বাংলা সনের প্রবর্তক ছিলেন বাংলার প্রথম, স্বাধীন, সার্বভৌম শাষক গৌড়রাজ শশাঙ্ক। বাংলা সনের ইতিহাস ও বাংলা মাসের উৎপত্তি নিয়ে নব প্রজন্মের মধ্যে ধোঁয়াশা দূর করে ইতিহাস থেকে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে এই আর্টিকেল।
বাংলা সনের ইতিহাস
বাংলা সনের ইতিহাস বহু প্রাচীন।
বর্তমান সময়ে প্রচলিত সন গণনা পদ্ধতি হচ্ছে খ্রিষ্টাব্দ।
একসময় ইংরেজরা প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে রাজত্ব করেছিল এবং বলা যায় এখনও পরোক্ষভাবে রাজত্ব করছে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা একপ্রকার বাধ্য হয়ে ব্যাবহার করছি তাদের তৈরী সন গণনা পদ্ধতি এবং ইংরেজি ভাষা।
কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো প্রাচীন ভারতের বৈদিক সভ্যতার লোকজন তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে দিন ও সন গণনা করতো, এমন বহু নির্দশন পাওয়া যায়।
রামায়ণ ও মহাভারত বৈদিক সভ্যতার দুইটি মহাকাব্য। বিখ্যাত মহাকাব্য রামায়ণ থেকে একটু উদাহরণ-
সনাতনী সম্প্রদায়ের অবতার শ্রীরামচন্দ্রের জন্মদিন উপলক্ষে সনাতনীগণ রাম নবমী পালন করে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের নবম দিনে।
আজ থেকে প্রায় ৭১০০ বছর পূর্বে শ্রীরামের জন্মকালীন সময়ে যদি দিন ও মাসের হিসাব না থাকতো,
তবে এই দিন কিভাবে রাম নবমী হিসাবে বিখ্যাত হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে?
রামায়ণের আরেকটি বিষয়ে লক্ষ করুন, রাম, সীতা এবং লক্ষণ ১৪ বছরের জন্য বনবাসে গমন করেছিল।
বনবাসের সময় ১৩ তম বছরে সীতা লঙ্কারাজ রাবণ কর্তৃক অপহৃত হয়েছিল এবং সেই একই বছরে রাবণের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়েছিল।
মহাকাব্য রামায়ণের সময়ে যদি সন, মাস, এবং সাপ্তাহিক দিনের হিসাব না থাকতো, তাহলে বনবাসকালীন সময়ে কিভাবে তারা ১৪ বছরের হিসাব রেখেছিলো?
বৈদিক সভ্যতার আরেকটি মহাকাব্য মহভারত গ্রন্থেও সন, মাস, ও সাপ্তাহিক দিন গণনার বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। প্রথম দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়-
গঙ্গাদেবী যখন ভীষ্মকে বিদ্যা শিক্ষা প্রদান করে রাজা শান্তনুর নিকটে দিয়ে যায়, সেই সময় ভীষ্মের বয়স ছিল ২৫ বছর।
পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে অর্জুন যখন প্রথম হস্তিনাপুরে আগমন করে, তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর।
পাণ্ডব ও কৌরবগণ ১০৫ ভাই ছিল এবং তারা অস্ত্রগুরু দ্রোণের নিকটে ১২ বছর অস্ত্রবিদ্যা গ্রহণ করে।
শকুনির পাশা খেলায় ছলনার ফলে দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের রাজ্য কেড়ে নেয় এবং পঞ্চপান্ডবদের ১২ বছরের বনবাস ও এর সাথে ১ বছর অজ্ঞাত বাস করতে বাধ্য করে।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে সনাতনী সম্প্রদায়ের অবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন পালন করা হয়।
সন অথবা দিনের হিসাব তখন যদি প্রর্বতন না থাকতো, তাহলে তৎকালীন যুগে সময়ের এই হিসাবগুলো তারা কিভাবে করেছিলো? সনের এই হিসাবগুলো তাঁরা
অনেক সূক্ষ্মভাবে জানতো। পঞ্চপান্ডবদের অজ্ঞাতবাস যেইদিন শেষ হয়, সেই দিন সূর্যাস্তের পরে বিরাট নগরীকে রক্ষার্থে অর্জুন নিজেকে প্রকাশ করে দুর্যোধন ও তাঁর সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে!
মহাভারতের আরেকটি চমৎকার বিষয়ে লক্ষ করলে জানা যায়, সূর্যের উত্তর গোলার্ধ এবং দক্ষিণ গোলার্ধ গমনের হিসাব যেটা উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন নামে সনাতনীদের মধ্যে পরিচিত।
এই বিষয়ে তৎকালীন বৈদিক যুগের মানুষের মধ্যে ভালো জ্ঞান ছিল।
এজন্যই ইচ্ছামৃত্যুর বর প্রাপ্ত ভীষ্ম, সমস্ত শরীরে তীরবিদ্ধ হয়েও ৫৮ দিন জীবিত থেকে পরবর্তীতে সূর্যের এই গমনের হিসাব অনুযায়ী প্রাণ ত্যাগ করেছিল।
অতএব, বৈদিক যুগের মুনি ঋষিগণ সনের হিসাব অনেক ভালোভাবেই আবিষ্কার করেছিলো এবং তার পরবর্তী সনাতনী সম্প্রদায় দৈনন্দিন জীবনে এই সনের ব্যবহার করত।
আরও পড়ুন:মুনিঋষিদের আবিস্কার
রাজা শশাঙ্ক তাঁর জন্মের বহু সময় আগে থেকে, বৈদিক যুগ থেকে প্রচলিত ও রামায়ণ ও মহাভারতে প্রচলিত দিন, মাস ও সনের হিসাবকে ভিত্তি করেই বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন তাঁর সিংহাসন আরোহণের সময় স্মরণীয় করে রাখার জন্য।
অতএব, সনাতনীদের সন গণনা/বর্ষ গণনার রীতি বহু পুরোনো এবং অনেক সমৃদ্ধ।
শুধু মাত্র সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান ও প্রকৃত ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞানতার কারণে ভারতবর্ষের সনাতনীগণ একাধিকবার বিদেশী শক্তি, বিদেশী কালচার ও বিদেশী ধর্মের কাছে পরাস্ত ও পদানত হয়েছে।
তাদের মিথ্যা ও জোরপূর্বক প্রচারে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ে না জেনে মিথ্যা ও ভয়াবহ অপপ্রচারকে সত্য বলে মনে করেছে।
১৪০২ বাংলা সনে প্রকাশিত শারদীয় মুর্শিদাবাদ সন্দেশ নামক ম্যাগাজিনে যমুনা প্রসাদ মন্ডল রচিত আলেরকোমভীরাবর্ণ প্রবন্ধে গবেষণালব্ধ কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ এলাকার প্রচলিত একটি উৎসব অনুষ্ঠানের উৎপত্তি নিয়ে লিখেছিলেন যমুনা প্রসাদ মন্ডল।
বাংলা সনের মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের সপ্তমী তিথিতে পালন করা শিব – চণ্ডীর উপাসনা (মাকরী সপ্তমী), অনুষ্ঠান উপলক্ষে পাঠ করা একটি গ্রাম্য পাঁচালির সম্পূর্ণ উল্লেখ করেছেন।
ঐ পাঁচালি থেকে নেওয়া একটি শব্দ থেকেই ঐ প্রবন্ধের শিরোনাম তৈরী করেছেন আলেরকোমভীরাবর্ণ নামে।
ঐ নিবন্ধে গবেষক যমুনা প্রসাদ মন্ডল দীর্ঘদিন অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল গবেষণা করে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন,
শশাঙ্কের শাসনামলে কলিঙ্গে অবস্থিত ভুবনেশ্বরে লিঙ্গরাজ মন্দিরের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত হওয়া উৎসব অনুষ্ঠান থেকেই মুর্শিদাবাদের বর্তমান উৎসবের উৎপত্তি।
গবেষক মন্ডল বোঝাতে চেয়েছেন, রাজা শশাঙ্কের প্রবর্তিত একটি শৈব-তান্ত্রিক পূজো অনুষ্ঠান যদি ধারাবাহিকভাবে ১৪০০ বছর ধরে বাংলা ভূমিতে পালিত হতে পারে, তাহলে তাঁর প্রবর্তিত বাংলা সন কেন টিকে থাকতে পারবে না!
আকবরের সময়কালের গ্রন্থগুলোতে বাংলা সনের প্রবর্তক নিয়ে তথ্য নেই। মুঘলরা কখনও নীরবে কাজ করে নাই। প্রতিটি কাজের উল্লেখ খাকত।
অপরদিকে দেখা যায়, তারিখ-ই-ইলাহির সাথে ৯৬৩ হিজরি সনের উৎপত্তি বর্ষ ধরে নেওয়ার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।
সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, তারিখ-ই-ইলাহি হিজরি সন থেকে গণনা করা শুরু হয়নি, ঐ সনের প্রথম বছর ছিল আকবরের সিংহাসন আহোরণের বছর।
অতএব, ঐ সন ৯৬৩ দিয়ে শুরু হয়নি। তাই যারা তারিখ-ই-ইলাহির সাথে বাংলা সনকে এক করে দেখেছেন, তাদের ইতিহাস বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি সীমিত!
অনেকেই বলে থাকে, রাজস্ব আদায়ের জন্য বাংলা সন প্রবর্তন করেছিল মুঘলরা।
যদি তাই হতো, তাহলে তার সাম্রাজ্যে নতুন ফসলি সন প্রবর্তক করত। কিন্তু বৈশাখে কিভাবে শুরু হয়? কারণ বৈশাখ মাসে রাজস্ব আদায় অথবা নতুন ফসল ওঠে না।
সবচেয়ে বড় কথা হল, ১৫৮৪ সালে বাংলার খুব সামান্য অংশ মোগলদের অধীনস্থ ছিল।
১৫৭৬ সালে শেষ পাঠান সুলতান দাউদের মৃত্যু হয়, গৌড় রাজ্যে আকবরের সামন্ত অনেকটাই অসহায়, এবং তৎকালীন সময় বাংলা ভূমিতে বারো ভুঁইয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
তাছাড়াও তখন বাংলার বহু জায়গাতে মোঘলদের নিয়ন্ত্রণ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এমন অবস্থার মধ্যে রাজস্ব আদায় তেমন হত না।
আর এমন সময়ে আকবর সবার অজান্তে এমনকি আবুল ফজলকেও অবহিত না করে একাকী বাংলা সন তৈরি করেছিল রাজস্ব আদায়ের জন্য, এটা অবিশ্বাস্য!
তপন রায়চৌধুরীর মতে, ১৫৯৪ সালের পূর্বে গৌড়রাজ্যে মোঘলদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
তাহলে, এই সময়েরও দশ বছর পূর্বে আকবরের আদেশে বাংলা সন তৈরি হয়েছিল, এই কথা পাগলের প্রলাপ মাত্র!
উল্লেখ্য, ভারতীয় উপমহাদেশে পঞ্জিকার প্রচলনের ইতিহাস বহু প্রাচীন, ধারণা করা হয় সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল থেকে বর্ষপঞ্জীর প্রচলন।
বৈদিক আর্য ঋষিগণ ও হিসাব রাখত। ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলে তিনটি ঋতু শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষার উল্লেখ পাওয়া যায়।
যে কোনও উন্নত সভ্যতা যেখানে কৃষিকার্য গুরুত্বপূর্ণ, (যেমন বাঙালির সভ্যতা), সেখানে বর্ষপঞ্জি ব্যাতীত কাজ হয় না।
একসময় ফাল্গুনী পূর্ণিমা থেকে বর্ষ শুরু হত, গুপ্তযুগে পাওয়া যায় অগ্রহায়ণ ছিল তৎকালীন সময়ে বছরের প্রথম মাস।
বাংলা সনের প্রবর্তন হয় কত সালে
তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী ইতিহাসবিদদের ধারণা, রাজা শশাঙ্কের শাসনামল ছিল ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে।
বাংলা সনের নববর্ষের হিসাব অনুযায়ী এই বছর ১৪২৯ বাংলা সন যদি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ হয়, তাহলে বাংলা সনের প্রথম বছর ছিল- (২০২৩ – ১৪২৯) ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ। অতএব, রাজা শশাঙ্কের শাসনামল।
স্বাধীন রাজা হিসাবে, শশাঙ্ক তাঁর রাজত্বকালের সূচনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সূর্যসিদ্ধান্ত ভিত্তিক বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী বঙ্গাব্দ তথা বাংলা সনের প্রচলন করেন।
বাংলা সনের প্রবর্তক
বাংলা সন, বাংলা নববর্ষ সর্বপ্রথম কে প্রবর্তন করেছিল,
এ নিয়ে একাধিক মত থাকলেও, পন্ডিতদের মতে বাংলা সনের প্রবর্তক রাজা শশাঙ্ক।
প্রাচীন বাংলার প্রথম স্বাধীন মহারাজা, তথা গৌড়েশ্বরের মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কের শাসনামলে সূর্যসিদ্ধান্ত ভিত্তিক বাংলা নববর্ষ বঙ্গাব্দ শুরু হয়।
বঙ্গাব্দ, ভারতবর্ষের বাঙ্গালীর নিজস্ব একটি যুগাব্দ।
কিন্তু এই বঙ্গাব্দের সূচনা কবে হয়েছিল, এই বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও প্রাচীন তথ্য প্রমাণ অনুসারে রাজা শশাঙ্ক বাংলা সনের প্রবর্তক।
আরও পড়ুন: বাংলার ইতিহাসে গৌড়রাজ শশাঙ্কের কৃতিত্ত্ব
প্রতিবেশি দেশের দিকে নজর দিলে দেখতে পাই, একই সময়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য/প্রদেশে নববর্ষের উৎসব পালন করা হয়।
তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু নামে, কেরালাতে বিশু নামে, পাঞ্জাবে বৈশাখী নামে, আসামে ভাস্করাব্দ শুরুর উৎসবে পালন করা বাংলা সনের নববর্ষ উৎসব।
অবাঙালী বিহু, ত্রিপুরার উপজাতি ও বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে বৈসাগু নামে বাংলা সনের নববর্ষ উৎসব পালন করা হয়।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে, মুঘল সম্রাট আকবর যদি বাংলা সন প্রবর্তন করে থাকেন,
তাহলে একই সময়ের প্রায় একই দিনে এই উপমহাদেশের প্রতিটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্ন নামে বাংলা সনের নববর্ষ উৎসব কিভাবে পালিত হয়?
মুঘল সম্রাট আকবর কি বাংলা সনের প্রবর্তক?
মুঘল সম্রাট আকবর, মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট।
সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পরে পুত্র আকবর বৈরাম খানের সহযোগিতায় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে এবং ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে বৈরাম খান কে অপসারণ করে আকবর সকল ক্ষমতা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে, ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।
ইদানীং বিকৃত ইতিহাসবিদগণ মত প্রকাশ করেন, বাংলা সনের প্রবর্তক মুঘল সম্রাট আকবর!
বাংলা ভাষায় কথা বলা, লেখাপড়া সম্পর্কে আকবরের কোন ধারণা ছিল না। অর্থাৎ তিনি বাংলা ভাষার সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন।
যতটুকু জানা যায়, তিনি ফার্সী ভাষা ব্যবহার করতেন। তিনি তার শাসনামলে ফারসী মাস অনুযায়ী, তারিখ-ই-ইলাহী-র প্রবর্তন করেছিলেন।
বিকৃত ব্যাক্তিদের যুক্তি, খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর তারিখ-ই-ইলাহী নামে সৌর বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী বাংলা সন প্রবর্তন করেন।
অতএব, তারিখ-ই-ইলাহী এর প্রবর্তন হয় তার ২৯ তম বছর থেকে। কিন্তু ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ ছিল ৯৬৩ হিজরী সন।
বাম ইতিহাসবিদদের মতে, সম্রাট আকবর ইংরেজি ১৫৫৬ সাল, হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে বাংলা সন / বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করেন।
স্বাভাবিকভাবেই এখনে প্রশ্ন উঠে আসে, বাংলা সন ১ থেকে শুরু না করজে ৯৬৩ থেকে শুরু করা হল কেন?
এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রবর্তক সব সন শুরু হয়েছে ১ থেকে এবং ১ থেকে থেকে শুরু হওয়া যুক্তিসঙ্গত।
সম্রাট আকবর যদি বাংলা সনের প্রবর্তক হয়ে থাকেন, তাহলে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দকেই বাংলা সন ১ বঙ্গাব্দ হিসাবে প্রবর্তন করতে সমস্যা কোথায় ছিল?
আকবরের বাংলা সনের প্রবর্তন বিষয়ে ইতিহাস থেকে তথ্য ও সত্যতা দেখা যাক!
* ১. প্রথমে দেখা যায়, আইন-ই-আকবরী নামক গ্রন্থের ৩০ পাতা নিয়ে পৃথিবী ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন বর্ষপঞ্জীর ধারাবাহিক বিবরণ দেখা যায়।
সবশেষে উল্লেখ রয়েছে, “তারিখ-ই-ইলাহী”। কিন্তু বাংলা সন অথবা বঙ্গাব্দের বিন্দুমাত্র বিবরণ নেই।
বাংলা সনের প্রবর্তক যদি আকবর করতেন, তাহলে আইন-ই-আকবরীতে গ্রন্থে তার উল্লেখ থাকত।
কেননা, মুঘলগণ যেটা করত ঢাকঢোল পিটিয়ে করত।
* ২. ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা রয়েছে আকবরের হিজরী সন অপছন্দ ছিল।
এজন্যই তিনি তারিখ-ই-ইলাহীর প্রবর্তন করেন। তাহলে দেখা যায়,
তিনি যদি বাংলা সনের প্রবর্তন করতেন তাহলে তার উৎপত্তি বর্ষ নিজের প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী সঙ্গে মিল রাখত। কখনও অপছন্দ হিজরী সনের সঙ্গে মিল রাখত না।
* ৩. আকবরের শাসনামলের মোঘল সাম্রাজ্যে বাংলা, এলাহাবাদ, আগ্রা, অযোধ্যা, পাটনা, কাবুল, মূলতান সহ মোট ১২টি সুবা ছিল।
তাহলে তিনি কাবুল সহ ১১টি সুবা বাদ দিয়ে কিভাবে শুধুমাত্র বাংলার জন্য আলাদাভাবে একটি বিশেষ বর্ষপঞ্জী বাংলা সন তৈরি করলেন?
* ৪. বাংলা ভূমি তখন শাসন করেছিল, রাণী ভবশঙ্করী, রাজা প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়ের মত প্রবল বিক্রমী/পরাক্রমশালী রাণী ও রাজাগণ।
এই শাসকদের সঙ্গে মোঘলদের বিরোধ ছিল এবং বহুবার মোঘলরা আক্রমণ করে দখল নিতে চেয়েছিল। প্রকতপক্ষে মোঘলদের দৃষ্টিতে তখন বাংলায় ছিল জঙ্গলরাজের শাসন এবং এই বাংলা থেকে মোঘলদের রাজধানী / শাসন কেন্দ্র বহু দূরে ছিল।
অতএব সেই সময়ের মানবতাবাদী সুশাসক হিসাবে বিখ্যাত আকবর, কোন প্রয়োজনে একটি নতুন বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন?
* ৫. পাঞ্জাব থেকে দক্ষিণ ভারত, গুজরাট থেকে কামরুপ, মণিপুর, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া হয়ে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া;
যে অঞ্চলে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রচারিত হয়েছে/স্থান পেয়েছে, এইসব অঞ্চলেই বাংলা সন শুরু হয়েছে পয়লা বৈশাখে।
তাহলে কি বলা যায়, আকবর এইসব অঞ্চলে বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন?
আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে বাংলা নববর্ষ অথবা বাংলা সনের কোনো উল্লেখ নেই এবং ফসল-ই-শান অথবা ভাল ফসলের বছর এমন কোন বিষয়ের উল্লেখ নেই।
চান্দ্র বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী তৈরি হিজরী সন, এজন্য অসময়ে রাজস্ব/কর সংগ্রহ করতে সমস্যা হচ্ছিল এবং এজন্যই আকবর সৌর বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী বাংলা সন প্রবর্তন করেন এমন কিছু উল্লেখ সেখানে নেই।
আবার বাংলা সন প্রবর্তনের পর সঠিকভাবে রাজস্ব/খাজনা সংগ্রহ হচ্ছে, এটাও পাওয়া যায় না।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই এই বিষয়ে স্পষ্ট যে, ইংরেজী সন এবং বাংলা সনের মধ্যে অনেক বছরের ব্যাবধান আছে।
২০২৩ থেকে ১৪২৯ বিয়োগ করলে আমরা পাই ৫৯৪ বছর, অর্থাৎ বাংলা সন প্রবর্তিত হয় ৫৯৪ সনের সময়ে।
এই সময়ে বাংলার সিংহাসন যিনি আহোরণ করেছিলেন, তিনি এই বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন।
ইতিহাস গ্রন্থ এবং ঐতিহাসিক তথ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ঐ সময়ে বাংলার বুকে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্রিত করে প্রথম স্বাধীন বাঙ্গালী সাম্রাজ্য তৈরী করে সিংহাসন আহোরণ করেন মহারাজা “শশাঙ্ক”।
রাজা শশাঙ্কের অধীনস্থ ছিল বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম সহ বহু এলাকা। অতএব, প্রথম বাঙ্গালী রাজা শশাঙ্কের শাসনামলেই প্রবর্তিত হয়েছিল বাঙ্গালীর নিজস্ব ক্যালেন্ডার বঙ্গাব্দ/বাংলা সন।
বাম ইতিহাসবিদদের কুশিক্ষা আমাদের বলে, সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন।
তারা যুক্তি দেখায়, ফসল উঠার সময় সম্পর্কে জানার জন্য এবং রাজস্ব কর আদায়ের সুবিধার্থে এই বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন।
কৃষকদের ফসল সংগ্রহের সময় সম্পর্কে জানা যেত, এজন্যই এই সনের নাম নাকি আবার ফসলী সন নামেও পরিচিত! বিভিন্ন গোঁজামিল তথ্য দিয়ে বলা হয়, হিজরি ৯৬৩ সালের সঙ্গে মিল রেখে, ঐ সনকে বাংলা ৯৬৩ হিসেবে ঘোষণা করে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।
শশাঙ্ক ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের কিছু সময় বাংলা তথা গৌড় রাজ্যের রাজা ছিলেন।
প্রথমে তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা অর্থাৎ বর্তমানের ভারত ও বাংলাদেশের বাংলা অঞ্চলের সামন্ত শাসক ছিলেন।
সর্বশেষ গুপ্ত সম্রাট ষষ্ঠ শতকের শেষের সময়ে (৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে) দুর্বল হয়ে পড়লে শশাঙ্ক গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনতা মুক্ত নিজেকে মুক্ত করে গৌড় রাজ্যের রাজা হিসেবে সিংহাসন আহোরণ করেন।
বিজ্ঞজনদের মতে, সেই বছর থেকেই রাজা শশাঙ্কের সিংহাসনে আরোহণের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়।
এই বিষয়ে শ্রীসুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিথ বঙ্গাব্দের উৎস কথা নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-
“সৌর বিজ্ঞান ভিত্তিক গাণিতিক হিসাব অনুযায়ী ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল, সোমবার, সূর্যোদয় সময়ই বাংলা সনের আদি বিন্দু।”
ভাষা বিজ্ঞানী রহমতুল্লাহ তাঁর রচিত ”বঙ্গাব্দের জন্মকথা” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শশাঙ্ক কর্তৃক বাংলা সন প্রবর্তন হয়।
মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বিখ্যাত গ্রন্থ “আইন-ই-আকবরী”। কিন্তু মুঘলদের এই গ্রন্থে বাংলা সন অথবা ফসলী সন প্রবর্তনের বিষয়ে কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই।
তবে ঐ গ্রন্থে পাওয়া যায়, ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইরানে প্রচলিত ”জেলালি সৌর পঞ্জিকা” অনুযায়ী ভারতবর্ষে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে “তারিখ-ই-ইলাহী” নামক একটি সৌর পঞ্জিকা প্রবর্তন করেছিলো,
কিন্তু কয়েক দশক পরে এই পঞ্জিকার ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
ঐতিহাসিকদের তথ্য মতে, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি আকবরের রাজ্যভিষেক হয়েছিল মাত্র ১৩ বছর বয়সে।
ঐ সময় থেকে যদি বাংলা সন প্রবর্তন হয়, তাহলে পহেলা বৈশাখ / বাংলা নববর্ষ ১৪ বা ১৫ এপ্রিল না হয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতো।
সবচেয়ে বড় কথা, ১৩ বছরের একজন ব্যাক্তির পক্ষে অনেক দূরে অবস্থিত প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন এলাকায় কর আদায়ের সুবিধার জন্য ফসল তোলার সঙ্গে মিল রেখে এই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে একাকী সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকটাই গোপনে বাংলা সন প্রবর্তন করা কিভাবে সম্ভব?
মুঘলদের বাংলা সন প্রবর্তনের থেকে তারিখ-ই-ইলাহী এর মতো পঞ্জিকা তৈরী অনেকটাই যুক্তিসঙ্গত।
কারণ, বেশকিছুদিন সাম্রাজ্য পরিচালনার ফলে হিজরী সনের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরেছিলেন ভারতবর্ষে সৌর বর্ষপঞ্জী প্রবর্তন করা জরুরি।
কেননা, হিজরী সন রমজান এবং ঈদের দিন নির্ধারণ ব্যাতীত অন্য ক্ষেত্রে প্রায় বিফল।
এছাড়াও ঐ সময়ের আগে নূরজাহানের পিতা ইরান থেকে আকবরের রাজসভায় এসেছিল।
অতএব, তার নিকট থেকে ইরানি সৌর পঞ্জিকার কার্যকারিতা/উপকারিতার বিষয়ে হয়তো আকবর ধারণা পেয়েছিল।
রাজা শশাঙ্ক কর্তৃক প্রবর্তিত বাংলা সনের উৎপত্তি ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল। পরবর্তীতে একাধিকবার পঞ্জিকায় তথ্য সংযোজন/পরিবর্ধনের কারণে বাংলা সনের নববর্ষ উৎসব বর্তমানে ১৪ অথবা ১৫ এপ্রিলে এসে পৌঁছেছে।
কিন্তু বাংলা সন যদি মুঘলদের দ্বারা ১৫৫৬ সনে প্রতিষ্টিত হয়, তাহলে বাংলা সনের নববর্ষ উৎসব কোনভাবেই বর্তমানে ১৫ এপ্রিলে পালিত হতে পারে না।
যদি কেউ মত প্রকাশ করে, পঞ্জিকা সংষ্কার করে ত্রুটিবিহীন করার কারণে বাংলা সন ১৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রবর্তিত হয়ে বর্তমানে ১৪/১৫ এপ্রিলে এসে পৌঁছেছে বাংলা নববর্ষ।
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন চলে আসে, এই পঞ্জিকা কে কবে কিভাবে সংস্কার করেছিল?
বর্তমানে তৈরী হওয়া ঐতিহাসিক কোনো ঘটনার পূর্বে, সেই বিষয়ে আলোচনা / নিদর্শন ইতিহাস গ্রন্থে পূর্বেই উল্লেখ থাকা একেবারেই অসম্ভব।
বাংলা সন যদি ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত হয়, তাহলে তার পূর্বে কোনো ইতিহাস গ্রন্থে বাংলা সনের বিষয়ে কোন তথ্য থাকতে পারে না।
কিন্তু মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলের বহু পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক, সনাতন ধর্মীয় গ্রন্থে বাংলা সন ও তারিখের বিবরণ পাওয়া যায়, তাহলে এই বাংলা সনের তারিখগুলো কিভাবে আসল?
নিয়ম অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রবর্তিত হওয়া সকল সন ১ থেকে শুরু হয়েছে এবং এটাই যুক্তিসঙ্গত। তাহলে বাংলা সন ১ থেকে শুরু না করে কেন ৯৬৩ থেকে শুরু করা হয়েছিল?
১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দকে বাংলা ১ সন হিসাবে প্রবর্তন করতে আকবরের সমস্যা কী ছিলো ?
প্রাচীন ভারতবর্ষের ঋষিদের প্রণীত জ্যোতিষ বিজ্ঞানে দেওয়া বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্রের নাম থেকে বাংলা সনের মাস ও সাত দিনের নামগুলো এসেছে।
তেমনি রবি, সোম অথবা বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ এই নামগুলো কিন্তু শুধু আকবরের শাসনামল থেকে ভারতবর্ষে প্রচলিত না।
তার বহু সময় পূর্ব থেকেই ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। সনাতনীদের গ্রন্থ জ্যোতিষ শাস্ত্র এবং জ্যোতিষ শাস্ত্র বেদ এর একটি অংশ।
উল্লেখ্য, বেদের রচনাকাল আজ থেকে প্রায় ৮/১০ হাজার বছর আগে।
তৎকালীন বৈদিক যুগের মহর্ষি জৈমিনী, বরাহ, মিহির, খনার মতো ভূবন বিখ্যাত মহান ঋষি/জ্যোতিষী ও পন্ডিতগণের রচিত গ্রন্থে বাংলা সন ও সাত দিনের নামগুলো কোথা থেকে এসেছিল? এই বিষয়ে বাম ও বিকৃত ইতিহাসবিদ কি বর্ণনা দিবে?
মুঘল সম্রাট আকবর কিন্তু সমগ্র ভারতবর্ষের সম্রাট হয়েছিলো এবং সমগ্র ভারতবর্ষেই ফসল উৎপাদন হতো।
তাহলে সমগ্র ভারতে রাজত্ব করা আকবর কেনো শুধু বাংলা ভূমির জন্য বাংলা সন প্রবর্তন করেছিল?
বাংলা ভূমি ব্যাতীত অন্যান্য অঞ্চলের কর কি তিনি গ্রহণ করতেন না ?
বর্তমান সময়ে বাংলা সনের বয়স ১৪২৯ বছর, সেই হিসাবে রাজা শশাঙ্ক কর্তৃক বাংলা সন প্রবর্তন হয়েছিল এটা উপরের আলোচনা থেকে নিঃসন্দেহে পাঠকদের নিকট পরিষ্কার হয়েছে।
বাংলা সনের নববর্ষে বাঙ্গালীর পথচলা শুরু হয় “বারো মাসে তেরো পার্বণ” প্রবাদের মাধ্যমে।
এরপর সারা বছর জুড়ে থাকে বাঙ্গালী হিন্দুদের অনুষ্ঠান, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য – বৈশাখ মাসের প্রথম দিন বাংলা নববর্ষ ও গণেশ পূজো,
জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে জামাইষষ্ঠী অনুষ্ঠান, আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে শুরু হয় রথ যাত্রা,
শ্রাবণ মাসের শেষের দিন মনসা পূজো, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে সনাতনী অবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মষ্টমী উৎসব,
ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা পূজো।
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দূর্গাপূজো, কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে ঐতিহ্যবাহী ভাই ফোঁটা অনুষ্ঠান।
অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান সংগ্রহের পর নবান্ন, পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে পৌষ পার্বণ ও পিঠা উৎসব।
মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজো, ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোল পূর্ণিমা এবং চৈত্র মাসের শেষ তারিখে চড়ক পূজো।
তাছাড়াও সারা বছরে অনুষ্ঠিত হয় আরও কয়েকটি পূজো। এজন্যই বলা হয় বারো মাসে তের পার্বণের মধ্যে দিয়ে বাংলা সন বঙ্গাব্দের একটি বছর হয় অতিক্রান্ত করে বাঙ্গালী সনাতনী জনগোষ্ঠী।
বাংলা সনের বারো মাসের নামের উৎপত্তি
বাংলা সনের বারো মাসের নামের উৎপত্তি হিসাবে পন্ডিতগণের মত- বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী বৈশাখ মাস।
জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী জৈষ্ঠ মাস, উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী আষাঢ় মাস, শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী শ্রাবণ মাস।
পূর্বভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী ভাদ্র মাস, অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী আশ্বিন মাস, কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী কার্তিক মাস।
মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী অগ্রহায়ণ মাস, পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী পৌষ মাস, মঘা নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী মাঘ মাস,
উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুযায়ী চৈত্র মাস।
বাংলা সনের সাত দিনের নামের উৎপত্তি
বাংলা সনের সাত দিনের নামের উৎপত্তি হিসাবে ধারণা করা হয়-
বরিবার
সূর্যের আর একটি নাম রবি। যেহুতু সূর্যসিদ্ধান্ত ভিত্তিক বাংলা নববর্ষ তাই বাংলা সনের সাত দিনের নামের অর্থ গ্রহ/নক্ষত্রদের উপর ভিত্তি করে।
সূর্য মন্ডলের গ্রহদের একমাত্র অধিপতি রবি অর্থাৎ সূর্য। সূর্য থেকেই সৌর মন্ডলের সৃষ্টি। সনাতনীগণ সূর্য কে দেবতা হিসাবে বিশ্বাস করেন।
সনাতনীগণ যে কোন মাঙ্গলিক কাজে যে পঞ্চ দেবতার আরাধনা করেন, এই পঞ্চ দেবতার অন্যতম একজন সূর্যদেব। সনাতন ধর্ম দৃঢভাবে বিশ্বাস করে সৌরজগতের গ্রহগুলো টিকে আছে সূর্যের কারণে।
বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকার করে, সূর্য পৃথিবীর সমগ্র জ্বালানী শক্তির প্রধান উৎস। এজন্যই বলা হয়, রবিবার নামের উৎপত্তি সূর্য থেকে।
সোমবার
চাঁদের আরেকটি নাম সোম। চন্দ্র পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ।
শুধু জোয়ার-ভাটাই নয়, পৃথিবীর জীব জগতের উপর চন্দ্রের প্রভাব দৃশ্যমান। এজন্যই পন্ডিতদের মতে সোম বারের উৎপত্তি চন্দ্র গ্রহের থেকে।
মঙ্গলবার
মঙ্গল গ্রহের নামের থেকে সপ্তাহের একটি দিনের নাম রাখা হয়েছে।
সৌরমন্ডলের শক্তিশালী গ্রহ মঙ্গল, মঙ্গলের ভুমন্ডলের সঙ্গে পৃথিবীর ভুমন্ডলের অনেকটা মিল পাওয়া যায়। পৃথিবীর উপর মঙ্গল গ্রহের প্রভাব লক্ষণীয়।
বুধবার
বুধ গ্রহের নাম অনুযায়ী সপ্তাহের একটি দিনের নামের সৃষ্টি। সূর্যের নিকটবর্তী এবং সৌরজগতের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম গ্রহ এই বুধ গ্রহ।
এজন্যই বুধের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনেকটা কম, পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
বৃহস্পতিবার
সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির নাম অনুযায়ী বৃহস্পতিবার নামের উৎপত্তি।
সূর্য থেকে দূরত্ব অনুসারে পঞ্চম এবং আয়তনের কারণে, সৌরজগতের বড় গ্রহ বৃহস্পতি। সূর্যমন্ডলের সবগুলো গ্রহের ভরের প্রায় ৭০% ভর বৃহস্পতির গ্রহের।
শুক্রবার
সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহ শুক্রের নাম অনুসারে শুক্রবারের উৎপত্তি। বুধ আর পৃথিবীর মতই এই গ্রহটি কঠিন পদার্থ দিয়ে তৈরি, এ কারণে শুক্র গ্রহকে পার্থিব গ্রহ বলা হয়।
পৃথিবী এবং শুক্রের মধ্যে গাঠনিক উপাদান এবং অন্যান্য মহাযাগতিক আচরণে অনেকটা সাদৃশ্য থাকার কারণে শুক্রকে পৃথিবীর বোন গ্রহ বলে।
শনিবার
শনি গ্রহের নাম অনুসারে সপ্তাহের একটি দিনকে শনিবার হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে। সনাতনী পৌরণিক গ্রন্থে বিশেষ পরিচিত এই গ্রহ।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতে শনি গ্রহ রূপে গুণে অন্যন্য। শনি গ্রহকে বেষ্টন করে থাকা চাকতিগুলো শনির বলয় নামে পরিচিত। তুষারকণা, পাথরের টুকরো আর ধূলিকণার মাধ্যমে সৃষ্ট মোট নয়টি পূর্ণ ও তিনটি অর্ধবলয় শনি গ্রহকে সবসময় বেষ্টন করে থাকে।
শনি গ্রহের গড় ব্যাস পৃথিবীর তুলনায় প্রায় নয় গুণ বড়। শনি গ্রহের অভ্যন্তরে রয়েছে লোহা, নিকেল এবং সিলিকন ও অক্সিজেন মিশ্রিত পাথর।
এর উপরে রয়েছে যথাক্রমে একটি গভীর ধাতব হাইড্রোজেনের স্তর, একটি তরল হাইড্রোজেন ও তরল হিলিয়াম স্তর এবং সবশেষে বাইরে রয়েছে একটি গ্যাসীয় স্তরের আবরণ।
শনির বায়ুমণ্ডলের উচ্চ স্তরে অবস্থিত অ্যামোনিয়া ক্রিস্টালের কারণে শনি গ্রহের রং হালকা হলুদ।
এই গ্রহের ধাতব হাইড্রোজেন স্তরে এক ধরনের বৈদ্যুতিক শক্তি প্রবাহিত হয়। এই বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে শনির গ্রহীয় চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎপত্তি।
পহেলা শব্দের উৎস
সংস্কৃত প্রথম শব্দ থেকে অশোকীয় প্রাকৃতে প্রথিলা, আর প্রথিলা থেকে সৌরসেনী প্রাকৃতে পহিলা। পহিলা থেকে থেকে হিন্দি-উর্দুতে পেহলা।
হিন্দি পেহেলা শব্দের রুপান্তরিত রুপ পহেলা শব্দ। পয়লা তদ্ভব বাংলা শব্দ। ইংরেজি সালের ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল এই পহেলা/পয়লা বৈশাখ।
দুই দেশে নববর্ষ দুই দিনে পালিত হবার কারণ
বাংলা সনের পহেলা বৈশাখ, বঙ্গাব্দ অনুযায়ী পালন করা হয়, এটা আমাদের সকলের জানা।
সাধারণত, বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ পালন করা হয় ১৪ এপ্রিল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৫ এপ্রিল পালন করা হয়।
তবে লিপ ইয়ারের কারণে মাঝেমাঝেই দুই বাংলায় একই দিনে বাংলা সনের পহেলা বৈশাখ তথা নববর্ষ উৎসব উদযাপিত হয়, যেমনটি ২০১৬ সালে হয়েছিল।
কিন্তু প্রতি বছর দুই বাংলা ভূমিতে একই দিনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন না করার কারণ জিজ্ঞাসা করেন।
এর কারণ- যখন বাংলাদেশে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতায় ছিল, তখন এরশাদ সাহেব বাংলা সনের ক্যালেন্ডার সংস্কারের নামে কিছু সুক্ষ কৌশলী বিষয় মাথায় রেখে কিছু পরিবর্তন করেন।
এরশাদের শাসনামলের শেষের সময়ে
সম্ভবত ১৯৮৮ সালের দিকে, বাংলা সনের বর্ষপঞ্জী সংস্কারের নামে একটি কমিটি গঠন করেন।
তাঁর গঠিত এই কমিটি বাংলা বর্ষপঞ্জী এমনভাবে সংস্কার করে, যার ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে একসঙ্গে পালিত হওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন একই দিনে অনুষ্ঠিত না হয়ে অন্ততপক্ষে একদিনের পার্থক্য হয়।
পন্ডিতদের মতে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সনাতনী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের সনাতনী জনগোষ্ঠীর মানসিক ও মাঙ্গলিক উৎসবের মধ্যে দুরত্ব বৃদ্ধি করতে এই বাংলা সনের বর্ষপঞ্জী সংস্কার করেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান।
পাশাপাশি দুই প্রতিবেশি দেশে যখন কোনো জাতি একই দিনে বর্ষবরণ, ঐতিহ্যবাহী, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে তখন তাদের মধ্যে এক ধরণের মানষিক বন্ধন/ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়।
বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সনাতনীদের থেকে বাংলাদেশের সনাতনীগণ এবং মানবতাবোধ সম্পন্ন মুসলমানদেরকে যথাক্রমে মুসলিম সংস্কৃতি ও ধর্মান্ধ মুসলিম তৈরী।
বাংলাদেশে প্রকাশিত বর্ষপঞ্জিতে এখন দুইটি বাংলা তারিখ লেখা থাকে। একটি প্রকৃত বাংলা সনের তারিখ এবং অন্যটি বাংলাদেশ সরকারের তৈরী বাংলা সনের তারিখ।
যদিও সরকারি কাজ ব্যাতীত বাংলা তারিখ বাংলাদেশের জনসাধারণ খুব কম ব্যাবহার করে।
বাংলা সনের প্রবর্তক কে?, বাংলা সনের ইতিহাস ও বাংলা মাসের উৎপত্তি এইসব বিষয়ে পাঠকগণ নিশ্চয়ই পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছেন!
Pingback: রাজা শশাঙ্ক | বাংলার ইতিহাসে গৌড়রাজ শশাঙ্কের কৃতিত্ব Best Article