার করেন।
লেখায় এবং বিজয়নগরের আধুনিক প্রত্নতাত্বিক খননে উদ্ধার হওয়া লিপিগ্রাফি এই বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য প্রদান করে।
বিজয়নগর বিভিন্ন সময়ে পায়েজ, নুনিজ, বারবােসা, নিকোলাে কন্টি, ডোমিঙ্গো পেস , ফার্নাও নুনেস, সহ অনেক বিদেশি পর্যটক (বেশিরভাগ মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় ভ্রমণকারীগণ) ভ্রমণে আসেন।
তাঁদের বিবরণে তৎকালীন বিজয়নগরের সাংস্কৃতিক জনজীবন সম্পর্কে যে আলােচনা করেছেন তা থেকে জানা যায়-
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সমাজে ব্রাহ্মণ প্রাধান্য :
বিজয়নগর সাম্রাজ্যে চতুবর্ণ প্রথা অনেক শক্তিশালী ছিল। ব্রাহ্মণরা সমাজে সর্বোচ্চ সন্মান পেতেন।
সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় জীবনে তাঁদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
বেদের বিখ্যাত টীকাকার সায়ন দ্বিতীয় হরিহরের মন্ত্রী ছিলেন।
ব্রাহ্মণরা নিরামিষভোজী হলেও সাধারণ মানুষ আমিষ আহার করত।
সমাজে গোমাংস নিষিদ্ধ ছিল। সমাজে সমস্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অবাধ আন্তরিকতা ছিল।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ছিল কৃষি ও বাণিজ্যভিত্তিক। ফলে ব্রাহ্মণ ও ভূস্বামীদের বিশেষ প্রাধান্য ছিল।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের নারীর মর্যাদা :
মধ্যযুগীয় শাসনামলে অন্যান্য স্থানের তুলনায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের নারীরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতেন।
সমাজ, রাজনীতি, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারে নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করত।
তাঁরা কারুশিল্প, চারুশিল্প, নৃত্য, সংগীত, সাহিত্য, কলাবিদ্যা ও শাস্ত্রচর্চা করতেন।
মল্লক্রীড়া ও তলোয়ার চালাতে তাঁরা পারদর্শিনী ছিলেন।
পর্তুগিজ নুনিজ লিখেছেন-
এখানে কোনো কোনো নারী প্রহরী, জ্যোতিষ ও হিসাবরক্ষকের কাজ করতেন।
গঙ্গাদেবী, হোনাম্মা ও তিরুমালাম্মা ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত কবি।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ভাষার উন্নতি:
ভারতে সুলতানি শাসনামলে বিজয়নগর সাম্রাজ্য,
হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিল।
সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ভাষা নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। জ্যোর্তিবিদ্যা, কথাসাহিত্যে ও যথেষ্ট উন্নতি হয়।
দক্ষিণ ভারতে সেই সময় রাজকীয় পৃষ্ঠপােষকতায় সংস্কৃত ভাষা নবজীবন লাভ করেছিল।
এর পাশাপাশি তামিল, তেলেগু, কন্নড় সহ আলিক ভাষাও সেই সময় সমৃদ্ধ লাভ করে।
তেলুগু কবি শ্রীনাথ ও পােদন, রাজা দ্বিতীয় দোয়ের সভাসদ কন্নড় কবি কুমারব্যাস সহ কয়েকজন ছাড়াও রাজা কৃয়দেব রায় স্বয়ং সংস্কৃত ও তেলেগু ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন।
এতে বোঝা যায়, বিজয়নগরের রাজারা সাহিত্যের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগী ছিলেন।
বেদের বিখ্যাত টীকা রচিতগণের মধ্যে মাধবাচার্য ও সায়নাচার্য বিজয়নগরের রাজাদের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেন।
সায়নাচার্যের ভাই মাধববিদ্যারণ্য ও একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন।
বিখ্যাত তেলুগু কবি শ্রীনাথ ও কন্নড় কবি কুমারব্যাস দ্বিতীয় দেবরায়ের রাজসভায় সভাকবি ছিলেন।
রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের শাসনামলে দক্ষিণ ভারতের সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল।
রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের ( মতান্তরে কৃয়দেব) ২১ বছরের রাজত্বকাল ছিল বিজয়নগরের একটি গৌরবময় অধ্যায়।
তিনি বহু পণ্ডিতকে ভূমি ও অর্থ দান করেন।
তাঁর রাজসভায় অষ্টদিজ নামে আটজন বিখ্যাত পণ্ডিত দের সমাবেশ হয়েছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন তেলুগু কবি পােদ্দন।
তিনি অন্ত্র কবিতার পিতামহ নামে পরিচিত।
কৃষ্ণদেব রায় নিজেও একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ও সাহিত্যিক ছিলেন।
সংস্কৃত ভাষায় তিনি পাঁচটি গ্রন্থ রচনা করেন।
বিখ্যাত সংস্কৃত নাটক জাম্ববতী কল্যাণম্ তাঁর রচিত।
এ ছাড়া রাষ্ট্রদর্শনের ওপর কৃয়দেব রায় রচিত আমুক্ত মাল্যদা তেলুগু সাহিত্যের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য:
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের বহু অগ্রগতি হয়েছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যে।
অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের নাগরিকদের জীবনে স্থাপত্যের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল।
নগরীর নির্মাণ কৌশল ছিল অপরূপ। নগরীর চারদিক প্রাচীর, উদ্যান ও মন্দিরে সুসজ্জিত ছিল।
কৃষ্ণদেব রায়ের শাসনামলে নির্মিত হাজারা রামস্বামী মন্দির হিন্দু স্থাপত্যশিল্পের একটি বিস্ময়কর নিদর্শন।
এ ছাড়াও বিঠস্বামী মন্দির, কৃয়স্বামী মন্দির এই সময়ের উল্লেখযােগ্য স্থাপত্য শিল্প নিদর্শন।
শিল্প সমালােচক ফার্গুসনের মতে, বিঠমী মন্দির দ্রাবিড় শিল্পরীতির অপূর্ব নিদর্শন।
পায়েজ বলেছেন, বিজয়নগরের রাজপ্রাসাদ লিসবানের রাজপ্রাসাদের থেকেও বৃহৎ ছিল।
দক্ষিণ ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্মৃতিস্তম্ভ, যার মধ্যে হাম্পির গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের বিভিন্ন মন্দির ও স্থাপত্য নির্মাণ বিজয়নগর স্থাপত্য শৈলীতে একীভূত হয়েছে।
এই বিস্ময়কর স্থাপনা গুলো হিন্দু মন্দির নির্মাণে স্থাপত্য উদ্ভাবনকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের চিত্রকলা ও সংগীত চর্চা:
চিত্রশিল্প ও সংগীত চর্চায়বিজয়নগর সাম্রাজ্যের যথেষ্ট উন্নতি লক্ষ্যণীয়।
শিল্প গবেষক এস. কে. সরস্বতী বলেছেন, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের চিত্রশিল্প ও স্থাপত্যশিল্পে, অলংকরণের উৎকর্ষ লক্ষনীয়।
রাজা কৃষ্ণদেব রায় এবং রাম রায় ছিলেন খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ।
তৎকালীন সময়ে সংগীত বিষয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।
বিজয়নগরের নাট্যশালা ও গড়ে উঠেছিল।
প্রজাদের আনন্দ ও বিনোদনের জন্য অভিনয়ের ( থিয়েটার ) ব্যবস্থা ছিল।
দক্ষিণ ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, কর্ণাটিক সঙ্গীত, তার বর্তমান রূপে বিকশিত হয়েছে।
দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে বিজয়নগর সাম্রাজ্য নতুন একটি যুগ সৃষ্টি করেছিল যা হিন্দুধর্মকে গৌরবময় করে তুলেছিল।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষতা :
বিজয়নগরের শাসক গণ বিষ্ণুর উপাসক হলে ও সকল ধর্মের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
এখানে বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলিম সকল ধর্মের মানুষ শান্তিতে বসবাস করত।
তৎকালীন সময়ে বিজয়নগরে হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতির সম্বয় হয়েছিল।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যে হিন্দু সংস্কৃতির প্রাধান্য থাকলেও শাসকগণ ধর্মীয় ক্ষেত্রে উদার ছিলেন।
শাসনব্যবস্থায় ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা হত।
পুর্তগিজ পর্যটক বারবােসা রাজা কৃয়দেব রায়ের আমলের ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে লিখেছেন-
তাঁর সাম্রাজ্যে যে কেউ আসতে ও সেখানে অবস্থান করতে এবং নিজধর্ম পালন করে শান্তিতে বসবাস করতে পারত।
সে যে ধর্মের ই হোক, এ বিষয়ে কেউ তাকে প্রশ্ন করত না।
কৃষি ও কৃষক :-
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল ছিল কৃষি, শিল্প ও ব্যাবসা বাণিজ্যের অগ্রগতি।
কৃষিকাজ ছিল সাধারণ জনগণের প্রধান জীবিকা।
কৃষির জন্য জলসেচের ব্যাবস্থা ছিল। উৎপন্ন শস্যের মধ্যে প্রধান ছিল ধান, গম, বার্লি, মশলা, যব, কলাই ও তুলাজাত পণ্য।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্য :
শিল্প উৎপাদনের দিক থেকে বস্ত্রশিল্প, যন্ত্রশিল্প, মৃৎশিল্প, ধাতু ও খনিজ উৎপাদন প্রধান ছিল।
আবদুর রজ্জাক ও পায়েজের রচনা থেকে জানা যায়,
শিল্পী ও বণিকদের পৃথক পৃথক সংঘ ছিল এবং এই সংঘগুলিই দেশের ব্যাবসা বাণিজ্য দেখাশোনা করত।
আবদুর রজ্জাকের মতে, বিজয়নগরে তিনশো বন্দর ছিল।
এই বন্দরগুলির মাধ্যমে চিন, মালয়, ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার), পারস্য, পর্তুগাল ও আফ্রিকার সঙ্গে ব্যাবসা বাণিজ্য করত।
বিজয়নগর থেকে রপ্তানি হত চাল, লোহা, গন্ধক, চিনি, মশলা ও বস্ত্র এবং আমদানি হত আরবি ঘোড়া, হাতি, মুক্তা, তামা, প্রবাল, পারদ ও রেশমবস্ত্র।
এই বহির্বাণিজ্য থেকে প্রচুর সম্পদ আহরিত হয়।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য :
জলপথ ও স্থলপথে আন্তদেশীয় বাণিজ্য হত।
স্থলপথে ঘোড়া, বলদ ও গো শকটে পণ্য পরিবহন হত।
সমুদ্রের উপকূলবর্তী বন্দরগুলি থেকেও অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য হত। বিজয়নগরে বড় জাহাজও তৈরী হত।
বারবোসা র লেখা থেকে জানা যায় যে, দক্ষিণ ভারতের মালদ্বীপে বড় জাহাজ তৈরির কারখানা ছিল।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মুদ্রা ও কর :
বিজয়নগরে সোনা, রুপা ও তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল।
মুদ্রায় দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি খোদাই করা থাকত।
ভূমিরাজস্ব ছিল সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। উৎপন্ন শস্যের এক ষষ্ঠাংশ ভূমিকর হিসেবে আদায় করা হত।
এছাড়া প্রজাদের সম্পদকর, বিক্রয় কর, যুদ্ধকর, বিবাহ কর, আদালত কর, মন্দিরে প্রদেয় প্রণামি প্রভৃতি নানা ধরণের কর প্রচলিত ছিল।
বিজয়নগরের খাদ্যদ্রব্যের দাম :
বিদেশি পর্যটকদের রচিত গ্রন্থ থেকে জানা যায়,
বিজয়নগরে খাদ্যদ্রব্যের দাম কম ছিল এবং শহরে সবসময় খাদ্যদ্রব্য মজুত থাকত।
উপসংহার:
বিজয়নগর সাম্রাজ্যে সাংস্কৃতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু অগ্রগতি হয়েছিল।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কৃয়দেব রায়ের আমল।
ইতিহাসবিদ ড. কালীকিঙ্কর দত্ত বলেছেন-
কৃয়দেব রায়ের রাজত্বকাল শুধু বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের জন্যই বিখ্যাত নয়,
শিল্প ও সাহিত্যের বিকাশ, ধর্ম নিরপেক্ষ এবং পৃষ্ঠপােষকতার জন্যও উল্লেখযােগ্য।
এই সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ এখনো বর্তমানে হাম্পির চারপাশে আছে এবং কর্ণাটকের এই স্থান বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী একটি স্থান।
অসাধারণ তথ্য
ধন্যবাদ, শেয়ার করে পাশে থাকবেন!
Pingback: মুঘলদের কট্টর শত্রু ছিলেন বাপ্পা রাওয়াল |
Pingback: ভারতীয় ইতিহাসে কুখ্যাত তৈমুর লঙ
Pingback: সেন বংশের শেষ শাসক রাজা লক্ষ্মণ সেন
Pingback: সম্রাট বিক্রমাদিত্যের বিক্রমী ইতিহাস | বেতাল পঁচিশি |
Pingback: রাজা প্রতাপাদিত্য | বাংলার শিবাজী | বাংলার বারোভুঁইয়া ও রাজা প্রতাপাদিত্য
Pingback: চাণক্য নীতি ও চাণক্য শ্লোক