বিখ্যাত হিন্দু বীর বাপ্পা রাওয়াল!
ইতিহাস বিদগণ কেন ভারতীয় বীর যোদ্ধাদের অতুলনীয় বীরত্ব, দেশপ্রেম ও সাহসিকতাকে ইতিহাস থেকে বাদ দিয়েছিল?
নেহেরু গান্ধীর ধর্মনিরপেক্ষ নীতি, মুঘলদের আগ্রাসন ও ইংরেজদের শাসন এক্ষেত্রে দায়ী বলে বিজ্ঞজন দের মত।
ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছে, যা হিন্দুদের কল্পনার অতীত এবং চরম লজ্জাজনক!
ভারতীয়দেরকে নিজেদের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় ইতিহাস গ্রন্থে শুধু বাবর, আকবর দের নিয়ে মনগড়া গল্প।
ইতিহাস গ্রন্থে দেখা যায় মুঘলরা এসেছিল, তারপর ইংরেজদের আগমন। এরপর ভারত স্বাধীন, ইতিহাস শেষ।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীনতম সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এখন খুব কম সংখ্যক ভারতীয়দের কাছে আছে।
মুঘলদের কিভাবে ভারতবর্ষ থেকে বিতারণ করা হয়েছিল, সেটাও ইতিহাস গ্রন্থে সঠিকভাবে বলা হয় না।
ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে একজন ভারতীয় যতটুকু জানে, তার থেকে অন্যদেশের লোকজন বেশি জানে!
প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশী ভারতের বিভিন্ন প্রত্নতাত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে ভারতে আসে। ভারতের ইতিহাস প্রায় সম্পূর্ণ বিকৃত।
ভারতবর্ষের সনাতনী পূর্বপুরুষদের বীরগাঁথা ইতিহাস লুকিয়ে রেখে,
ভারতীয়দের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে আত্মবিশ্বাসহীন, আত্মবিস্মৃত এক দুর্বল জাতিতে পরিণত করা হয়েছে।
কারণ ভারতীয়রা প্রকৃত ইতিহাস জানলে আবার ভারতের বুকে লক্ষ লক্ষ বীর তৈরি হয়ে যেতে পারে।
বীর সনাতনী যোদ্ধা বাপ্পাদিত্য রাওয়াল:
সময় টা ৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকাল, বর্তমান মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নি নগরী।
সেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় থেকেই ইতিহাসের পাতায় স্থান লাভ করেছে সমৃদ্ধশালী এই প্রাচীন নগরী।
হিন্দু দেশ, হিন্দুদের সংখ্যা:
উজ্জয়িনি নগরের উত্তরপ্রান্তে সুবিশাল উচ্চতার প্রস্তর দ্বারা নির্মিত শক্তিশালি প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত সম্রাট নাগভট্টের সুরম্য শ্বেতপ্রস্তরের রাজপ্রাসাদ।
চমৎকার সেই অট্টালিকার মোহনগৃহের অভ্যন্তরে একাধিক মশালের আলোয় আলোকিত সম্রাটের গুপ্ত আলোচনা কক্ষ।
সব সামন্ত রাজারা
বিদেশী আগ্রাসী শাষক আরব খলিফার শক্তিশালি আগ্রাসনকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে
নিজেদের ভবিষ্যত যুদ্ধাভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত!
একটি বিখ্যাত বাংলা প্রবাদ বাক্য, অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট!
পরবর্তীতে সেই রাজাদের আলোচনা, বাক বিতণ্ডায় পরিণত হয়।
বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের পরিকল্পনা করার পরিবর্তে
ভারতের হিন্দু রাজাগণ নিজেরাই নিজেদের মধ্য তীব্র কলহ, বৈরীতা আর দোষারোপে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
ঠিক এই সময়ে শিঙার ( মহিষের শিং দিয়ে শব্দ তৈরী করার বিশেষ বস্তু)
আওয়াজ দিয়ে দুই সশস্ত্র দ্বাররক্ষী সম্রাট নাগভট্টের আগমনের কথা ঘোষণা করেন।
ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোচনা কক্ষে প্রবেশ করলেন সম্রাট।
সম্রাটের দেহের রঙ শ্যামবর্ণ, মস্তক থেকে কাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত কুঞ্চিত ঘন কেশদাম, ওষ্ঠাধরের উপরে পুরু বক্র গোঁফের রেখা,
দুই কর্ণযুগলে দুলছে হীরক খচিত সুবর্ণ কুণ্ডল, কণ্ঠে মহার্ঘ্য রত্নহার।
সম্রাটের সুদীর্ঘ দেহ সৌষ্ঠবের পুরু কবচের উপরে আচ্ছাদিত লৌহ জালিকা ভেদ করে
তাঁর বলিষ্ঠ যৌবনের উদ্দাম শক্তি সমূহ যুক্ত মাংস পেশিগুলো যেন ঠেলে বাইরে উন্মুক্ত হতে চাইছে।
সম্রাটের বাম হস্তের অঙ্গুলিগুলো সুদৃঢ় রূপে আঁকড়ে ধরে রয়েছে তাঁর কোমরবন্ধনীতে আবদ্ধ বিশালকায় তীক্ষ্ণধার তলোয়ারের স্বর্ণখোচিত হাতল।
কক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সম্রাট নিজের দক্ষিণ হস্ত উপরে উঠিয়ে
বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরে কক্ষে তর্ক বিতর্কে ব্যস্ত সকল সামন্ত রাজাদের শান্ত হবার আহ্বান জানালেন।
কেমন যেন এক সম্মোহনী জাদুমন্ত্র ছিল সম্রাটের আদেশে।
মুহূর্তের মধ্যেই নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো আলোচনা কক্ষ।
এবারে সম্রাট নিজের সিংহাসনে আহোরণ করে গুরু গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন-
আর্যগণ আপনারা যদি এইভাবে প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যেই বৈরিতা, মনোমালিন্য আর ক্ষোভ প্রকাশ করেন
তাহলে গুপ্তচরের মাধ্যমে একবার আপনাদের এই মতানৈক্যের সংবাদ বিপক্ষ শিবিরে পৌছালে,
এর কি পরিনাম হবে সেটা আপনারা উপলব্ধি করতে পারছেন?
আপনাদের অবস্থা রাজা রাসিল, রাজা দাহির শাহ, হুলি শাহ আর উত্তর ভারতের অনান্য রাজাদের মত হবে।
আরব ভূমির যোদ্ধাদের ক্রীতদাসে পরিণত হবে রাজা রামচন্দ্রের স্মৃতিধন্য ভারতবর্ষ।
আপনারা কি আরবের খলিফা বাহিনীর হাতে নিজ মাতৃভূমিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় দেখতে চান?
রাণী এলিজাবেথ ও ভারতের ইতিহাস
সম্রাটের প্রশ্ন শুনে নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন বিশ বছর বর্ষীয় এক তরুণ তরতাজা যুবক।
তিনি নতমস্তকে সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে বিনম্র কণ্ঠে বললেন, আপনি সম্পূর্ণ সঠিক কথা বলেছেন মহামান্য সম্রাট।
আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করছি।
আপনি যদি এই অধমকে অভয় দান করেন তাহলে আরবদের বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধের জন্য এমন এক পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করতে পারি,
যার সঠিক রুপায়ন হলে আগ্রাসীগণ শোচনীয় রূপে পরাজিত হয়ে
জীবিত অবস্থায় হয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে পলায়ন পথের সন্ধান পাবে না।
এই কথা শুনে, যুবকের দিকে ফিরে তাকালেন সম্রাট নাগভট্ট।
যুবকের সুঠাম দেহ, তেজদৃপ্ত চাহনি
আর পুরু গোঁফের অন্তরালে তাঁর ইস্পাতকঠিন মুখমণ্ডল দেখলে সহজেই উপলব্ধি হয়,
ইনি কোন সাধারন যুবক নন!
নিশ্চিতরূপে ইনি একজন সুদক্ষ বীর যোদ্ধা।
সম্রাট সেই যুবকের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, কে আপনি?
নিজের পরিচয় দিন।
সম্রাটের প্রশ্নের জবাবে যুবক বিনম্র কণ্ঠে বললেন, মহামান্য সম্রাট, এই অধমের নাম বাপ্পাদিত্য রাওয়াল।
ঘুপতি রামচন্দ্রের সূর্যবংশীয় জাত গুহিলট বংশের ক্ষত্রিয় সন্তান আমি। যুদ্ধ আমার ধমনীর রক্তে প্রবাহিত হয়।
আমি বর্তমানে চিত্রকূট দুর্গের অধিপতি মৌর্য (সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মৌর্য বংশ নয়,
রাজস্থানের মোরি বংশ) বংশের মহারাজ মনুরাজের প্রধান সেনাপতি হিসাবে কর্তব্যরত।
মহারাজের নির্দেশে আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি,
বহিরাগত লুটেরাদের বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধে আপনাকে সাহায্য করে ভারত ভূমিতে ধর্মের রক্ষার জন্য।
সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের কথা শুনে সম্রাট নাগভট্ট প্রসন্ন চিত্তে বলে উঠলেন,
উত্তম, অতি উত্তম হে বীর যুবক!
আপনি আপনার যুদ্ধের পরিকল্পনা পেশ করুন!
স্বয়ং সম্রাটের অভয়বাণী শুনে এবারে বাপ্পা রাওয়াল সর্ব সমক্ষে পেশ করলেন আসন্ন যুদ্ধে নিজের যুদ্ধের পরিকল্পনার কথা।
সেই পরিকল্পনা ছিল একেবারে অপ্রচলিত।
বাপ্পা রাওয়ালের এমন যুদ্ধ পরিকল্পনা পূর্বে গ্রহণ করেননি
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিখ্যাত মৌর্য রাজবংশ থেকে শুরু করে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের গুপ্ত সাম্রাজ্য,
সম্রাট গৌতমীপুত্র শতকার্নির সাতবাহন সাম্রাজ্য থেকে ভারতবর্ষের অনান্য পরিচিত এবং অপরিচিত রাজা এবং সম্রাটগণ।
বাপ্পা রাওয়ালের পরিকল্পনা শুনে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান সম্রাট নাগভট্ট।
বাপ্পা রাওয়ালের যুদ্ধ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে করলেন সভায় উপস্থিত অনান্য সামন্ত রাজারা।
শাকম্ভরীর সামন্তরাজ প্রথম বিগ্রহরাজ চৌহান নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র অসন্তোষভরা কণ্ঠে বললেন,
চিত্রকূটের সেনাপতির এমন রণনীতি মেনে নেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব মহামান্য সম্রাট।
এই রণনীতি একেবারে ক্ষত্রিয়ধর্মের বিপরীত।
ধর্মগ্রন্থ আমাদের শত্রুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বীরের মত বুক উঁচু করে যুদ্ধ করে জয় অথবা মৃত্যু বরণ করতে বলে।
এইভাবে অন্তরালে থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত করতে বলেনা। ক্ষমা করবেন,
সম্রাট চিত্রকূটের একজন সামান্য সেনাপতির এমন কাপুরুষচিত রণনীতি গ্রহণ করতে আমরা অপারগ!
বিগ্রহরাজ চৌহানের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে সমস্বরে প্রতিবাদে জানালেন সভায় উপস্থিত অনান্য সামন্ত রাজাগণ।
সম্রাট নাগভট্ট সঙ্কটে পরলেন। চিত্রকূটের তরুণ সেনাপতি বাপ্পা রাওয়ালের এই অভূতপূর্ব রণনীতি তাঁর অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে,
কিন্তু অন্যদিকে বাপ্পা রাওয়ালের এই রণনীতির বিরুদ্ধে রয়েছে তাঁর সামন্ত রাজাদের তীব্র অসন্তোষ।
সামন্ত রাজাদের অসন্তোষ আর ক্ষোভ শান্ত করে সকলকে একত্রে আবদ্ধ করতে এক পরিকল্পনা করেন তিনি।
আর এই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাপ্পা রাওয়াল কে নিয়ে বিপক্ষের সেনাদের করুণ ভাবে পরাজিত করেন।
you also may like…
পরবর্তীতে এই বাপ্পা রাওয়াল মেওয়ারের রাজা হয়,
যিনি ৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজস্থান সীমান্তে রাজস্থানের যুদ্ধে আক্রমণকারী আরবদের শোচনীয় পরাজয় ঘটিয়েছিলেন!
পণ্ডিতদের দাবি, আরবী মুসলমানগণ ভারত আক্রমণ শুরু করে ৭ম শতাব্দীতে।
প্রথম মুসলিম আক্রমণকারী মুহম্মদ বিন কাসিম, এবং সিন্ধুর শেষ হিন্দু রাজা ছিলেন দাহির সেন।
বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাবের কিছু অংশ আক্রমণ করেছিলেন এবং ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু নদীর তীরে আলোর যুদ্ধে রাজা দাহির কে হত্যা করেছিলেন।
এরপর তার রাজ্য কেড়ে নিয়ে উমাইয়া খিলাফতে অর্ন্তভুক্ত করে।
বাপ্পা রাওয়ালের জন্ম :
বাপ্পা রাওয়াল ৭১৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতা রাওয়াল মহেন্দ্র, ভেলের সাথে যুদ্ধে নিহত হন।
বাপ্পা রাওয়াল অনুগত ভীল পরিচারকদের মাধ্যমে তার মায়ের দ্বারা লালিত পালিত হন।
ভেল উপজাতি গণ বাপ্পা রাওয়ালকে সামরিক যুদ্ধের দক্ষতা শিখিয়েছিল।
৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে ২১ বছর বয়সে,
বাপ্পা রাওয়াল চিতোর শাসনকারী মোরিকে পরাজিত করে চিত্তোর দুর্গ জয় করেন।
বাপ্পা রাওয়াল গুহিলট রাজপুত রাজবংশের অষ্টম শাসক ছিলেন,
কিন্তু তার সাত প্রজন্মের কেউ রাজবংশের নাম প্রকাশ করেনি।
বাপ্পা রাওয়াল নিরামিষ ভোজন করতেন এবং মহাকালের পরম ভক্ত ছিলেন।
হরিৎ ঋষির আশীর্বাদে মাত্র ২০ বছর বয়সে উনি মোর্য শাসকদের হারিয়ে মেবাড়ের রাজকার্য শাসন করতেন।
বাপ্পা রাওয়ালের পরাক্রমঃ
মোহাম্মদ বিন কাসিম আফগানিস্তান ও ইরান জয় করেছিলেন।
ব্রাহ্মহনাবাদ এলাকা দখল করে রাজা দাহির সেনকে পরাজিত করে
সিন্ধুতে আরবীয়দের শাসন প্রতিষ্ঠিত করে।
রাজা দহীরকে পরাজিত করার পর হিন্দুদের ছোট ছোট সেনাবাহিনী কাশিমকে প্রতিরোধ করতে পারেনি।
মহম্মদ বিন কাশিম সেখানের মহিলাদের আরবে নিয়ে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করতে শুরু করে।
সেইসাথে সিন্ধের সমস্ত মন্দির ও সভ্যতার ঐতিহ্য ধ্বংস করতে শুরু করে।
নিরীহ গবাদিপশু ধরে রাস্তায় এনে কাটতে শুরু করে আরবীয় সেনাগণ।
সিন্ধে অধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। বহু জনগণ সিন্ধ ছেড়ে পালাতে শুরু করে।
কিছু মানুষ আশ্রয় নিতে যায় মেবারে, যেখানে এক মহান হিন্দু রাজার রাজত্ব ছিল।
সেই মহান রাজার নাম ছিল বাপ্পা রাওয়াল।
বাপ্পা রাওয়াল একজন মহান পরাক্রমী রাজা ছিলেন যার সাথে যুদ্ধ করার অর্থ ছিল
নিজের নিজের বিনাশ ডেকে আনা।
মোহাম্মদ বিন কাসিমের উত্তরসূরি জুনায়েদ আল রহমান দক্ষিণ রাজস্থান এবং গুজরাটের বেশ কয়েকটি শহর আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে
বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সিন্ধু অতিক্রম করে পূর্ব ভারতের দিকে চলে যান।
মহম্মদ বিন কাশিমের অত্যাচারে সিন্ধ থেকে পালিয়ে আসা মানুষের থেকে বাপ্পা রাওয়াল সেখানের মানুষের দুঃখ কষ্ট জানতে পারেন।
বাপ্পা রাওয়াল জনগণের উপর অত্যাচার ও মহিলাদের সন্মান হানির কথা শুনে প্রচণ্ড ক্রোধিত হয়ে পড়েন।
শিবালয় ও মন্দির ভাঙার কথা শুনে উনি নিজের সেনাপতি ও মন্ত্রীদের উদেশ্য করে ঘোষণা করেন,
“আমাদের দূর্গ যদি কেউ জয় করে তাতে শুধু আমাদের মাথা ঝুঁকে যায়,
কিন্তু আমাদের মন্দিরে কেউ ভাঙলে সেটা অধর্মের জয়।
আমি থাকতে সেটা হতে দিতে পারি না।” এরপর বাপ্পা রাওয়াল সিন্ধকে অধর্ম থেকে মুক্তি দিতে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পৌছে যায় সিন্ধদেশ।
মুখে হর হর মহাদেব শ্লোগান, হাতে গেরুয়া পতাকা নিয়ে সিন্ধ দেশে হাজির হয় বাপ্পা রাওয়ালের বিশাল সেনাবাহিনী।
738 খ্রিস্টাব্দে উত্তর পশ্চিম ভারতের আঞ্চলিক শাসক এবং আরবীয় আক্রমণকারীদের মধ্যে
“রাজস্থানের যুদ্ধ” নামে একটি সিরিজ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
বাপ্পা রাওয়াল এর সেনাগণ যেন নিজের শক্তি প্রদর্শনের কোনো সুযোগ খুঁজছিল। এক একজন সেনা ১০ জন আরবীয় সেনাকে বধ করতে শুরু করে।
মহম্মদ বিন কাশিম বিশাল সেনার শক্তি দেখে ভয়ার্ত হয়ে পড়ে এবং জলপথে আরবি হাজাজ এর কাছে পলায়ন করে।
আরবি হাজাজকে কাশিম সব ঘটনা বিস্তারিত বলে।
এদিকে বাপ্পা রাওয়াল দেখেন, আরবি সেনা পলায়ন করে আরবের দিকেই।
বাপ্পা রাওয়াল আরবিদের পিছু ধাওয়া করে বেলুচিস্তান পার করিয়ে দেয়।
তারপর পুনরায় ভারতে শান্তি আসে এবং সনাতন ধর্মের প্রকাশ ঘটে।
বাপ্পা রাওয়াল মেবাড়ে ফিরে আসে এবং রাজত্ব করতে থাকে।
এরমধ্যে আরবি হাজাজ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বিশাল আরবীয় সেনাবাহিনী গঠন করে এবং দুইবার আক্রমণ করে।
একদিকে মেবাড়ে অপরদিকে জয়সেলমেরে আক্রমণ করে আরবীয় সেনা।
বাপ্পা রাওয়াল দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে প্রত্যাঘাত করে।
বাপ্পা রাওয়াল তার সেনা নিয়ে হাজাজ এর সীমায় ঢুকে পড়ে।
এদিকে নাগভট্ট প্রথম পশ্চিম প্রান্ত থেকে আরবীদের রক্ত স্নান করিয়ে দেয়।
এরপর বাপ্পা রাওয়াল বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং
আশেপাশের সব রাজাদের এবং সেনাদের একত্রিত করে, যাতে আরবীয়দের সঠিক শিক্ষা দেওয়া যায়।
নাগভট্ট, বিক্রমাদিত্য দ্বিতীয় এবং অন্যান্য রাজাদের সেনা নিয়ে হিন্দুদের মহাসেনা গঠন করে।
সেই মহাসেনা নিয়ে বাপ্পা রাওয়াল আরবের দিকে রওনা দেন। আরবে হিন্দু মহাসেনার প্রথম আক্রমন আল হাকাম বিন আলাবার উপরে করা হয়।
সেখানে গেরুয়া পতাকা স্থাপনের পর তামিম বিন জেয়েদ, জুনেদ বিন আব্দুল আল নুরির উপর আক্রমণ করা হয়।
আরবের যে রাজ্য থেকে ভারতে আক্রমন করা হতো সেখানে গেরুয়া স্থাপিত করে দেওয়া হয়।
তবে শত্রুদের ধ্বংস করার পর বাপ্পা রাওয়াল সেখানে রাজত্ব করেনি। কারণ একজন হিন্দু রাজা কখনোই বিদেশের মাটিতে রাজত্ব করতো না।
এরপর এই মহাসেনা গজনীর দিকে অগ্রসর হয়। গজনীর শাসক সেলিম আল হাবিব ও তার সেনাবাহিনী ধ্বংস করে দেয় মহা সেনা।
উত্তর পশ্চিম সীমান্তকে শক্তিশালী করার জন্য বাপ্পা রাওয়াল রাওয়ালপিন্ডি নামে একটি শহর তৈরি করেছিলেন,
যা আজও পাকিস্তানে আছে এবং এই শহরকে তার সামরিক ঘাঁটি বানিয়েছিল।
রাওয়ালপিন্ডির সামরিক ঘাঁটি থেকে বাপ্পা রাওয়াল আফগানিস্তানের গজনিতে ১৫টিরও বেশি আক্রমণ চালিয়েছিল
এবং মেওয়ার রাজ্য ইরান পর্যন্ত বর্ধিত করেছিল।
বাপ্পা রাওয়ালের সাহসিকতা এবং নিপূণ যুদ্ধ কৌশল এতটাই বিস্ময়কর ছিল যে,
এরপর প্রায় ৪০০ বছর আরবীয় সেনাগণ ভারতে আক্রমন করার সাহস পায়নি।
বাপ্পা রাওয়াল কেবল আরবদের কাছ থেকে সিন্ধুকে মুক্ত করেননি,
বেলুচিস্তান, গজনি, কান্দার, খোরাসান, তুরান এবং ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অভ্যন্তরে
একটি বিশাল ভৌগলিক অঞ্চলে সমগ্র উত্তর পশ্চিম সীমান্ত শাসন করেছিলেন।
ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে বাপ্পা রাওয়ালের অতুলনীয় বীরত্ব, পরাক্রম ও সাহসিকতার বর্ণনা না করার থেকে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
ইতিহাসবিদরা আফগান যোদ্ধাদের প্রশংসা করেছেন,
কিন্তু বাপ্পা রাওয়াল এবং রাজা ললিতাদিত্যের মতো হিন্দু যোদ্ধারা গজনীকে পরাজিত ও পরাজিত করার বিষয়টি কেন তারা বাদ দিলেন?
উদয়পুরের কাছে যথাথায় বাপ্পা রাওয়ালের একটি ১৫ ফুট উঁচু মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল।
রাজস্থান সরকারের রাজস্থান হেরিটেজ কনজারভেশন অ্যান্ড প্রমোশন অথরিটি দ্বারা নির্মিত,
বাপ্পা রাওয়াল প্যানোরামাটি ২০১৮ সালের আগস্টে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে উদ্বোধন করেছিলেন।
ভারততত্ত্ববিদ ডেভিড গর্ডন হোয়াইট বলছেন,
খ্রিস্টিয় পঞ্চাদশ শতাব্দীর লেখা “একলিঙ্গ মাহাত্ম্য” অনুযায়ী, ৭২৮ খ্রিস্টাব্দে বাপ্পা রাওয়াল মেবার রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
ঐতিহাসিক ডি. আর.ভাণ্ডারকর এবং জি. এইচ. ওঝার মতে,
বাপ্পা রাওয়াল ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
তারপর তার আরাধ্য দেবের চরণে নিজেকে সমর্পিত করেন।
“একলিঙ্গ মাহাত্ম্য” অনুসারে, বাপ্পা রাওয়াল ছিলেন গুহদত্ত প্রতিষ্ঠিত গুহিলা সাম্রাজ্যের নবম পুরুষ।
তাঁর পিতা নাগাদিত্য ভিলদের সঙ্গে একটি যুদ্ধে নিহত হোন এবং
পরবর্তীকালে বাপ্পা রাওয়াল পিতার হত্যাকারীদের যুদ্ধে হারিয়ে
৭২৮ খ্রিস্টাব্দে মেবার রাজবংশের পত্তন করেন এবং তৈরি করেন একলিঙ্গজীর মন্দির।
আটপুর এবং কাদামাল শিলালিপি অনুযায়ী,
গুহিলা শাসক কালভোজের উত্তরাধিকারী ছিলেন মহেন্দ্র এবং তিনিই বাপ্পা রাওয়াল।
অপরদিকে, ঐতিহাসিক ডি. আর. ভাণ্ডারকর মনে করেন,
গুহিলা শাসক কালভোজের পুত্র খুমান্নাই হলেন এই বাপ্পা রাওয়াল।
অন্যদিকে, লক্ষ্মৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্যামমনোহর মিশ্র বলেন, মৌর্য শাসক মনুরাজের সামন্ত রাজা ছিলেন এই বাপ্পা রাওয়াল।
মনুরাজের পর তিনি চিতোরের রাজা হোন।
“বাপ্পা” শব্দের অর্থ হলো পিতা এবং “রাওয়াল” মানে হলো, রাজকুল অর্থাৎ এটি রাজকীয় উপাধি।
বাপ্পা রাওয়ালের পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ আরও পূর্বদিকে গিয়ে গোর্খা বংশের সূচনা করেন।
পরবর্তীকালে গোর্খা বংশের হাতে প্রতিষ্ঠা হয় নেপাল রাজ্যের।
“গোর্খা” শব্দটির উৎপত্তি খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দীর হিন্দু যোদ্ধা এবং সন্তগুরু গোরক্ষনাথের নামানুসারে।
কিছু পন্ডিতদের মতে, এই গোরক্ষনাথের শিষ্য ছিলেন যুবরাজ কালভোজ বা শালিয়াধীশ।
তিনিই “বাপ্পা রাওয়াল” নামে পরিচিত।
তথ্যসূত্রঃ
১) Crawford, Peter (2013). The War of the Three Gods: Romans, Persians and the Rise of Islam.
Barnsley, Great Britain: Pen & Sword Books. p. 216
২) Sandhu, Gurcharn Singh (2000). A Military History of Ancient India. Vision Books. p. 402
৩) Sailendra Nath Sen (1 January 1999).
Ancient Indian History and Civilization. New Age International. pp. 343–344
৪) Kumar, Amit (2012). “Maritime History of India: An Overview”. Maritime Affairs:
Journal of the National Maritime Foundation of India.
8 (1): 93–115. In 776 AD, Arabs tried to invade Sind again but were defeated by the Saindhava naval fleet.
A Saindhava inscription provides information about these naval actions.
৫) Majumdar, R. C. (1977). Ancient India (Eighth ed.). Delhi: Motilal Banarsidass.
অসাধারণ তথ্য
Pingback: ভারতীয় ইতিহাসে কুখ্যাত তৈমুর লঙ
Pingback: সেন বংশের শেষ শাসক রাজা লক্ষ্মণ সেন
Pingback: সম্রাট বিক্রমাদিত্যের বিক্রমী ইতিহাস | বেতাল পঁচিশি |
Pingback: গজনির সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের ইতিহাস
Pingback: রাজতরঙ্গিনী পিডিএফ