Spread the love
পেশোয়া বাজিরাও
পেশোয়া বাজিরাও

 

পেশোয়া বাজিরাও

ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে কয়েকজন বিখ্যাত হিন্দু বীরদের নাম আলোকজ্বল নক্ষত্র রুপে বিরাজমান, তার মাঝে অন‍্যতম প্রধান এক নাম পেশোয়া বাজিরাও! অসংখ্য হিন্দু বীর মহারথীদের তালিকা দেখা যায়, ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে নজর দিলে, যাদের বীরত্ব অতি প্রশংসনীয়! বাম ও চাটুকার ইতিহাসবিদ গণ যে ইতিহাসকে যে বিকৃত করেছে সেটা একাধিকবার প্রমাণ হয়েছে। বিশেষ করে ইতিহাস বইতে পাঠ্য নিয়ে একাধিক সময় আলোচনা / সমালোচনা হয়েছে।


বর্তমান ইতিহাসের গ্রন্থ গুলোতে হিন্দু মহান বীরদের কাহিনী কোন মর্যাদা তো পায় নি, বরং লুটেরাদের হিরো বানানো হয় এ বিষয়টি একাধিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে!

আর এই বিকৃত ইতিহাস পাঠ করে বর্তমান প্রজন্ম হচ্ছে বিপথগামী! হারিয়ে যাওয়া গৌরবময় ইতিহাস থেকে আজ এমনই এক বীরের কাহিনি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে আলোকজ্বল তিনি, বীরত্বের মূর্ত প্রতীক: পেশোয়া বাজিরাও!

১৬৮০ সালের দিকের ইতিহাস, ভারতবর্ষে মুঘল শাসক দের বিরুদ্ধে মারাঠা সাম্রাজ্যের ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের নেতৃত্বে চর্তুদিকে মারাঠা সাম্রাজ্যের অভাবনীয় বিস্তার ভীত করেছিল মুঘলদের।

কিন্তু শিবাজী মহারাজের মৃত্যুর পর মুঘলরা পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই কঠিন সময়ে ১৭০০ সালে মারাঠা সাম্রাজ্যের পঞ্চম পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথের ঘরে জন্ম হয় বাজিরাও বল্লাল ভাটের।

পেশোয়া বাজিরাও এর জন্ম

জন্ম: ১৭০০ সালের ১৮ আগস্ট এক বিখ্যাত ব্রাহ্মণ বংশীয় ভট্ট পরিবারে পেশোয়া বাজিরাও এর জন্ম। বাজিরাও ছিল তার ডাকনাম। তার বাবা বালাজি বিশ্বনাথ এবং মায়ের নাম ছিল রাঁধাবাঈ।

বাজিরাও এর বাবা ছিলেন চতুর্থ মারাঠা সম্রাট সাহুর প্রথম পেশোয়া। তখনকার সময় মারাঠা রাজদরবারের প্রধানমন্ত্রীকে পেশোয়া নামে অভিহিত করা হত। পেশোয়া হবার জন‍্য একজনকে মাথা আর বাহু দুদিক থেকেই সমান কুশলী হতে হতো।

শৈশবে বাবা বালাজিকে বিভিন্ন সামরিক অভিযানে সঙ্গদানের কারণে পেশোয়া বাজিরাও এর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। এমনকি বাবার সাথে কারাবাসের অভিজ্ঞতাও তার ছিলো।

পেশোয়া বাজিরাও এর ক্ষমতায় আহোরণ

 ১৭২০ সালে বালাজির মৃত্যুর পরে, মাত্র ২০ বছর বয়সে পেশোয়া বাজিরাও নিজেকে তার বাবার পদটির জন্য উপযুক্ত দাবি করেন। বিচক্ষণ ছত্রপতি সাহু তাকে সূক্ষ্ম পরীক্ষার পরে পেশোয়া হিসেবে মনোনীত করেন। ঐতিহাসিক সুত্র অনুযায়ী, রাজসভার মধ‍্যে দাঁড়িয়ে ছত্রপতির চোখে চোখ রেখে বুক চিতিয়ে পেশোয়া বাজিরাও বলেছিলেন: আঘাত করুন, মোঘল সাম্রাজ্যের গোড়ায় আঘাত করুন, ডালপালা এমনি খসে পড়বে।

আমার পরামর্শ গ্রহণ করুন, আমি অটোকের (রাওয়ালপিন্ডির নিকটবর্তী এলাকা) দেয়ালের উপরে মারাঠা নিশান লাগিয়ে আসবো। বিচক্ষণ সাহু (ছত্রপতি) মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ঈশ্বর সহায়! তুমি হিমালয়ের চূড়াতেও এই নিশান লাগিয়ে আসবে। সেই সময় মোঘল সম্রাটগণ মদ/সুরা, নারী আর ঐশ্চর্যের নেশায় আসক্ত হয়ে রাজধর্ম ভ্রস্ট হয়ে পরছিল।


এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে উত্তর ভারত আক্রমণ করে আগ্রাসী মুসলিমদের সঞ্চিত বিশাল সম্পদ ভান্ডার নিজ হস্তগত করার পরিকল্পনা করেন পেশোয়া বাজিরাওলক্ষ: তার লক্ষ্য ছিলো বিদেশী লুটেরা মুসলিম শাসকদের আগ্রাসন থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে সমগ্র ভারতবর্ষে একক হিন্দু রাজত্ব তৈরি করা।

পেশোয়া বাজিরাও
পেশোয়া বাজিরাও

শিবাজি মহারাজের মৃত্যুর পর তৎকালীন মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ ডেকানের বহু অংশ দখল করে নেন, তার উপর মাত্র ২০ বছর বয়সেই পেশোয়া নিযুক্ত হওয়ার ফলে পেশোয়া বাজিরাও অনেক ষড়যন্ত্রের শিকার হন। এমন পরিস্থিতিতে পেশোয়া নিযুক্ত হয়ে তিনি মারাঠা সাম্রাজ্যের ধরেন এবং তার পরিচালনাতেই মারাঠারা হারানো গৌরব পুনরায় ফিরে পান।ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রায় দুইশ বছর ধরে চলা শক্তিশালী মোঘল সাম্রাজ্যকে সমূলে সমূলে বিনাশ করার এক দুর্ধর্ষ প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনযাত্রা শুরু।

সংঘাতময় ইতিহাসে জর্জরিত পেশোয়া বাজিরাও এর জীবন। হায়দ্রাবাদের নিজাম-উল-মূলক এর সাথে তার প্রথম সংঘাত বাধে। এক মোঘল রাজপ্রতিনিধি মোঘলদের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে একটি রাজ্য তৈরির চেষ্টা করেন। সাহুর নির্দেশে বাজিরাও তার সেনাবাহিনী নিয়ে প্রথমে নিজামের পক্ষে মোঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহর সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন।১৭২৪ সালের এই সখেরখেড়ের যুদ্ধে পেশোয়া বাজিরাও এর সহায়তায় জয়লাভ করে নিজাম হায়দ্রাবাদে একটি রাজ্য লাভ করেন।

কিন্তু লোভাতুর ও উচ্চাকাঙ্খী নিজাম মারাঠা পেশোয়া বাজিরাও এর মারাঠা সাম্রাজ্য দখল করার লক্ষ্যে ১৭২৭ সালে পুনে আক্রমণ করেন নিজ সেনাবাহিনী নিয়ে।কিছুটা হতবিহ্বল হলেও, বাজিরাও অতিদ্রুত তার চৌকস রণকৌশলের মাধ্যমে পালখেড় নামক স্থানে যুদ্ধে নিজামকে পরাজিত করেন। পিছু হটতে বাধ্য হয় নিজাম। পেশোয়া বাজিরাও এর এই বিজয়ের ফলে মারাঠা সাম্রাজ্যের খ‍্যাতি বৃদ্ধি পায় অনেক।সেই সঙ্গে অধিভুক্ত এলাকা থেকে মারাঠারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাজনা আদায়ের অধিকার লাভ করে।
১৭২৮ সালে জৈতাপুর নামক স্থানে বুন্দেলখন্ডের রাজা ছত্রশালকে মোহাম্মদ বাংগাশ মোঘল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে।

ছত্রশাল নিরুপায় হয়ে পেশোয়া বাজিরাও এর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে। পেশোয়া বাজিরাও তার সেনাবাহিনী নিয়ে জৈতাপুরে বাংগাশের মুঘল বাহিনীকে ঘিরে ফেলেন ও যুদ্ধে পরাজিত করেন। শোচনীয়ভাবে পরাজয় ও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মোহাম্মদ বাংগাশ। অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাংগাস আর কখনো বুন্দেলখন্ডের সাথে যুদ্ধ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লী পালিয়ে যান।

এই যুদ্ধে সাহায্য করে বিজয় অর্জন করার জন‍্য কৃতজ্ঞতাস্বরুপ রাজা ছত্রশাল পেশোয়া বাজিরাও তার পালকপুত্র হিসেবে ঘোষণা করে এবং তাকে নিজ রাজ‍্যের তিনভাগের একভাগ উপহার স্বরুপ প্রদান করেন। সেইসাথে ছত্রশাল তার মুসলিম পত্নীর মেয়ে মাস্তানিকে বাজিরাও এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করান। উল্লেখ্য, মাস্তানি ছিলেন পেশোয়া বাজিরাও এর দ্বিতীয় স্ত্রী। বাজিরাও এর প্রথম স্ত্রী ছিলেন কাশিবাঈ। বাজিরাও কাশিবাঈ এর গর্ভে দুটি এবং মাস্তানির গর্ভে একটি পুত্রসন্তান লাভ করেন।

মাস্তানি ছিলেন রুপে গুণে অতুলনীয়া। বহুবিধ দক্ষতা ছিল তার। যতটা ভালো ঘোড়সওয়ারী, তলোয়ার চালনা আর যুদ্ধবিদ্যায় ছিল ততটাই, আবার দক্ষতা ছিল ধর্মশিক্ষা, কাব্যচর্চা, সঙ্গীত আর নৃত্যে।ঐতিহাসিক মতে, পেশোয়া বাজিরাও এর অনেক বেশি প্রিয় ছিলেন তিনি। পেশোয়া বাজিরাও পুনেতে মাস্তানির জন্যে তিনি মাস্তানি মহল নামে একটি সুন্দর ও মনোরম মহল তৈরি করেন।

তাদের নিয়ে সাম্প্রতিককালে বলিউডে নির্মিত বাজিরাও-মাস্তানি সিনেমাটিঅনেক প্রশংসা পেয়েছে। মাস্তানি পরবর্তীকালে ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে  পেশোয়া বাজিরাও এর সাথে নেতৃত্ব দেন এবং বিজয় অর্জন করেন। প্রাচীন ভারতবর্ষের মানচিত্রে মোঘল সাম্রাজ্যের মানচিত্র বদলে দেন তিনি। মাস্তানির জীবনে সংঘাত শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই ছিলনা, সংঘাত ছিল তার পারিবারিক জীবনেও!

সংঘাত যেন তার জীবনসঙ্গী ছিলো! পেশোয়া বাজিরাও এর মা রাধাবাঈ ও ভাই চিমাজী আপ্পা কখনো তার মুসলিম বিবাহ মেনে নেন নি! ফলে, বিভিন্ন সময়ে মাস্তানির জীবন বহুবার ঝুঁকির মুখে পড়ে। পরিবার ও সমাজের অস্বীকৃতির কারণে পেশোয়া বাজিরাও মাস্তানির পুত্রকে, মুসলিম হিসেবেই মানুষ করেন। পরবর্তীতে শমশের বাহাদুর নামে এই পুত্র ১৭৬১ সালে পানিপথের যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়ে নিহত হন।

স্বাধীনচেতা এবং সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামিমুক্ত ছিলেন পেশোয়া বাজিরাও। তার লড়াই ছিল বিদেশী লুটেরা উগ্রবাদী মুসলিমদের শাসনের বিরুদ্ধে, মুসলিম ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলনা কোন ক্ষোভ। এ কারণে কিছু ব্রাহ্মণদের অসন্তোষের মুখে বুক ফুলিয়ে নিজের মুসলিম বংশের সূচনা করেছিলেন তিনি।

ঐতিহাসিক গণ এই দিক পর্যালোচনা করে মন্তব্য করেছেন, শুধু রাজনৈতিক ভাবে নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও পেশোয়া বাজিরাও ছিলেন একজন সংস্কারক। সেনাবাহিনীর সকল সৈনিকের কাছে আস্থা, ভরষা এবং ভালোবাসার প্রিয় ব‍্যাক্তি ছিলেন পেশোয়া বাজিরাওছত্রপতি শিবাজি মহারাজের পরে মারাঠা সাম্রাজ্য বিস্তারে পেশোয়া বাজিরাও এর অবদানই সবচেয়ে বেশি ছিল।

পেশোয়া বাজিরাও এর যুদ্ধের প্রধান কৌশল ছিলো শত্রুর দুর্বল দিক খুঁজে বের করা এবং সেখানে সঠিক সময়ে আঘাত করা। যুদ্ধক্ষেত্রে জটিল অবস্থান তৈরি করে শত্রুকে সেখানে ফেলে পরাজয়ে বাধ্য করা, শত্রুর মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দ্রুতগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া অথবা যুদ্ধক্ষেত্র তার নিজের ইচ্ছামতো নির্ধারণে বাধ্য করা বাজিরাও এর বৈশিষ্ট ছিলো।

ফিল্ড মার্শাল বার্নার্ড মন্টগোমারী তার হিস্টোরী অব ওয়ারফেয়ার বইয়ে পেশোয়া বাজিরাও এর যুদ্ধকৌশলের প্রচুর প্রশংসা করেছেন। ঐতিহাসিক সূত্র মতে, পেশোয়া বাজিরাও ২০ বছরের পেশোয়া জীবনে ৪১ টি যুদ্ধ করেছিলেন এবং প্রতিটি যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। একটি যুদ্ধেও তিনি পরাজিত হননি। বাজিরাও এর মৃত্যু নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

পেশোয়া বাজিরাও এর মৃত‍্যু:

পেশোয়া বাজিরাও এর মৃত‍্যু নিয়ে অনেকের ধারণা ১৭৪০ সালে নিজামপুত্র নাসির জং এর বিরুদ্ধে তার শেষ অভিযানে তিনি আহত হন এবং আঘাতের তীব্রতার কারণে পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন।

তবে বেশিরভাগের ধারণা তিনি খরগাও জেলায় নিজের জায়গীর পরিদর্শনের সময় জ্বর হয় হঠাৎ করে এবং মৃত্যুবরণ করেন। (কেননা, তিনি যুদ্ধে কখনও পরাজিত হন নি, এটাও একটা কারণ!)

১৭৪০ সালের ২৮ এপ্রিল তার মৃত্যুর পরে রাওয়ারখেড়ীতে নর্মদা নদীর তীরে তার শবদাহ করা হয়।


পেশোয়া বাজিরাও তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী অটোক দখল করে সেখানে মারাঠা নিশান উড়াতে পেরেছিলেন। ভারতবর্ষে মারাঠা সাম্রাজ‍্যের ভিত শক্ত করেছিলেন।

পেশোয়া বাজিরাও এর মূর্তি
পেশোয়া বাজিরাও এর মূর্তি


পেশোয়া বাজিরাও স্বাধীন ভারত গঠনের স্বপ্নকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। পুনেতে পেশোয়া বাজিরাও এর পারিবারিক বাসভবনে বর্তমানে বহু পর্যটক আসে, এখানকার প্রতি দেয়ালে গাঁথা এক মহান বীরের গল্প কান পেতে শুনতে চেষ্টা করেন কেউ কেউ! বাসভবনের সামনে যুদ্ধরত অবস্থায় মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পেশোয়া বাজিরাও এর প্রতিমূর্তিটি। ভারতবর্ষের ইতিহাসে পেশোয়া বাজিরাও নামটি আলোকজ্বল নক্ষত্র রুপে বিরাজমান!

3 thoughts on “পেশোয়া বাজিরাও

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *