ইতিহাস

তৈমুর লঙ | তৈমুর লং কে ছিলেন?

Spread the love
তৈমুর লঙ
তৈমুর লঙ

তৈমুর লঙ; বাম ও চাটুকার ইতিহাসবিদ দের মতে, তৈমুর লঙ একজন মহান বীর হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিল, কিন্তু তার থেকেও  নিষ্ঠুরতার কুখ্যাতি বেশি ছিল।

তিনি নিজেকে ইসলামের সেবক হিসেবে দাবি করত। তৈমুর এর মতে তৎকালীন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন কাফির। ভারতে তিনি কাফির নিধনে এসেছিলেন। তাঁর রচনা কৃত আত্মজীবনীমূলক ‘তুজুক-ই-তৈমুরী নামক গ্রন্থে তিনি সেই কথা বলেছেন।

আজ ভারতবর্ষে তৈমুরের আগ্রাসন ও নারকীয় তান্ডবের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

তৈমুর জন্ম  গ্রহণ করেন ১৩৩৬ সালের ৯ এপ্রিলে, সমরখন্দের প্রায় ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের কেশ শহরের নিকটবর্তী ট্রান্সঅক্সিয়ানায় ( মতান্তরে স্কারদু শহরে)।

বতর্মানে এই এলাকা উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। চাগতাই ভাষায় ‘তেমুর’ শব্দের অর্থ লোহা।
তিনি মঙ্গোলিয়ান বার্লাস উপজাতিতে জন্মগ্রহণ করেন।

তার পিতা ছিলেন তারাঘাই ( তারাকি ) মঙ্গোলিয়ান বার্লাস গোত্রের প্রভাবশালী এবং অভিজাত ব্যক্তি ছিলেন।
মায়ের নাম ছিল তেকিনা খাতুন।

ধর্মমতে তৈমুর ছিলেন নকশাবন্দী সুফি তরিকার মুসলমান। সেই সূত্রে তৈমুর নিজেকে ইসলামের একজন সৈনিক মনে করতেন।

শৈশবে মোঙ্গলিয় সেনাবাহিনীর এক অভিযানের সময় তৈমুরের মা এবং অন্যান্য ভাইদের কয়েদী করে সমরখন্দে আনা হয়।
এরপর এখানেই সে বড় হয়।

তৈমুর ফার্সি, মঙ্গোলিয়ান এবং তুর্কি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি ইসলামী আইন ও মঙ্গোলীয় শাসনতন্ত্রের অনেকটাই শিখেছিলেন শৈশবেই।

ভারতে হিন্দুদের উপর নির্যাতন ও ধর্মান্তর:

যুদ্ধবিদ্যা ছিল তাঁর সহজাত ক্ষমতার অংশ।
বিচিত্রগুণের অধিকারী তৈমুর শৈশবে বেছে নিয়েছিলেন অনৈতিকতা এবং নিষ্ঠুরতার পথ। তিনি নিজের সঙ্গী সাথীদের নিয়ে একটি দল তৈরি করে, ছোটখাট জিনিস লুট করতেন। তারা ভ্রমণকারীদের উপর আক্রমণ করে গবাদি পশু এবং পণ্যদ্রব্য ছিনিয়ে নিত।

পরবর্তীতে তরুণ বয়সে তিনি একটি ডাকাতের দল গঠন করেন। এই সময় আশপাশের এলাকায় ধনী ব্যক্তিরা আতঙ্কে থাকত।

তৈমূর লঙ হয়ে ওঠার ঘটনা:

ঐতিহাসিক মতে, ১৩৬৩ সালের দিকে একবার তৈমুর তিনি এক বণিকের ভেড়ার পাল লুট করতে যায়
ও ফিরে আসার পথে তৈমুর রাখালদের তীরের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়।

তার ডান হাত এবং ডান পা সারাজীবনের জন‍্য অকেজো হয়ে যায়।
তবে, এই বিষয়ে মতানৈক্য আছে।

অনেকেই বলে, একবার নৌবন্দরে একটি জাহাজ লুট করতে গিয়ে তীরের আঘাতে তার ডান হাত ও পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যাইহোক, তৈমুরের এই পঙ্গুত্বের কারণে ইউরোপিয়রা তাকে তৈমুর দ্য ল্যাম এবং টেমরল্যান ( তাম্বুরলেইন) নামে সন্মোধন করত।

পারস্য জাতি অবজ্ঞার সুরে তাকে সম্বোধন করত ‘তৈমুর ল্যাং’ বলে। ফারসি ভাষায় ল্যাং অর্থ হচ্ছে খোঁড়া।
ইউরোপ ও তৈমুরকে বলে ‘তাম্বুরলেইন’। 

তৈমুর দ্য লেইম’ থেকে সংক্ষেপে তাম্বুরলেইন। ইংরেজিতে লেইম অর্থ হচ্ছে খোঁড়া। আমরা বাংলা তাকে তৈমুর ল্যাং না বলে বলি তৈমুর লং।

তৈমুর লঙ
তৈমুর লঙ

তৈমুরের সেনা ও শাসক হয়ে ওঠার ঘটনা :

তৈমুর যৌবন সময়ে, তাঁর মনে দৃঢ় আশা হয়, একদিন তিনিও চেঙ্গিস খানের মতো পৃথিবী শাসন করবেন। তাই খোঁড়া পা নিয়ে যুদ্ধবিদ্যার প্রশিক্ষণ নেন তিনি এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি অস্ত্র চালনায় বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

তার সৈন্য বাহিনীর মধ্যে বেশিরভাগ ছিল তুর্কি উপজাতির। তিনি চাঘাতাই খানাত খানের সঙ্গে ট্রান্সঅক্সিয়ানা অভিযানে পরিচালনা করেন।

তার দ্বিতীয় সামরিক অভিযান ছিল খোরাসানে। এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে খরাসানে আক্রমণ করে সফলতা লাভ করেন। এই সফলতা তাকে আরো সেনা অভিযান পরিচালনায় উৎসাহী করে তুলে।
এই সময় মধ্য এশিয়া, তথা আমুদরিয়া এবং সির দরিয়া নদীবেষ্টিত এলাকা জুড়ে কোনো শক্তিশালী রাজশক্তি ছিল না।

এর ফলে এই এলাকায় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছিল।
বিশেষ করে বিভিন্ন যাযাবর দল এবং স্থানীয় নেতাদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ লাগত।

এই অঞ্চলের স্থানীয় নেতাগণ এই দ্বন্দ্ব সমাধানে ব্যর্থ ছিল। এজন্যই স্থানীয় জনগণ তাদের উপর অসন্তুষ্ট ছিল। ১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আমির কাজগান নামে একজন শক্তিশালী দলনেতা স্থানীয় নেতা চাগতাই, খানাতের সর্দার বরলদেকে অপসারণ করে নিজে ক্ষমতা দখল করেন।

১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসনের পর, তিনি ঘাতকের হাতে নিহত হন। এরপর ক্ষমতা অধিকার করেন তুঘলক তিমুর। ১৩৬০ সালে তৈমুর একজন সামরিক নেতা হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। তৈমুরের পিতার মৃত্যুর পর তিনি বার্লাস গোত্রের প্রধান হয়েছিলেন।

এসময় তিনি চাঘাতাই খানের প্রভাব ব্যবহার করে ধীরে ধীরে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকেন।
তুঘলক তিমুর তাঁকে বারলাস অঞ্চলের শাসক হিসেবে নিযোগ করেন।

উচ্চাভিলাষী তৈমুর এই ক্ষমতা পেয়ে তুঘলককে অপসারণ করে ক্ষমতা দখলের নীলনকশা তৈরি করতে থাকেন। তুঘলক বুঝতে পেরে তৈমুরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর তৈমুর আমির কাজগানের নাতি আমির হুসেইনের কাছে যান।

তিনি প্রথমে তাঁর সাথে বন্ধুত্ব করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর বোনকে বিয়ে করেন। এরপর আমির হুসেইনকে সঙ্গে নিয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করেন। এরমধ্যে সিংহাসনে বসেন তুঘলক তিমুরের পুত্র আমির খোজা। ১৩৬৪ খ্রিষ্টাব্দে আমির খোজাকে পরাজিত করে মধ্য এশিয়ার সিংহাসন আহোরণ করে।

প্রথম দিকে তৈমুর এবং হুসেইন যৌথভাবে শাসন করতে থাকে। কিন্তু তৈমুর ভাগাভাগীর ক্ষমতায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। হুসেইনকে অপসৃত করে ক্ষমতা গ্রহণের বড় বাধা ছিল তৈমুরের স্ত্রী। ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে তৈমুরের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন।

এরপর তিনি হুসেইনের সাথে পারিবারিক বন্ধন ত‍্যাগ করে হুসেনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন
এবং শেষে আমির হুসেইনকে হত্যা করে, তৈমুর নিজেকে মধ্য এশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করেন।

এই সময় তিনি হুসেইনের স্ত্রীকে বিয়ে করেন। অনেকেই তৈমুর কে চেঙ্গিস খানের বংশধর বলে, তবে তৈমুর লং এর স্ত্রী চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিল, এজন্যই তৈমুর ‘খান’ পদবি ব্যবহার না করে ‘আমির’ পদবি ব্যবহার করতেন।

তৈমুর মঙ্গোল সাম্রাজ্যে নিজের উচ্চ অবস্থান ঠিকই তৈরি করেছিলেন। চেঙ্গিস খানের বংশধর এবং আমির হুসেইনের বিধবা স্ত্রী সারা মুলক খানুমকে বিয়ে করার পর রাজ জামাতা পদবি ব্যবহার করতেন। ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দের শেষে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সমরকন্দকে তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী তৈরী করে।

তারপর তিনি বিশাল এক সেনাবাহিনী তৈরী করার উদ্যোগ নেন এবং অল্প সময়েই তিনি মধ্য এশিয়ার একটি শক্তিশালী রাজশক্তিতে পরিণত হন। তখন রাশিয়ার সিংহাসনচ্যুত সম্রাট ছিল তোকতামিশ খান। রাশিয়ার রাজশক্তি তখন অনেকটা দুর্বল ছিল।

এই অবস্থায় তোকতামিশ খান তৈমুরের সাহায্য প্রার্থনা করলে, তৈমুর সুযোগ কাজে লাগান। তিনি তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে তোকতামিশ খানের সাহায্যে রাশিয়া আক্রমণ করেন। শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে তৈমুর তোকতামিশ খানকে রাশিয়ার সিংহাসনে বসান। তারপর তৈমুর পারস্যের দিকে অভিযান শুরু করেন।

তৈমুর, পারস‍্যের কার্তিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী হেরাত নগরী অবরোধ করেন। তৈমুরের কাছে পরাজয় স্বীকার না করায়,
হেরাতের সকল নাগরিককে নির্মমভাবে হত্যা করার আদেশ দেন।

তারপর কয়েক দিনের মধ্যে হেরাত মৃত নগরীতে পরিণত হয়। এমন নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে ১৩৮৩ খ্রিষ্টাব্দে হেরাত নগরী দখল করেন। এই নিষ্ঠুরতার কথা প্রচারিত হলে, বেশকিছু শহর কোনো বাধা না দিয়ে, আত্মসমর্পণ করে।
এই সূত্রে তৈমুর প্রায় বিনাযুদ্ধে তেহরান দখল করেন।

এরপরে ধীরে ধীরে এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং ইরাকের কিছু অংশ তৈমুর দখল করেন। এই সময় কিছু কিছু শাসক তৈমুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে, তিনি তাঁদের হাতে দমন করেন।

ঐতিহাসিক মতে, আফগানিস্থানে বিদ্রোহীদের হত্যা করার পরে, তাঁদের মাথার খুলি দিয়ে একটি স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন। রাতের বেলা সেই স্তম্ভ তিনি আলোকিত করেছিলেন স্পিরিটের আলো দিয়ে। এছাড়াও ইস্পাহান শহরের ৭০ হাজার বিদ্রোহীর মাথার খুলি দিয়ে আরেকটি স্তম্ভ তৈরি করে।

কথিত আছে, পারস্য বিজয়ের পর ১৩৮৭ সালে ইস্পাহান শহরে বিদ্রোহের জেরে তৈমুরের নির্দেশে তার সেনাবাহিনী প্রায় দুই লাখ সাধারণ জনগণ হত্যা করেছিল। এমন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ১৩৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সম্পূর্ণ পারস্য সাম্রাজ্য তৈমুরের দখলে আসে।

১৩৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তোকতামিশ খান মধ্য এশিয়া আক্রমণ করেন। এর কারণে তৈমুর তোকতামিশ খানের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে তোকতামিশ খান রাশিয়ায় ফিরে যায়। তখন তৈমুর তোকতামিশ খানের বিরুদ্ধে পরিচালিত আক্রমণ স্থগিত রেখে ইরাকের দিকে নজর দেন।

১৩৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইরাক দখল করেন। এরপর তিনি তোকতামিশ খানকে শাস্তি দেওয়ার জন্য রাশিয়া আক্রমণে অগ্রসর হন। তেরেক নদীর তীরে তিনি তোকতামিশ খানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন এবং ১৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মস্কো দখল করেন।
এরপর তিনি ভারতবর্ষ দখলের জন্য সিদ্ধান্ত নেন।

তৈমূরের ভারতবর্ষ আক্রমণ :

তৈমুরের আত্মজীবনী ও বিভিন্ন রচনায় হিন্দুস্থান জয়ের কাহিনি বর্ণনা করেছেন।

তিনি তাঁর পুত্রগণ ও আমীরদের ভারতবর্ষ দখলের বিষয়ে অভিমত জানতে চাইলেন। যুবরাজ পীর মহম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘স্বর্ণ প্রসবিনী হিন্দুস্থান জয় করে আমরা হব বিশ্বজয়ী।’ যুবরাজ সুলতান হোসেন বলেন, ‘আমরা যখন হিন্দুস্থান জয় করব, তখন আমরা হব চার দেশের শাসক ও প্রভু’!

আমীরগণ বলেন, ‘যদিও আমরা হিন্দুস্থান জয় করতে পারি, কিন্তু সেদেশে আমরা যদি থেকে যাই, আমাদের সন্তান ও তাদের সন্তান সন্ততিগণ হিন্দের (হিন্দুস্থান) ভাষায় কথা বলবে,। তাঁরা হারাবে তাঁদের পূর্ব পুরুষদের শৌর্য বীর্যের ঐতিহ্য। কালক্রমে আমাদের বংশধরগণ কালস্রোতে লুপ্ত হবে।

তৈমুর তখন বলেন, আমার হিন্দুস্থান জয়ের সংকল্প অনড় অটল। তার থেকে আমি বিরত হব না এবং আমি খোদা ও কোরানের নির্দেশ প্রার্থনা করব। খোদার যে রূপ ইচ্ছা আমি তাই করব। তাঁরা সকলেই সম্মতি জানালেন। গ্রীসের অনুসরণে আরব ও পারস্যবাসীরা পৃথিবীকে ( যে অংশে জনবসতি আছে।) সাত অংশে ভাগ করত। এখানে তার চার অংশকে বোঝানো হয়েছে।

রেফারেন্সেঃ
1. Ibid, P-259

আমি সঠিক নির্দেশের জন্য পবিত্র কোরানের শরণাপন্ন হলাম, প্রথম যে আয়াতটি আমার দৃষ্টিগোচর হল, তাতে বলা হয়েছে
‘হে মহম্মদ! বিধর্মীও অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো’। উলেমাগণ যখন এই বাণীটির তাৎপর্য আমীরদের নিকট ব্যাখ্যা করলেন, নীরব লজ্জায় তাঁরা অধোবদন হলেন। তাঁদের নীরবতায় আমারও কষ্ট হল।

তৈমুর লঙ তাঁর আত্মজীবনী Malfuzat I Timuri তে হিন্দুস্থান আক্রমণের উদ্যোগ পর্ব প্রায় অনুরূপ ভাবে বর্ণনা করেছেন – এই সময় কাফেরদের বিরুদ্ধে এক অভিযানের প্রবল বাসনা আমার হৃদয় মনকে আলোড়িত করে। কারণ, আমি শুনেছি ধর্মযুদ্ধে (জেহাদ) কাফের হত্যা করলে “গাজী” হওয়া যায় এবং নিহত হলে হয় “শহীদ”।

কিন্তু আমি বিধাগ্রস্ত ছিলাম। জেহাদ কার বিরুদ্ধে? চিন নাকি হিন্দুস্থান? আমি সঠিক নির্দেশের জন্য পবিত্র কোরান শরীফের শরণাপন্ন হলাম।

প্রথম যে আয়াতটি আমার দৃষ্টিগোচর হল তাতে বলা হয়েছে, ‘হে মহম্মদ! অবিশ্বাসী কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। তাদের কঠোর শাস্তি দাও’। 

রেফারেন্সঃ
1. INSTITUTES, Political and Military of the Emperor Timur originally written in the Turkish language by the Timur…translated in English by Major Davy. P-71, 73

2. Quran P-66-9
Timur-Malfuzat-1-Timuri, P-394-395 Ouoted from The Calcutta Koran Petition, P-57-58

 

তারপর তৈমূর সকলের মতামত জানার জন্য তিনি যুবরাজ ও আমীরগণকে মন্ত্রণা সভায় আহ্বান করলেন । যুবরাজ মহম্মদ সুলতান বলেন, ‘হিন্দুস্থান এক বিশাল রত্নভাণ্ডার। সেদেশে আছে ১৭টি সোনা ও রূপার খনি। আছে পান্না, চুনি ও হিরার খনি। পাওয়া যায় টিন, লোহা, স্টিল, তামা, পারদ ইত্যাদি।

শস্যশ্যামলা হিন্দুস্থানের জলবায়ু খুব মনোরম। অধিবাসীরা যেহেতু বহু দেবতায় বিশ্বাসী, পৌত্তলিক, সূর্য উপাসক ও কাফের,
তাই  আল্লাহ্ এবং তাঁর পয়গম্বরের নির্দেশ অনুযায়ী এই দেশটিই আমাদের জয় করা উচিত।

you may also like..

বাপ্পা রাওয়াল

বিজয়নগর সাম্রাজ্য

তাজমহল নাকি তেজ মহালয়?

ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের শাসন

চীন নয়, সকলের সম্মতিতে হিন্দুস্থান অভিযানের সিদ্ধান্তই গৃহীত হল। আত্মজীবনীতে তৈমুর তাঁর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন – হিন্দুস্থান আক্রমণে আমার উদ্দেশ্য হল, কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনা করে মহম্মদের নির্দেশ অনুসারে তাদের সত্যধর্ম ইসলামে ধর্মান্তরিত করা, অবিশ্বাস ও পৌত্তলিকতার পাপ থেকে দেশকে মুক্ত করা এবং মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করা।

এর মাধ্যমে আমরা হব “গাজী” ও “মুজাহিদ”। সুতরাং ভারতের অতুল ঐশ্বর্য লুণ্ঠনের লোভ অতিরিক্ত প্রেরণা মাত্র মূল প্রেরণা হল ধর্মীয়। আল্লাহ লুণ্ঠনের জন্য ধর্মযুদ্ধের নির্দেশ দেননি। লুণ্ঠন উপরি পাওনা। পৌত্তলিক কাফেরদের নির্মূল করে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিজয় কেতন ওড়াবার জন্যই কোরানে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের বিধান।

তাই সর্বশক্তিমান আল্লাহর নির্দেশ, ‘তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাক, যতদিন না (তাদের) ধর্মদ্রোহীতা দূর হয় এবং আল্লাহর দীনধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়

রেফারেন্সঃ
(কোরান) –২-১৯৩।

চীন ও হিন্দুস্থান এই উভয় দেশই বিধর্মী। তবে চীনের পরিবর্তে হিন্দুস্থান আক্রমণের সিদ্ধান্ত হল কেন?

এরকম হতে পারে চীনে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম, তারা বহু দেবতায় বিশ্বাস করে না। কিন্তু হিন্দুরা বহু দেবতায় বিশ্বাস করে। চীন অনেক দুরে। দুর্গম পর্বত ও গোবী মরুভূমি অতিক্রম করে চীনে যেতে হবে। সেদেশের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ সম্বন্ধে হয়তে পর্যাপ্ত তথ্য তৈমুরের জানা ছিল না।

পক্ষান্তরে হিন্দুস্থান নিকটবর্তী। ইতিপূর্বে সেখানে বহুবার মুসলিম আক্রমণ ঘটেছে, সেদেশের মুসলিম জনসংখ্যাও কম নয়। হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলমানের সহযোগিতা পাওয়া যেতে পারে, অন্তত তারা সক্রিয় বিরোধিতা করবে না এরকম আশা করা যায়।

তাছাড়া হিন্দুস্থানের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, ও অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ সম্বন্ধে বিস্তৃত তথ্য তৈমুরের জানা ছিল। সম্ভবত এ সকল কারণেই তিনি হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন।

রেফারেন্সঃ
1. Timur-Malfizat-1-Timuri, P-394-395 Quoted from The Calcutta Koran Petition, P-58

১৩৯৮ সাল। কাটোর, উত্তর প্রদেশ সীমান্তের একটি ক্ষুদ্র হিন্দু রাজ্য। হিন্দুস্থানে তৈমুরের প্রথম আক্রমণ এই রাজ্যের বিরুদ্ধে।অধিবাসীরা বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জয় অসম্ভব বুঝে দুর্গম পাহাড়ে আশ্রয় নিল। তৈমুর পরিত্যক্ত নগরী লুণ্ঠন ও ধ্বংসের আদেশ দেন।

20221105 195337
তৈমুর লঙ এর আক্রমণ

তার আদেশে মুসলিম বাহিনী আল্লাহ আকবর রণধ্বনি দিয়ে পাহাড়ে উঠে হিন্দুদের আক্রমণ করে। নিহত হল অসংখ্য হিন্দু। বহু আহত হল, পালিয়ে গেল অনেকে। তৈমুর আক সুলতানকে পাঠালেন পরাজিত হিন্দু বাহিনীর নিকট।

শর্ত, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত। তাঁরা সকলেই প্রাণ রক্ষার তাগিদে ইসলাম গ্রহণ করল। তারপর অবাধ্য অবিশ্বাসীদের ছিন্নমুণ্ড দিয়ে পাহাড়ের ওপর তৈরি হল স্তম্ভ। এগিয়ে চলে তৈমুর বাহিনী। লক্ষ্য রাজস্থানের ভাটনীর (Bhatnir) রাজ্য।

20221105 202441
মাথার খুলির স্তম্ভ

রাজা দুল চাঁদ শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু রণোন্মত্ত মুসলিম বাহিনীর প্রবল আক্রমণে চূর্ণ হয় রাজপুত প্রতিরোধ। মাত্র এক ঘন্টার যুদ্ধে নিহত হয় ১০ হাজার রাজপুত। লুণ্ঠিত হয় ধন সম্পদ ও শস্যাগার। ভস্মীভূত হয় দুর্গ ও সংলগ্ন অট্টালিকা সমূহ।

রেফারেন্সঃ
1. Lane poole-Medieval India, P-155 Quoted from Dr. BR Ambedkar-Writings and Speeches, Vol-8, P-56

2 A Ghosh – The Koran And The Kafir, P-31 3. Timur-Malfuzat-I-Timuri, P-427

Quoted from The Calcutta Koran Petition, P-61

সারসুতি ( হরিয়ানা রাজ্যের অন্তর্গত সিরসা) নগরের অধিবাসীরা ইসলামের নাম পর্যন্ত শোনেনি, এইকথা শুনে তৈমুর সারসূতি অভিমুখে অগ্রসর হন। হিন্দুরা নগর ছেড়ে পালিয়ে যায়। তৈমুর তাঁদের অনুসরণ করতে অশ্বারোহী বাহিনী পাঠান তুমুল যুদ্ধ হল, নিহত হল সকল হিন্দু।

তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানগণ হল বন্দী; সম্পত্তি লুণ্ঠিত হল। সৈন্যবাহিনী ফিরে এল। সঙ্গে কয়েক হাজার বন্দী হিন্দু রমণী। তারা সকলেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। তৈমুর জানতে পারেন যে, হিন্দুস্থানের জাঠ সম্প্রদায় দুর্দান্ত প্রকৃতির এবং সংখ্যায়ও অনেক. আক্রমণের আশঙ্কায় তাঁরা দুর্ভেদ্য জঙ্গল ও মরুভূমিতে আত্মগোপন করেছে। তৈমুর তাদের দমন করতে কৃতসংকল্প হলেন।

তাঁর নিজের ভাষায়, ‘আমার হিন্দুস্থান অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য হল, কাফের হিন্দুদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ (জেহাদ) পরিচালনা করা। আমার মনে হয় এই জাঠদের দমন করা প্রয়োজন! তৈমুর বাহিনী জঙ্গল ঘিরে ফেলে।

অবরুদ্ধ হিন্দুরা মরিয়া হয়ে আক্রমণ করে, ২০০০ জাঠ নিহত হয়। তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানরা হল বন্দী। ‘সেই দিনই পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সৈয়দ বংশীয় মুসলিম গোষ্ঠীর এক প্রতিনিধি দল সৌজন্য ও বিনয়ের সঙ্গে আমার দর্শন প্রার্থনা করে। পয়গম্বরের বংশের বলে আমিও তাঁদের যথাযথ সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা করি।

যদিও মুসলিমরা ছিল জাঠদের প্রতিবেশী তবু বিদেশী আক্রমণে বিপন্ন জাঠদের প্রতি তাঁদের কোন সহানুভূতি ছিল না।
তৈমুর এমনটিই আশা করেছিলেন।

রেফারেন্সঃ
1. Ibid, P-61
2. Ibid, P-421, P-61
3. Ibid, P-61, 62 A. Ghosh-The Koran And Kafu, P-31

তৈমুর যমুনার তীরে ছাউনি দিয়ে ক‍্যাম্প করেছেন। নদীর অপর পারে লোনী (Loni) শহর ও দুর্গ।
তৈমুর দুর্গ আক্রমণ করে। রাজপুতদের স্ত্রী ও সন্তানগণ ঘরের মধ্যে জওহর প্রথায় আত্নহনন দেয়। তারপর বেপরোয়া রাজপুত বাহিনী আক্রমণ করে।

প্রচণ্ড লড়াই হয়। কিন্তু তারা পরাজিত ও নিহত হয়। অনেকেই বন্দী হয়। তাদেরও পরদিন করা হয় হত্যা। তৈমুর আদেশ দিলেন, শেখ, সৈয়দ ও উলেমাদের গৃহ ব্যতীত হিন্দুদের সকল বাড়ি লুঠ ও দুর্গ ধ্বংস করতে হবে। পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে লক্ষ বন্দীকে হত্যা এক নজিরবিহীন ঘটনা।

রেফারেন্সঃ
1. Timur-Malfuzat-1-Timuri, P-433 Quoted from the Calcutta Quran Petition, P-62

দিল্লীতে তৈমুরের ভাণ্ডব ও সতীদাহের সূচনা :

১৩৯৮ সালে তৈমুর লং এর হিন্দুস্থান অভিযান শুরু হয়। দিল্লীতে তখন তুঘলক বংশের শাসন ছিল। ১৩৮৮ সালে ফিরোজ শা তুঘলকের মৃত্যু হয়। কোনো যোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকায় দুর্বল সাম্রাজ্য প্রায় ভাঙনের মুখে। মামুদ তুঘলক দিল্লীর সুলতান। একের পর এক রাজ্য জয় করে তৈমুর লং দিল্লীর দ্বারপ্রান্তে এসে শিবির স্থাপন করেছেন।

১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ ডিসেম্বর দিকে প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিন্ধু নদের পাড়ে উপস্থিত হন তৈমুর। ‘দিল্লীর সুলতনগন পৌত্তালিকতার উচ্ছেদ না করে পৌত্তালিকদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করছে,’ এই অজুহাতে তিনি দিল্লী আক্রমন করেন।

দিল্লীর অভিমুখে যাত্রাপথে দীপালপুর, ভাতনেইর সহ বহু স্থান লুন্ঠন করে এবং অসখ্য নরনারীকে হত‍্যা করে দিল্লীর উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হলেন।

বহু লক্ষ কাফের হিন্দু হত্যা করেও লক্ষাধিক হিন্দু তাঁর শিবিরে বন্দী। পেছনে শত্রু রেখে যুদ্ধ যাত্রা নিরাপদ নয়,
প্রধান আমীরদের এই পরামর্শ মেনে তৈমুর সেই অসহায় শৃঙ্খলিত লক্ষ হিন্দু বন্দীকে হত্যার আদেশ দেন। তৈমুর আত্মজীবনীতে লিখছেন, ধার্মিক ও মহাজ্ঞানী মৌলানা নাসিরুদ্দিন হিন্দুস্থান অভিযানে আমার সঙ্গী ছিলেন।

তিনি এত দয়ালু ছিলেন যে জীবনে একটি চড়ুই পাখিও মারেননি। কিন্তু আমার আদেশ পেয়ে তিনি ১৫ জন কাফের হিন্দুকে নিজ হাতে হত্যা করেন। বিদ্বান, ধার্মিক ও দয়ালু বলতে মুসলমান কি বোঝে, তার এক সুন্দর দৃষ্টান্ত মৌলভী নাসিরুদ্দিন।

রেফারেন্সঃ
2. Ibid, P-435-436, 63 A. Ghosh-The Koran And The Kafir, P-32

সুলতান মামুদ শা তুঘলক অবশ্য বাধা দিয়েছিলেন, কিন্তু বৃথা সে প্রচেষ্টা। ঐতিহাসিক মতে, দিল্লীর সেনাবাহিনী তাঁদের হস্তিবাহিনী নিয়ে তৈমুরকে আক্রমণ করেন। তৈমুর কৌশল হিসেবে হাজার হাজার উটের পিঠ খড় দিয়ে বোঝাই করেন। এরপর খড়ে আগুন লাগিয়ে উটগুলোকে হস্তিবাহিনীর দিকে পরিচালনা করেন।

সুলতানের হস্তিবাহিনী জ্বলন্ত উট দেখে ভয় পেয়ে যায়। যুদ্ধাবস্থা হিতে বিপরীত হয়ে যায়।
হাতিগুলো উল্টো ঘুরে সুলতানকেই আক্রমণ করে বসে। নিজ হাতি ও বিপক্ষ হিংস্র যোদ্ধা তৈমুরের হাতে পরাজিত হয় দিল্লির শাসক। দিল্লী তৈমুরের অধিকারে যায়।

তিনি তাঁর দুর্ধর্ষ তুর্কী সেনাদের আদেশ দিলেন নির্বিচারে হিন্দু হত্যার। হিন্দুরা তাদের গৃহে আগুন ধরিয়ে দিল। জীবন্ত ভস্মীভূত হল তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানগণ। অতঃপর তারা বাধা দিল তুর্কীবাহিনীকে। অসম যুদ্ধ। অগণিত হিন্দু প্রাণ দিল। দিল্লী প্লাবিত হল হিন্দুরক্তে, রাজপথে তৈরি হল শবদেহের পাহাড়।


তিনদিন ধরে চলল ১৫০০০ তুর্কী সৈন্যের এই রক্ত হিম করা তাণ্ডব। হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ। প্রত্যেক সৈন্য নিয়ে এল অন্ততঃ ৫০/১০০ জন বন্দী। তৈমুরের নির্দেশে কোনো মুসলমান নিহত হয়নি। লুণ্ঠিত হয়নি তার গৃহ। সৈয়দ, উলেমা ও অন্যান্য মুসলমানের গৃহ ব্যাতীত সম্পূর্ণ শহরটি পরিণত হল ধ্বংসস্তূপে।

দিল্লী নগরীতে কয়েকদিন ধরে পৈশাচিক হত্যাকান্ড ও লুণ্ঠনের পর তৈমুর সিরি, জাহাপনা ও পুরাতন দিল্লী সহ আরো তিনটি শহরে প্রবেশ করে একইভাবে লুঠ ও হত্যা করে তৈমুর বাহিনী।

দিল্লী হত্যাকান্ড এমন পৈশাচিক এবং এত পরিমান মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল যে, এই হত্যা কান্ডের পরবর্তী দুইমাস পর্যন্ত দিল্লীর আকাশে কোন পাখি উড়ে নাই ।

ঐতিহাসিকদের মতে তৈমুর মোট ১৭ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করেছিলেন যা সেই সময়ের হিসাবে সারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫-৭% ।

তথ্যসুত্রঃ Wikipedia.

বিভিন্ন স্থানে মুসলিম রাজ কর্মচারীগণ খবর প্রচার করে করে হিন্দুদেরকে ইসলাম গ্রহন করতে নির্দেশ দেয়,
নির্দেশ না মানলে তৈমুরের বাহিনীকে সংবাদ দিবে, এই ভয়ও দেখানো হয়। এর ফলে বিভিন্ন স্থানে ভয়ার্ত মানুষ দলে দলে মুসলমান হতে লাগল। বাংলায় প্রবাদ আছে, “শুনে মুসলমান” কথাটি এই সময় থেকে প্রচলিত!

তৈমুর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, দিল্লীতে আমি ১৫ দিন ছিলাম। দিনগুলি বেশ সুখে আনন্দেই কাটছিল। দরবার বসিয়েছি, বড় বড় ভোজসভা দিয়েছি। তারপরই মনে পড়ল কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই আমার হিন্দুস্থানে আসা। খোদার দয়ায় আমি সর্বত্রই সাফল্য পেয়েছি।

লক্ষ লক্ষ কাফের হিন্দু আমি বধ করেছি, তাদের গরম রক্তে ধৌত হয়েছে ইসলামের পবিত্র তরবারি। তাই এখন আরাম আয়েসের সময় নয় বরং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করা উচিত। বিলাসিতা নয় চাই যুদ্ধ, কাফেরদের রক্তেই হোক পরম তৃপ্তি।
এগিয়ে চলে তৈমুর বাহিনী আল্লাহ আকবর  রণহুঙ্কারে চারিদিক প্রকম্পিত করে।

রেফারেন্সঃ
1. Timur Malfuzat- 1 Timuri, P-445-446 Quoted from The Calcutta Quran Petition, P-63-64

A. Ghosh-The Koran And Kafir, P-32 2. Timur-Malfuzat-I-Timuri, P-448

Quoted from The Calcutta Quran Petition, P-64

হরিদ্বার হিন্দুদের পুণ্যতীর্থ। পুণ্য স্নান উপলক্ষ্যে গঙ্গাতীরে সমাগত লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী। অধিকাংশই বৃদ্ধ বৃদ্ধা।

 

নিরস্ত্র পুন্যার্থী জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তৈমুর বাহিনী। অনেকে পাহাড়ে পালিয়ে গেলেও বাঁচতে পারেনা। প্রায় সকলেই নিহত হয়। গঙ্গাজল হল রক্তবর্ণ, পাহাড় থেকে নেমে এল রক্তের স্রোত। কালের ব্যবধানেও তৈমুরের অত্যাচারের দানবীয় বীভৎসতার স্মৃতি কিছুমাত্র ম্লান হয়নি।

ঐতিহাসিক Will Durant বলেন, ১৩৯৮ সালে তৈমুর সিন্ধুনদ অতিক্রম করে হিন্দুস্থান আক্রমণ করেন।
যাঁরা পালাতে পারেননি তাঁদের সকলকে হত্যা অথবা বন্দী করেন। দিল্লীর শাসক মামুদ তুঘলককে পরাস্ত করে অধিকার করেন দিল্লী, নির্বিচার চিত্তে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেন ১,০০,০০০ বন্দীকে।

দিল্লী নগরী লুণ্ঠন করে ফিরে যান সমরখন্দে, সঙ্গে লক্ষ বন্দী নারী ও দাস। হিন্দুস্থানের জন্য রেখে গেল অরাজকতা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী’। পণ্ডিত নেহেরুর বিচারে তৈমুরের যে রূপটি ফুটে ওঠে তা মনে হয় বীভৎসতায় তুলনাহীন। তিনি বলেন, ‘তৈমুর ছিলেন নিঃসন্দেহে সুদক্ষ রণনিপুণ সেনাপতি, কিন্তু পুরাপুরি বর্বর।

তিনি যেখানেই গেছেন সে স্থান হয়েছে জনশূন্য শ্মশান, দেখা দিয়েছে মহামারি ও অপরিসীম দুঃখ দুর্দশা।
নরমুণ্ড দিয়ে বিশাল পিরামিড তৈরি করে তিনি পেতেন অপার আনন্দ!’ চেঙ্গিস খাঁ ও মঙ্গল বাহিনী ছিল নিষ্ঠুরতা ও ধ্বংসের প্রতীক। কিন্তু তাঁরা তাঁদের সমসাময়িক মানুষের মতো ছিল।

তৈমুর ছিলেন শতগুণ নির্মম। নির্মম ও ভয়ংকর দানবীয় অত্যাচারের জন্যই তিনি সকলের থেকে স্বতন্ত্র। এক স্থানে ২০০০ জীবিত মানুষকে স্তম্ভের আকারে সাজিয়ে তাঁদের চারিদিকে ইট গেঁথে জীবন্ত কবর দেন।

1. Ibid, P-459, P-65

12. Will Durant – The Story of Cizilization, P-463

“সে কয়েক মাস মাত্র ভারতে ছিল, লিখেছেন নেহেরু। “কেবল দিল্লীতে এসেই ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু এই অল্প দিনেই তাঁর পথের দুই ধারের সমস্ত নাশ করে, যাঁদের হত্যা করেছিল তাঁদের মুণ্ড দিয়ে পিরামিড তৈরি করেছিল।”

শোনা যায়, চেঙ্গিস খান তার শত্রুর কাটা মাথা না দেখলে বিশ্বাস করতেন না যে, সত্যি তার শত্রু নিহত হয়েছে। এজন্যই সৈন্যরা শত্রুর মুণ্ডু কেটে এনে রাখতেন চেঙ্গিস খানের সিংহাসনের পদতলে। তারপরই মিলত তার আত্মতুষ্টি।

নেহেরুর দৃষ্টিতে তৈমুরের হৃদয় ছিল বর্বর যাযাবরের। দিল্লীর পর তৈমুর মীরাট, হরিদ্বার ও জন্মু জয় করেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তৈমুরের আক্রমণের মত নৃশংস ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড খুব কমই ঘটেছে।

জনৈক ঐতিহাসিকের মতে তৈমুর লঙের ভারতবর্ষ আক্রমণের ফলে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

দুই জাতির মধ্যে বিদ্বেষ স্থায়ীরূপ লাভ করেছিল। তৈমুরের আক্রমণের ফলে, মুসলমানদের ভয়ে হিন্দুরা তাদের মেয়েদের অল্পবয়সে বিবাহ দিতে শুরু করেছিল!

হিন্দু-সমাজের অধিকাংশ কুসংস্কার ও কুপ্রথা মুসলিম শাসনের অনিবার্য পরিণতি। বাল্য বিবাহ ও সতীদাহ এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হিন্দু নারীর প্রতি মুসলমানের লোলুপদৃষ্টি আজ প্রবাদে পরিণত! মুসলমান শাসকদের “সিন্ধুকী” নামে এক শ্রেণীর কর্মচারী ছিল।

তারা গ্রাম শহরে খোঁজ নিত কোন হিন্দুর বাড়ীতে অবিবাহিতা কন্যা, সুন্দরী বধূ বা অল্পবয়সী বিধবা আছে। কোন সংবাদ পেলে যথাসময়ে তা তারা মনিবের নিকট পৌঁছে দিত, এবং অনতিবিলম্বেই হতভাগিনীর স্থান হত হারেম খানায়!

রেফারেন্সঃ
1. Pt. Nehru – Glimpses of World History, P-250 2. পণ্ডিত নেহেরু ভারত সন্ধানে, পৃ. ২০১

সিকান্দার শাহ ছিলেন অত্যান্ত ধার্মিক মুসলমান ছিলেন, তিনি ও হিন্দুদের উপর নির্মম নির্যাতন করতেন। তার আদেশে মথুরার বিখ্যাত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়। তিনি হিন্দুদের যমুনা নদীতে স্নানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন।

জনৈক ব্রাহ্মণ “হিন্দু ধর্ম ইসলাম ধর্ম অপেক্ষা কোন অংশেই হীন নহে” এই কথা বলার অপরাধে সুলতানের আদেশে প্রাণ হারিয়েছিল। তিনি প্রচণ্ড হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম মতে পরম ধার্মিক মুসলমান শাসক।
তার অত্যাচারে এবং আদেশে কাশ্মীরের হিন্দুগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে বাধ্য হয়েছিল।

(সুত্রঃ- ভারত ইতিহাস কথা, ডক্টর কে সি চৌধুরী, পৃ-১৩৭ )

3. Pt. Nehru Glimpses of World History, P-251 4. Dr. B. R. Ambedkar-Writings and Speeches, Vol-8, P-66

তখন মুসলমানের রাজত্ব। হিন্দু তার দাসানুদাস, সর্ব অধিকার বঞ্চিত। দিন কাটে তার ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মধ্যে। সাধারণ মুসলমানেরও হাবভাব প্রায় নবাব বাদশার মতো। কোন হিন্দু নারীর প্রতি নজর পড়লে তাঁর আর রক্ষা নেই।

পিতা মাতা সদাই ভয়ে কম্পিত। অল্পবয়সেই তাই গোত্রান্তরের চেষ্টা। বিবাহ একটা বাধা তো বটে। সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ও কেটে যেত। মুসলিম শাসনকালে অমানবিক সতীদাহ ঘটনার যে বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়, তারও এই একই কারণ।

এ পৃথিবীতে কিছুই অবিমিশ্র নয়। যার ভাল আছে, তার মন্দও আছে। সেই সুদীর্ঘ পরাধীনতা, চরম অরাজকতা ও স্বৈরাচারী মুসলিম শাসনে হিন্দু তাঁর ধর্ম ও সমাজ রক্ষার প্রয়োজনেই রক্ষণশীল হতে বাধ্য হয়েছে।

ফলে সৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ কুসংস্কার, ভেদাভেদ। পরিণামে জাতি হয়েছে দুর্বল। কিন্তু যদি এরকম না হয়ে হিন্দু ধর্ম তার স্বাভাবিক উদারতা বজায় রাখত, তবে কি হত?

হয়তো ধর্ম ও জাতির অস্তিত্বই লোপ পেত। যেমন ঘটেছে পারস্য (ইরান), ইরাক (ব্যাবিলন) ও মিশরে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ওই সকল দেশে খুব উন্নত ধরনের সভ্যতা ছিল। কিন্তু ওই সকল দেশ ইসলামের শাসনাধীন হওয়ার পর নিজেদের স্বাতন্ত্র্য আর রক্ষা করতে পারেনি।

তাই তাঁদের সুপ্রাচীন গৌরবময় সভ্যতার চিহ্ন মাত্রও আজ অবশিষ্ট নেই। কিন্তু হিন্দুস্থান হাজার বছর ধরে মুসলিম তাণ্ডব সত্ত্বেও তার ধর্ম ও সমাজকে সে রক্ষা করতে পেরেছে, তার অন্যতম কারণ হিন্দু ধর্মের কৃত্রিম রক্ষণশীলতা।

যা বর্মের মত ধর্ম ও সমাজকে রক্ষা করেছে। তৈমুর ভারতবর্ষ থেকে বহু মূল্যবান সম্পদ লুট করেন। ঐতিহাসিক মতে, তৈমুর ভারতে থাকাকালীন সময়ে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ হারানোর সংবাদ পান।

ফলে ভারতবর্ষ থেকে তিনি সমরখন্দে ফিরে যান। ১৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় বাগদাদ আক্রমণ করেন। অনায়াসেই তৈমুর বাগদাদ দখল করেন।

এবার ও তৈমুরের আদেশে বাগদাদের ২০ হাজার বিদ্রোহীর শিরোশ্ছেদ করা হয়। এই সময় অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান বায়েজিদ, তৈমুরের নিষ্ঠুর ঘটনা শুনে  ক্রোধান্বিত হন।

তিনি তৈমুরকে সতর্ক বার্তা প্রেরণ করেন। তৈমুর এই বার্তায় অপমান মনে করে এবং অটোমান সাম্রাজ্য আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

১৪০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে তুরস্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সুলতান বায়েজিদ সংবাদ পেয়ে, নিজেও  বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান। ১৪০২ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় দুই বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অটোমান সুলতান বায়েজিদ বন্দী হন এবং পরবর্তীতে তিনি বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

সেই সময়ে অটোমানদের দাপটে ইউরোপ তটস্থ ছিল। এই যুদ্ধ জয়ের পরে ফ্রান্স, স্পেন সহ অনেক ইউরোপীয় দেশ তৈমুরের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করে। শোনা যায়, তৈমুর বসন্ত ঋতুতে অভিযান পরিচালনা করতেন। তবে তার শেষ যুদ্ধযাত্রা ছিল প্রচণ্ড শীতের মধ্যে।

তৈমুর লং তুরস্ক থেকে ইরান পর্যন্ত এবং মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল তার সাম্রাজ্য ভুক্ত করার পর চীন দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন।

সে কারণেই সৈন্য বহর নিয়ে চীনের মিং সাম্রাজ্য দখলের জন্য অগ্রসর হয়েছিলেন। তবে তার এই স্বপ্ন আর পূর্ণ হয়নি। যাত্রা পথেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৪০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ( মতান্তরে, ১৯ ফেব্রুয়ারি ) তৈমুর মৃত্যুবরণ করেন।

তৈমুর লং এর স্ত্রী গণ :

তার স্ত্রীর তালিকা অনেক দীর্ঘ।
বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের সূত্রে অনুযায়ী যে নামগুলো পাওয়া যায়, তা হল : সারায় মুল্‌ক খানুম, চুলপান মুল্‌ক আঘা, আলজাজ তুর্খান আঘা, তুকাল খানুম, দিলশাদ আগা…

তৈমুরের ৪৩ জন স্ত্রী এবং উপপত্নী ছিল। তার স্ত্রী এবং উপপত্নীদের বেশিরভাগ ছিল, দখল করা রাজ্যের রাজকন্যা অথবা রাজাদের স্ত্রী ও সঙ্গী। বিভিন্ন রাজ্য জয় করার পর তিনি নিজের সঙ্গী হিসেবে তাদেরকে এনেছিলেন। পরবর্তীতে তৈমুর তাদের বেশ কয়েকজনকে বিয়ে করেছিল।

কিছু ইতিহাসবিদ দের মতে, তৈমুর নিয়মিত মদ খেতেন। ব্রিটিশ ভূগোলবিদ ক্লেমেন্টস মার্খামের বর্ণনা অনুযায়ী, তৈমুর লং মৃত্যুবরণ করার পর তার দেহ কস্তুরি এবং গোলাপজল দ্বারা সুসজ্জিত করে একটি উন্নত বস্ত্র দিয়ে আবৃত করে কাঠের কফিনে সমরখন্দে পাঠানো হয়েছিল।

তৈমুরের সমাধি রহস্য :

তৈমুর লং এর রাজধানী সমরখন্দে তৈমুর কে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাধিস্থ করা হয়। এরপর দীর্ঘ সময় কেটে যায় ফলে,
কয়েক শতাব্দী ধরে তার সমাধির সঠিক অবস্থান হারিয়ে যায়।

20221105 194604
তৈমুরের সমাধি

জোসেফ স্ট্যালিন ১৯৪১ সালে প্রখ্যাত রাশিয়ান নৃবিজ্ঞানী মিখাইল গেরাসিমোভ কে তৈমুর লং এর দেহাবশেষের উপর বিভিন্ন গবেষণার জন্য সমরকান্দে পাঠিয়েছিলেন।

নৃবিজ্ঞানী গেরাসিমোভ নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, জীবাশ্ম বিজ্ঞান এবং ফরেনসিক বিজ্ঞানের উপর ভিত্তিকরে প্রথম ফরেনসিক মুখচ্ছবি তৈরির কৌশল আয়ত্ব করেন।

তিনি রাশিয়ায় প্রখ্যাত জার ইভান দ্য টেরিবলের মাথার খুলি থেকেও চেহারার অবয়ব তৈরি করেন। কোন এক অজানা কারণে জোসেপ স্ট্যালিন চতুর্দশ শতাব্দীর বিখ্যাত ত্রাস তৈমুর লং এর মুখচ্ছবি এবং অন্যান্য বিষয়েও জানতে আগ্রহী হন।

নৃবিজ্ঞানী গেরাসিমোভ নিজের গবেষণা দলসহ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত উজবেকিস্তানের সমরকান্দে পৌঁছান। গেরাসিমোভ’র উদ্দেশ্য ছিল তৈমুর লং এর সমাধির অনুসন্ধান এবং দেহাবশেষ নিয়ে গবেষণা ও তার মাথার খুলি থেকে চেহারার প্রতিচ্ছবি তৈরি করা।

রাশিয়ার এই পরিকল্পনার কথা শুনে সমরখান্দের স্থানীয় লোকেরা ভীত হয়ে পড়েন। তারা সেখানে তৈমুর লং এর একটি ভয়ঙ্কর অভিশাপ সম্পর্কে অভিহিত ছিল। ফলে স্থানীয়রা গেরাসিমোভ’কে তৈমুর লং এর সমাধির একটি ভয়াবহ অভিশাপ সম্পর্কে সতর্ক করেন। তবে রাশিয়ান এই নৃবিজ্ঞানী সমাধির অভিশাপের কথা অবিশ্বাস করেন।

তিনি কুসংস্কার হিসেবে বিবেচনা করে বিষয়টি গুরুত্ব দেন না।
গেরাসিমোভের নেতৃত্বে রাশিয়ান নৃতাত্ত্বিক দল সমরকান্দে তৈমুর লং এর সমাধি এবং দেহাবশেষের সন্ধান করতে থাকেন। অবশেষে ১৯৪১ সালের ১৯ জুন বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রের ভিত্তিতে গবেষক দলটি তৈমুর লং এর সমাধি আবিষ্কার করেন।

সমাধি উন্মুক্ত করে তৈমুর লং এর দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। অবাক করা বিষয় হলো, কয়েক শতাব্দী পূর্বে সমাধিস্থ করার সময়ের সুগন্ধি তেলের গন্ধ তখনো বিদ‍্যমান ছিল। নৃতত্ত্ববিদরা সমাধিটি উত্তোলন করার পর একটি অদ্ভুত লিপিবদ্ধ অভিশাপ বার্তা দেখতে পান।

যার অর্থ ‘যারাই আমার সমাধিটি খুলবে, তারা আমার চেয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণকারীর শিকার হবে।’ নৃবিজ্ঞানীর দল এই অভিশাপকে গুরুত্ব দেয়নি। আধুনিক যুগের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে তারা এমন কোনো অভিশাপ কিংবা সতর্কতা স্বাভাবিক ভাবেই মানতে পারেন না।

তাই, এটাকে মধ্যযুগীয় অভিশাপ হিসেবে উপেক্ষা করে নৃবিজ্ঞানীরা সমাধিস্থল থেকে তৈমুর লং এর দেহাবশেষ সংগ্রহ করে গবেষণার জন্য মস্কোতে নিয়ে যান।

সবচাইতে অবাক করার বিষয় হল, এই ঘটনার ঠিক তিন দিন পর ১৯৪১ সালের ২২ জুন আকস্মিকভাবে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করে। কাকতলীয় ভাবে, তৈমুরের সেই অভিশাপই যেন সত্য প্রমাণিত হল! রক্তক্ষয়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া।

এই যুদ্ধে আনুমানিক ৩০ মিলিয়ন রাশিয়ান মৃত্যুবরণ করে।
জার্মানির হিটলারের ভয়াবহ আক্রমণ শুরু হওয়ার পর নৃবিজ্ঞানী গেরাসিমোভ তৈমুর এর অভিশাপের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠেন।

তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে নিজেই স্ট্যালিনকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করেন। ১৯৪২ সময়ের মধ‍্যে তিনি তৈমুরের অবয়ব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

স্টালিন নিজেই একজন অন্ধবিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। তিনি নৃবিজ্ঞানীর কাছে তৈমুরের অভিশাপের বিষয়ে বিস্তারিত জানার পর আর দেড়ী করেননি। স্ট্যালিন দ্রুত তৈমুর লং এর দেহাবশেষ পুনরায় দাফন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, একটি বিশেষ বিমানে তৈমুরের দেহাবশেষ সমরখন্দে পাঠিয়ে দেন। ১৯৪২ সালের নভেম্বরে তৈমুরের দেহাবশেষ পুনরায় সমাহিত করা হয়। তারপর তৈমুরের সমাধি যত্নসহকারে সিল করে দেয়া হয়।

অবাক করার বিষয় হল, তৈমুরকে পুনরায় সমাহিত করার কয়েক সপ্তাহ পর যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন হয়। রাশিয়ায় জার্মান সৈন্যদের জয়যাত্রা থেমে যায়। রাশিয়ানরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়।

এটি ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। স্ট্যালিনগ্রাদ যুদ্ধের ফলাফল শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য নয়,
বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়েছিল বলে মনে করা হয়।

অন‍্য একটি সূত্র থেকে জানা যায়, তৈমুরের দেহাবশেষ বহনকারী বিমানটি মস্কো থেকে সমরখন্দে যাওয়ার পথে ইচ্ছাকৃতভাবেই স্ট্যালিনগ্রদের উপর দিয়ে উড়ে যায়। অনেকেই বিশ্বাস করেন, এ কারণেই হয়তো স্ট্যালিনগ্রাদ অভিশাপ মুক্ত হয় এবং রাশিয়ানরা বিজয় অর্জন করে।

পরবর্তীতে তৈমুরের সমাধিসৌধে একটি অপূর্ব কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। যা গুর-ই-আমির নামে পরিচিত। বর্তমানে এটি উজবেকিস্তানের সমরকন্দের একটি অন‍্যতম পর্যটন কেন্দ্র।

স্বাভাবিক ভাবেই তৈমুরের অভিশাপ নিয়ে হয়তো অনেকের মনে কৌতূহল জাগতে পারে, এই অভিশাপটি কি বাস্তব ছিল? নাকি শুধুমাত্র অতিপ্রাকৃত মানব কল্পনার সঙ্গে মিলিত এক বিস্ময়কর কাকতালীয় ঘটনা? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো কখনই দেয়া সম্ভব নয়!

তবে মিখাইল গেরাসিমোভের মতো একজন বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানীর এক্ষেত্রে ধারণা পরিবর্তন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে তিনি তৈমুরের অভিশাপ মধ্যযুগীয় কুসংস্কার হিসেবে উপেক্ষা করেন। তবে এই অজানা রহস্যময় অভিশাপের বিষয়ে তিনি আর বাড়াবাড়ি করেননি।

জোসেফ স্ট্যালিনকে সবকিছু জানিয়ে তিনি যথাযথ রীতিনীতি এবং অচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে তৈমুর লং কে পুনরায় সমাধিস্থ করেন। একজন মহান বীর হিসেবে তৈমুর যতটা খ্যাতি লাভ করেছিল, তার থেকেও  নিষ্ঠুরতার কুখ্যাতি বেশি ছিল।

তিনি নিজেকে ইসলামের সেবক হিসেবে দাবি করত। তার মতে তৎকালীন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন কাফির। ভারতে তিনি কাফির নিধনে এসেছিলেন। তাঁর রচনা কৃত আত্মজীবনীমূলক ‘তুজুক-ই-তৈমুরী নামক গ্রন্থে তিনি সেই কথাই বর্ণনা করেছেন।

12 thoughts on “তৈমুর লঙ | তৈমুর লং কে ছিলেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *