ইতিহাসআলোচিত সংবাদধর্মসনাতন ধর্ম

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ | মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা | শিবাজী মহারাজের ইতিহাস

Spread the love
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ; ভারত মাতার ইতিহাস খ‍্যাত অন‍্যতম এক শ্রেষ্ঠ সন্তান, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোষ বলেছিলেন, ভারত রত্নগর্ভা! যুগে যুগে তিনি রত্ন সন্তান প্রসব করে আসছে! তার দুরদর্শী বক্তব্যের সত‍্যতা পাই, অতীত ইতিহাসের দিকে নজর দিলে!
ভিনদেশী লুটেরা যখন ভারতবর্ষের বুকে উন্মত্ততা চালাতে এসেছে, তখনই কেউ না কেউ রক্ষক হয়ে সমগ্র দেশকে রক্ষা করে আক্রমণকারী দের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে! আজ আপনাদের মাঝে ভারতবর্ষের এমনি এক বীর সন্তানের ইতিহাস তুলে ধরব!

পূর্বে প্রকাশিত আর্টিকেল : তাজমহল নাকি তেজ মহালয়?

Table of Contents

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের ইতিহাস 

ভারতে মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকা শিবাজী ভোঁসলে / ছত্রপতি শিবাজী রাজে ভোঁসলে, যিনি ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ / শিবাজী মহারাজ নামে আমাদের মাঝে পরিচিত। তিনি সমগ্র ভারতবর্ষে স্বাধীন সার্বভৌম শাসন প্রতিষ্ঠা ও জাতিকে বিদেশী, জঙ্গি ও আগ্রাসীদের হিংস্র থাবা থেকে মুক্ত করার পথ প্রদর্শক।
সেই হিসাবে তিনি একজন জাতীয় বীর এবং অমর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গ্রহণযোগ্য। মহারাণ প্রতাপের মতো বীর ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ও ছিলেন জাতীয়তার জীবন্ত প্রতীক।

তিনি ১৬২৭ সালের ৬ই এপ্রিল, বাংলা ১৬৩০ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনে জেলার জুন্নার শহরের নিকটবর্তী শিবনেরি পার্বত্য দুর্গে জন্মগ্রহণ করেন।
শিবাজীর বাবা শাহজী ভোঁসলে ছিলেন দাক্ষিণাত্য সাম্রাজ্যের একজন মারাঠা সেনাপতি। শিবাজীর মায়ের নাম জিজাবাঈ।
জিজাবাই ছিলেন সিন্দখেদের লখুজীরাও যাদবের কন্যা।
জিজাবাই ছিলেন একজন বীর ও ধার্মিক নারী। শিবাজীর ঠাকুরদাদা মালোজি আহমেদনগর সাম্রাজ্যের একজন সনামধন‍্য সেনাধ্যক্ষ ছিলেন এবং ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত হিয়েছিলেন।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ

মহান ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ কেবল তাঁরই উপাসনা করতেন। কথিত আছে, দেবী নিজে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজে সামনে আর্ভিভূত হয়ে শিবাজীকে তরোয়াল দিয়েছিলেন। বর্তমানে এই তরোয়ালটি লন্ডনের যাদুঘরে রাখা হয়েছে।


এক নজরে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের পরিবার :


   
   * পিতা: শাহজী ভোঁসলে।
   * মাতা: জিজাবাঈ।
   * * ভাই : সম্ভাজী।
   * সৎ ভাই: ব্যানকোজি
   *সৎ ভাই: সান্তাজী
   * গুরুদেব: হিন্দু পদ পাদশাহীর                        
      প্রতিষ্ঠাতা সমরথ রামদাস।
   * কুলদেবী: মা তুলজা ভাওয়ানি।
   * ঠাকুরদাদা: মালোজি
   * প্রথম স্ত্রী: সাইবাই নিম্বলকর
   * দ্বিতীয় স্ত্রী: সোয়ারাবাই মোহিত।


◆ বাম ঐতিহাসিকবিদ দের ধারণা তার ছিল স্ত্রী ছিল আট জন। যথাক্রমে-
   * সগুনাবাই শিরকে।
   * পুতলবাই পালকার।
   * লক্ষ্মীবাই ।
   * সাকারবাই গেইকওয়াড।
   * কাশিবাই যাদব।
   * গুণবন্তবাই ইংলে।
   ◆সন্তান:
   * ধরমবীর সম্ভাজী রাজে।
   * রাজারাম।
   * সখুবাই, রানুবাই, অম্বিকাবাই।
   * দীপাবাই।
   * রাজকুনওয়ারবাই।
   * কমলাবাই।


◆ এক নজরে গৌরবময় কর্ম জীবনী:
   * ১৬৭৪ সালে মারাঠা রাজ্যের        
      প্রতিষ্ঠাতা।
  * ১৬৭৪ সালে ‘ছত্রপতি’
     উপাধিতে ভূষিত।
   * পৃথিবীর প্রথম নৌবাহিনী প্রতিষ্টাতা।
   * পৃথিবীর প্রথম গেরিলা যুদ্ধের উদ্ধাবক
   * ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক    
      শাসন!
   * মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎখাত করতে     
      রায়তওয়ারী ব‍্যাবস্থা চালু।

নিচে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের বিস্তারিত তুলে ধরা হল:

শিবাজীর জন্মের সময় দাক্ষিণ ভারত জুড়ে তিনটি প্রধান শক্তি ছিল – বিজাপুর, আহমেদনগর এবং গোলকোণ্ডা।
১৬৩৬ সালে বিজাপুরের আদিলশাহ্ দক্ষিণের অঞ্চলগুলি আক্রমণ করে এবং সেই সময় মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এই অঞ্চলগুলি।

সেই সময় পশ্চিম ভারতে মারাঠাদের উত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন শিবাজীর বাবা শাহজী, যিনি বিজাপুরকে এই আক্রমণে সর্বাত্বক সাহায্য করেছিলেন। জয় করা রাজ্যগুলির মধ্যে কিছু জমি খুঁজছিলেন শাহজী, যা থেকে বার্ষিক নির্দিষ্ট কিছু কর পাওয়া সম্ভব হত।
কিন্তু বিজাপুরের মদতে এতদিন মুঘলদের বিরোধিতা করেছিলেন শাহজী।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের সাথে মুঘলদের বিভেদ 

এরপরে মুঘলদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে শাহজীকে তাঁর পরিবার নিয়ে দূর্গ থেকে দূর্গে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের  জন্মের সময় বিজাপুরের সেনা হিসেবে কাজ পান শাহজী এবং অনুদান স্বরূপ পুনে জেলাটি লাভ করেন।
সেই থেকে পুনেতেই বেড়ে ওঠেন শিবাজী। তারপর বিজাপুরের শাসক আদিলশাহের অনুমতিতে অধুনা ব্যাঙ্গালোর অঞ্চলে শাহজীর বদলি হয়।
বাল্যকালেই মহারাষ্ট্র দেশ সম্পর্কে এবং স্থানীয় পার্বত্য মাওয়ালি জনগোষ্ঠীদের সাথে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়।ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ বিজাপুরের আদিলশাহী সাম্রাজ্য থেকে একটি ছিটমহল অধিকার করে সেখানেই মারাঠা সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

 

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ

 

এই মাওয়ালিদের নিয়েই ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ সর্বপ্রথম বিশ্বস্ত এক সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। ১৬৪৭ সালে কোণ্ডদেবের মৃত্যুর পর ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ রাজ্যজয়ে মনোনিবেশ করেন। শিবাজী হিন্দাভী স্বরাজ্যের মতবাদকে সমর্থন দান করেন। বিদেশী শাসন থেকে স্বদেশকে মুক্ত করাই ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের রাজ্যজয়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। সম্পদের লোভে লুঠতরাজ করা তার অভিপ্রায় ছিল না। সারা ভারতে হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপন করাই ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের লক্ষ্য ছিল। সেই সময় পুনের শাসনভার ছিল কোন্দাদেও এর উপর। তাঁর মৃত্যু হলে ১৬৪৭ সালে প্রশাসনিক ক্ষমতার ভার নেন এবং নিয়মিত ভাড়া বন্ধ করেন। শাসন ক্ষমতায় আসার পর তাঁর প্রথম লক্ষ হয় বিজাপুর সাম্রাজ্য আক্রমণ। ১৬৪৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিজাপুরের তোর্না দূর্গ দখল করেন। কোলাপুরের যুদ্ধে বিশাল বিজাপুরী সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে কৌশলে জিতে যান ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ। শিবাজী ঐ দূর্গে সঞ্চিত সকল ধন-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন।

তারপর পুনের কাছে পুরন্ধর, কোন্ধনা এবং চাকান দূর্গ দখল করেন তিনি। এর সাথে সুপা, বারামতি ও ইন্দাপুর দূর্গকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। তোর্না দূর্গ থেকে পাওয়া ধন-সম্পদ দিয়ে তিনি রায়গড়ে নতুন একটি দূর্গ নির্মাণ করেন। শিবাজীর এই উত্থানে ভীত হয়ে ১৬৪৮ সালে বিজাপুরের সুলতান আদিলশাহের নির্দেশে শাহজীকে বন্দি করা হয়।
১৬৪৯ সালে কর্ণাটক দখল করার পরে শাহজীকে মুক্ত করেন আদিলশাহ।


পরবর্তীতে জানা যায়, ১৬৬৪-৬৫ সালের দিকে শিকার করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় শাহজীর মৃত্যু হয়। ১৬৫৬ সালে শিবাজী বিজাপুরের সামন্ত চন্দ্ররাও মোরেকে পরাজিত করেন এবং তাঁর কাছ থেকে মহাবালেশ্বরের কাছে জাভালি উপত্যকা দখল করেন। শিবাজীর এমন বিষ্ময়কর উত্থান আদিলশাহকে সর্বদিকে ভয়ার্ত করে তোলে। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের কাছে নিজ সৈন্যদের পরাজয় তাঁকে গভীর উৎকণ্ঠায় ফেলে দেয়! ১৬৫৭ সালে আফজল খান নামে এক বয়স্ক ও চৌকস সেনাপতিকে তিনি পাঠান শিবাজীকে আটক করে আনার জন্য।


ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য ১৬৫৯ সালে প্রতাপগড় দূর্গে একটি মিলনমেলায় উভয়ের সাক্ষাৎ হয়।ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ বুঝতে পেরেছিলেন যে এটা হতে পারে কোন ফাঁদ বা চক্রান্ত। তাই ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আগে থেকেই বর্ম পরিহিত হয়ে এবং একটি ধাতব বাঘ নখ জাতীয় ক্ষুদ্র অস্ত্র পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আফজল খানের সঙ্গে দেখা করতে যান। শিবাজীকে আফজল খান ছুরি দিয়ে আক্রমণ করলে, বর্ম পরিধানের জন্য ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ বেঁচে যান আর এই আঘাতের প্রত্যুত্তরে বাঘ নখ দিয়ে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আফজল খানকে হত্যা করেন।
আফজল খানের মৃত্যু হলে, শিবাজীর নির্দেশে তাঁর সৈন্যবাহিনী বিজাপুরী সৈন্যদের উপর হামলা করে এবং মারাঠাদের হাতে প্রায় তিন হাজার বিজাপুরী সৈন্যের মৃত্যু হয়।
আদিলশাহ এবং শিবাজীর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলতে থাকে।


তারপর ১৬৬০ সালে আদিলশাহী সেনারা পানহালার দূর্গ দখল করলে ১৬৭৩ সালে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ সেই দূর্গ পুনরুদ্ধার করেন। ইতিহাসের তথ‍্য মতে, 1662 সালে, বিজাপুরের সুলতান, ছত্রপতি শিবাজী মহারাজে সাথে একটি শান্তি চুক্তি করেন এবং তাকে তার বিজিত অঞ্চলের একটি স্বাধীন শাসক করেন। মারাঠারা সংখ্যাস্বল্পতা সত্ত্বেও বিজাপুরি বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। এই জয় ছিল একটা প্রধান আঞ্চলিক শক্তির বিরুদ্ধে মারাঠাদের প্রথম বিজয়। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের সাংগঠনিক দক্ষতার উদাহরণ আজও ইতিহাসে গৌরবময়!

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের মারাঠা সাম্রাজ্য গঠন

সেই সময় মারাঠা জাতি বিছিন্নভাবে বসবাস করত, বিভিন্ন যুদ্ধে লড়ে ছত্রপতি শিবাজী হারাজ বুঝতে পেরেছিলেন যে মারাঠাদের মধ্যে উৎসাহ, আগ্রহ এবং আত্মসম্মান আছে, কিন্তু ঐক্যের অভাবে তারা সফল হতে পারছে না। তাই ছত্রপতি শিবাজী হারাজ  তাদের এক এক করে সুসংগঠিত করলেন। এর পর মারাঠাদের বিজয় পতাকা উড়তে শুরু করে।
যদিও মারাঠাদের প্রাচীন উপজাতি বলে উল্লেখ করা হয়, কিন্তু 17 শতক তাদের নিজেদেরকে শাসক হিসেবে ঘোষণা করার জায়গা দিয়েছিল ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের দুরদর্শী রণনীতির গুণে!
শিবাজী চেয়েছিলেন যে মারাঠাদের সাম্রাজ্য প্রসারিত হোক এবং তারা একটি পৃথক রাজ্যের অধিকারী হোক।
এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য, তিনি 28 বছর বয়সে একটি পৃথক সেনাবাহিনী সংগ্রহ করা শুরু করেন এবং তার যোগ্যতার জোরে মারাঠাদের সংগঠিত করেন এবং একটি পৃথক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
বিপুল খ্যাতি ও প্রধান কৃতিত্ব ছিল শিবাজীর!


তাঁরই সুযোগ্য পরিকল্পনা, নেতৃত্ব ও দুরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে মারাঠাদের সামরিক বাহিনী উন্নত হয়! ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের মতো একজন আদর্শ শাসক ও সংগঠক পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
তিনি একজন রাজা হিসেবে নিরপেক্ষভাবে শাসন করেছিলেন এবং প্রত্যেক সৈনিকের মনোবল এমনভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যেন চোখের পলকেই শত্রু ধ্বংস হয়ে যায়! ক্রমে তিনি একজন সাহসী যোদ্ধা হিসাবে  96টি মারাঠা গোষ্ঠীর প্রধান হয়ে ওঠেন! ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সেনাবাহিনী তৈরীর ক্ষমতা ছিল বিস্ময়কর। তার বিচার ব্যবস্থা এমন চমৎকার ছিল যে, তার শত্রুরাও এই বিষয়ে তার প্রশংসা করেছিল।

 

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ প্রত্যেক ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করতেন। এমনকি তিনি তার সমালোচকদের কাছ থেকেও শিখতেন।
এটা সেই দিনের কথা যখন ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ মুঘলদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করছিলেন, এক রাতে ক্লান্ত হয়ে তারা এক বৃদ্ধা মহিলার কুঁড়েঘরে গেল। তার চেহারা দেখে বুড়ি বলল, সৈনিক, তোমার চেহারাটা শিবাজীর মতো! তুমি তার মতই বোকা। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ জানতে চাইলেন, শিবাজীর কোনটা বোকামি হয়েছে! বুড়ি উত্তর দিল, তিনি ছোট দুর্গগুলি সহজেই জয় করে ক্ষমতা বাড়ানোর পরিবর্তে, বড় দুর্গগুলিকে আক্রমণ করেন এবং হেরে যান। শিবাজী বুড়ির এই কথার মাধ্যমে তার কৌশল ব্যর্থ হওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছিলেন। বুড়ির কাছ থেকে শেখার পর, তিনি প্রথমে ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করেন এবং সেগুলি অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন।


তখন তিনি ছোট ছোট দুর্গ জয় করার দিকে মনোনিবেশ করেন এবং ফলাফল বিজয়ের আকারে আসতে শুরু করে। এটি তার পাশাপাশি তার সৈন্যদের মনোবল বাড়িয়েছিল। এই মনোবলের কারণে তারা বড় বড় দুর্গ জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। বিজয় এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার শক্তি বৃদ্ধি পায়। ক্রমে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ পুনা ও কোঙ্কন উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলে দূর্গগুলি পুনরুদ্ধার করেন এবং দাক্ষিণাত্য জুড়ে হিন্দু সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ছত্রপতি, শাককর্তা, ক্ষত্রিয় কুলবন্ত সহ বেশ কয়েকটি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

রাজ্যের স্থায়ী স্থিতিশীলতার জন্য শিবাজী অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আওরঙ্গজেবের প্রবল শক্তির মুখোমুখি হতে এবং বিজয় লাভে ব্যাপকভাবে কাজে লাগেছিল।
এই কারণে, মারাঠা আত্মরক্ষা এবং রাজ্যবর্ধন উভয়ই করতে পারত।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের  ছোট একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত :

একদিন সূর্যাস্তের পর ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ দারোয়ানকে দরজা খুলতে বললেন। দারোয়ান স্পষ্ট বলেছিল যে সূর্যাস্তের পর গেট খুলবে না।
এই কারণে শিবাজীকে বাইরে রাত কাটাতে হয়েছিল।
খুব ভোরে তিনি দারোয়ানকে আদালতে ডেকে দরজা না খোলার কারণ জিজ্ঞেস করেন। দারোয়ান উত্তর দিলেন, মহারাজ, আপনি যখন আপনার আদেশ মানবেন না তখন প্রজারা কি করবে?
দারোয়ানের আন্তরিকতা এবং নির্ভীকতায় ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে তাকে দেহরক্ষী বানিয়েছিল।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ছিলেন অত্যন্ত সাহসী এবং ভারতীয় ইতিহাসে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।
শিবাজী মহারাজ ছিলেন যোদ্ধা রাজা এবং তার বীরত্ব, কৌশল এবং প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য বিখ্যাত।
তিনি সর্বদা স্বরাজ্য এবং মারাঠা ঐতিহ্যের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের শিবাজীর রাজ্যাভিষেক


1674 খ্রিস্টাব্দে শিবাজি নিজেকে মারাঠা রাজ্যের একজন স্বাধীন শাসক হিসাবে ঘোষণা করেন এবং রায়গড়ে ছত্রপতি হিসাবে মুকুট প্রাপ্ত হন।
তার রাজ্যাভিষেক এমন লোকদের উত্থানের প্রতীক যারা মুঘলদের উত্তরাধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে। রাজ্যাভিষেকের পর, তিনি নবগঠিত হিন্দবী স্বরাজ্য রাজ্যের হিন্দু বিশ্বাসের রক্ষক উপাধি পান।
এই রাজ্যাভিষেক ভূমি রাজস্ব আদায় এবং জনগণের উপর কর আরোপের একটি বৈধ অধিকার দেয়।

গেরিলা যুদ্ধের উদ্ভাবক


কথিত আছে যে ছত্রপতি শিবাজি ভারতে প্রথমবারের মতো গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন।
তাঁর যুদ্ধ নীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ভিয়েতনামীরা আমেরিকা থেকে বন জিতেছিল।
এই যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায় সেই সময়কালে রচিত শিবসুত্র নামক গ্রন্থে। বাহ্যিকভাবে গেরিলা যুদ্ধ প্যারামিলিটারি সৈন্যদের দ্বারা শত্রুর পিছন বা পাশে আক্রমণ করে লড়াই করা।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের রাজ‍্য সীমা


ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের রাজ্য সীমা পূর্ব সীমানা উত্তরে বাঘলা স্পর্শ করেছিল এবং তারপরে পুরো সাতারা ও কোলহাপুর জেলার একটি সীমানা দক্ষিণে নাসিক ও পুনা জেলার মধ্যে চলমান একটি অনির্দিষ্ট সীমানা রেখা দিয়ে কোলাপুর পড়েছিিম পশ্চিমা কর্ণাটকের অঞ্চলগুলি পরে যুক্ত করা হয়েছিল। স্বরাজের এই অঞ্চলটি তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত ছিল:
১. পুুনা থেকে সালহর পর্যন্ত অঞ্চলটি উত্তর কোঙ্কনকে অন্তর্ভুক্ত কোঙ্কনের অঞ্চল, পেশোয়া মোরোপান্ত পিংগলের অধীনে ছিল।
২. উত্তরের কানার পর্যন্ত দক্ষিণ কোঙ্কনের অঞ্চল অন্নজী দাতাদের অধীনে ছিল।
৩. দক্ষিণ দেশের জেলাগুলি, যা সাতারা থেকে ধরওয়াদ ও কোফাল পর্যন্ত ছিল, দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলে এসে দত্তজি পান্তের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
এই তিনটি সুবাকে আবার পরগনা ও তালুকায় ভাগ করা হয়েছিল।
পরগনার অধীনে আরও বেশি ঝাঁক ছিল।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের সেনাবাহিনী


ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ নিজের একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলেন। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের মৃত্যুর সময় তাঁর সেনাবাহিনীতে 30-40 হাজার নিয়মিত ও স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা অশ্বারোহী, এক লক্ষ প্রধাণী এবং 1260 হাতি ছিল। তাদের আর্টিলারি সম্পর্কিত সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।
অশ্বারোহী দুটি বিভাগে বিভক্ত ছিল: – বার্গিস এবং অশ্বারোহী সৈন্য ছিল, এদের ঘোড়া এবং অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল।  অশ্বারোহীর ক্ষুদ্রতম ইউনিটে একটি সার্জেন্ট সহ 25 জন লোক ছিল।
সেখানে পাঁচজন হাবিলদার ছিল। যার উপরে ছিল এক জামালদার। দশ জুমালাদার পাঁচ হাজারের উপরে এক হাজার এবং পাজাজারী থাকত।
তিনি সারনোবাতের আওতায় আসতেন। প্রতি 25 সেনার জন্য রাজ্য থেকে একজন নাবিক এবং একটি শরণার্থী দেওয়া হয়েছিল।

 

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের দূর্গ

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের দুর্গগুলি ছিল মারাঠাদের সামরিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। ঐতিহাসিক দের মতে, শিবাজির 250 টি দুর্গ ছিল। তারা মেরামত করতে ব্যয় করত প্রচুর পরিমাণে।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ বেশ কয়েকটি দুর্গ জয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন, এর মধ্যে একটি সিংহগড় দুর্গ ছিল, যা তিনি তানজিকে জয়ের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। এই দুর্গ জয়ের সময় তানাজি যথেষ্ট বীরত্ব অর্জন করেছিলেন। রায়গড়ের চকান, সিংহগড় এবং পুরান্দার মতো দুর্গগুলিও বিজাপুর সুলতানের রাজ্য সীমানায় তাঁর অধীনে আসে।

কোন্ডনা দুর্গ জয়

কোন্ডনা দুর্গ নীলকান্ত রাও এর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের সেনাপতি তানাজি মালুসারে এবং প্রথম জয় সিং এর অধীনে দুর্গরক্ষক উদয়ভান রাঠোড়ের মধ্যে এটি যুদ্ধ হয়েছিল।

 

কুতুবশাহী শাসকদের সাথে জোট করেন এবং এই জোটের সাহায্যে তিনি বিজাপুর কর্নাটকে (1676-79 খ্রিস্টাব্দ) অভিযান পরিচালনা করেন এবং জিঙ্গি, ভেলোর এবং কর্ণাটকের অনেক দুর্গ জয় করেন।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ মাভলা তানাজি মালুসারে কে নিয়ে কোন্ধনা দুর্গ দখল করে নিয়েছিলেন কিন্তু সেই যুদ্ধে মাওলা তানাজি মালুসারে বীরাগতি প্রাপ্ত হয়। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ তাঁর স্মরণে কোন্দনা দখলের পর তাঁর নাম করেছিল সিংহগড়।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ দক্ষ সেনাবাহিনী এবং দক্ষ প্রশাসন তৈরি করেছিলেন। তাঁর প্রশাসন মূলত দাক্ষিণাত্যের প্রশাসনিক অনুশীলন দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
তিনি আটজন মন্ত্রী নিয়োগ করেন যাদেরকে ‘অষ্টপ্রধান’ বলা হত যারা তাকে প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করেন।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের প্রশাসন


ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের  প্রশাসন মূলত দাক্ষিণাত্যের প্রশাসনিক অনুশীলন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তিনি আটজন মন্ত্রী নিয়োগ করেন যাদেরকে অষ্টপ্রধান বলা হত যারা তাকে প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করেন। রাষ্ট্রদূত ছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধি, বিদেশী বণিকদেরও এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ১৬৭৪ সালে প্রায় ৫০ হাজার লোকের সমাবেশের সামনে পণ্ডিৎ গাগা ভট্ট মারাঠাদের রাজা হিসেবে শিবাজীর রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান পালন করেন। কিন্তু তাঁর রাজ্যাভিষেকের ১২ দিনের মাথায় তার মাতৃবিয়োগ হয়।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের রাজ‍্যভিষেক
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের রাজ‍্যভিষেক


ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ তাঁর আট মন্ত্রিপরিষদের মাধ্যমে ছয় বছর রাজত্ব করেছিলেন। বহু মুসলিম তাঁর প্রশাসনিক কাজেও জড়িত ছিলেন-


1. পেশওয়া ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রী যিনি অর্থ ও সাধারণ প্রশাসন দেখাশোনা করতেন।
2. সেনাপতি ছিলেন একজন নেতৃস্থানীয় মারাঠা প্রধান।
3. মজুমদার নামক পদে একজন হিসাবরক্ষক ছিলেন।
4. ওয়াকেনাভিস হলেন একজন যিনি গৃহস্থালী ও অন‍্যান‍্য কিছু বিষয়গুলি দেখাশোনা করেন।
5. সুরনাভি: রাজাকে তার চিঠিপত্রে সহায়তা করে।
6. দবির অনুষ্ঠানের মাস্টার ছিলেন এবং রাজাকে তার বৈদেশিক বিষয় নিয়ে কাজ করতে সাহায্য করতেন।
7. নয়াধিশ এবং পণ্ডিতরাও ন্যায়বিচার এবং দাতব্য অনুদানের দায়িত্বে ছিলেন।
8. তিনি জমির উপর কর ধার্য করেন যা ভূমি রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ।

 

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ কেবল একজন দক্ষ জেনারেল, একজন দক্ষ কৌশলী এবং একজন বুদ্ধিমান কূটনীতিক হিসাবে প্রমাণিত হননি, তিনি দেশমুখের ক্ষমতাকে দমন করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিত্তি ও স্থাপন করেছিলেন। তারপরে ক্রমান্বয়ে ন্যায়াধীশ বা প্রধান বিচারপতি, ক্রনিকার বা নথিকারক এবং সচিব। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ তাঁর রাজসভায় ফারসি ভাষার বদলে মারাঠি ও সংস্কৃত ভাষার প্রচলন করেছিলেন। নিজে একজন হিন্দু হয়েও সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল মনোভাব ছিল শিবাজীর। তিনিই প্রথম মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎখাত করতে রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত চালু করেছিলেন।

 

তাছাড়া ভারতের প্রশাসনিক বিভাগের নানাবিধ উন্নয়নের কাজেও তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। সুতরাং, মারাঠাদের উত্থান অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক কারণগুলির কারণে হয়েছিল। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ছিলেন একজন জনপ্রিয় রাজা যিনি মুঘল দখলের বিরুদ্ধে এলাকায় প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তাঁর শাসনকালে, নারীদেরকে অত্যন্ত সম্মানিত করা হত এবং দখলকৃত অঞ্চলে কোন নারীর কোনও ক্ষতি হয়নি। তিনি কোনও বৈষম্য ছাড়াই সকল ধর্মকে গ্রহণ করেছিলেন এবং জাতপাতের বিরোধের বিরুদ্ধে ছিলেন।


তিনি মারাঠা শাসন পুণঃপ্রতিষ্ঠা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তিনি তার সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনী এবং সুগঠিত শাসন কাঠামোর মাধ্যমে একটি দক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি একজন সুকৌশলী সামরিক ব‍্যাক্তি ছিলেন এবং গেরিলা যুদ্ধের ধারণার সূচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর দুই শতাব্দী পরেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা ছিলেন শিবাজী। তাঁর বীরত্ব ও মহান প্রশাসনিক দক্ষতার কথা আজও ভারতীয়দের মধ্যে বিখ্যাত।

মুঘলদের সাথে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের সাক্ষাৎ 


বিজাপুর এবং মুঘল উভয়ই শিবাজীর শত্রু ছিল। সেই সময় আওরঙ্গজেব ছিলেন দাক্ষিণাত্যের সুবেদার। বিজাপুর সুলতান আদিলশাহের কাছে সাহায্য চাওয়ার পর, মুঘল শাসক আওরঙ্গজেব ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দক্ষিণ ভারতে নিযুক্ত তার মামা শাহিসতে খানকে পাঠান।
কিন্তু সুবেদারকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজে সাথে লড়াইয়ের সময় তিনি তার ছেলেকে হারিয়েছিলেন এবং নিজেই তার আঙ্গুল কেটে ফেলেছিলেন।
তাকে মাঠ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। একই সময়ে, মুঘল শাসক আওরঙ্গজেব শাহীস্ত খানকে দক্ষিণ ভারত থেকে সরিয়ে বাংলার সুবেদার বানান।
শাহজাহানের আদেশে ঔরঙ্গজেব বিজাপুরের সাথে একটি চুক্তি করেন এবং একই সাথে শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ হওয়ার সাথে সাথে ঔওরঙ্গজেব উত্তর ভারতে চলে যান এবং সেখানে শাহজাহানকে বন্দী করার পর মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক হন।

 

এরপর মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজে প্রত্যক্ষ সংঘাত শুরু হয়। ১৬৫৭ সালে শিবাজী যখন আহমেদনগর এবং জুন্নারের কাছে মুঘল অঞ্চল দখল অভিযানে যান, সেই সময় তাঁদের মধ্যে সংঘাত আরও চরমে ওঠে। ঔরঙ্গজেব ছত্রপতি শিবাজী মহারাজকে দমন করার জন্য তাঁর মামা ও দাক্ষিণাত্যের শাসক শায়েস্তা খাঁকে পাঠান।

শায়েস্তা খাঁ ছত্রপতি শিবাজী মহারাজে অধিকার থেকে বেশ কয়েকটি দূর্গ দখল করেন এবং পুনা দূর্গটিও ছিনিয়ে নেন। পরে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ তাঁকে হত্যা করে পুনা দূর্গ পুনরুদ্ধার করেন। কোঙ্কন অঞ্চলে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে শিবাজীর কোষাগার প্রায় শূন্য হয়ে যায় আর তাই মুঘল বাণিজ্য কেন্দ্র সুরাট লুঠ করেন শিবাজী।
একই সময়ে সুরত ছিল মুসলমানদের হজ্জের প্রধান তীর্থস্থানে যাওয়ার একমাত্র প্রবেশপথ সুরাতেও ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ  তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সুরাতের বণিকদের লুট করেছিলেন কিন্তু তিনি কোন সাধারণ মানুষকে তার লুটের শিকার করেননি।

 

এই ঘটনা ঔরঙ্গজেবকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
তাঁর নির্দেশে সেনাপতি জয় সিং প্রায় দেড় লক্ষ সেনা নিয়ে শিবাজীকে আক্রমণ করেন। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ এই যুদ্ধে জয় অর্জন করতে না পেরে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হন ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ১৬৬৫ সালে শিবাজী ও জয় সিংয়ের মধ্যে পুরন্দর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যেখানে মুঘলদেরকে ২৩টি দূর্গের অধিকার ছেড়ে দেন শিবাজী এবং ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তাঁকে ৪ লক্ষ টাকা দেন।
ঔরঙ্গজেবের আমন্ত্রণে পুত্র সম্ভাজীকে নিয়ে আগ্রা দূর্গে যান শিবাজী

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের আগ্রায সফর

 

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ নিজের নিরাপত্তার সম্পূর্ণ আশ্বাস পেয়ে আগ্রার দরবারে আওরঙ্গজেবের সাথে দেখা করতে রাজি হন।
তিনি 1666 খ্রিস্টাব্দে 9 মে পুত্র শম্ভজী এবং 4000 মারাঠা সৈন্যের সাথে মুঘল দরবারে হাজির হয়েছিলেন, কিন্তু আওরঙ্গজেবের যথাযথ সম্মান না পেয়ে শিবাজি ঔরঙ্গজেবকে ভরা দরবারে বিশ্বাসঘাত বলে ডেকেছিলেন।

ফলে, আওরঙ্গজেব ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ এবং তাঁর পুত্রকে জয়পুর ভবনে গৃহবন্দি করেন ঔরঙ্গজেব। সেখান থেকে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ তার ছেলেকে নিয়ে 13 ই আগস্ট 1666 খ্রিস্টাব্দে ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে পালিয়েছিলেন এবং 22 সেপ্টেম্বর 1666 খ্রিস্টাব্দে রায়গড়ে পৌঁছেছিলেন।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের পুরন্দর চুক্তি 


তার পরপর অনেক যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর আওরঙ্গজেব তার সবচেয়ে প্রভাবশালী সেনাপতি মির্জা রাজা জয় সিংহের নেতৃত্বে প্রায় 10 লক্ষ সৈন্যের একটি সেনাবাহিনী পাঠান।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজকে চূর্ণ করার জন্য, রাজা জয় সিং, বিজাপুরের সুলতানের সাথে, পুরান্দর দুর্গ দখলের পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে 1665 সালের 24 এপ্রিল ব্রজগড় দুর্গ দখল করেন।
শিবাজীর অত্যন্ত সাহসী সেনাপতি মুরারজি বাজি পুরন্দর দুর্গ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হন। পুরন্দর দুর্গ রক্ষা করতে অক্ষম জেনেও শিবাজী মহারাজা জয় সিংকে একটি চুক্তির প্রস্তাব দেন।
উভয়ই চুক্তির শর্তে সম্মত হন এবং 22 জুন, 1665 তারিখে পুরন্দর চুক্তি সমাপ্ত হয়।
তার পরাজয়ের পর প্রায় কয়েক বছর পর শাহিসতে খান তার সেনাবাহিনী সহ ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের অনেক এলাকা পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেন।

 


এই সব দেখে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ এই ধ্বংসের প্রতিশোধ নিতে দৃর প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং মুঘল সাম্রাজ্যের অনেক এলাকা আক্রমণ করেছিলেন তিনি তার সাহসী এবং শক্তিশালী সৈন্যদের দিয়ে মুঘলদের অনেক এলাকা লুণ্ঠন শুরু করেছিলেন।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ শাসন ক্ষমতায় থাকাকালীন ইংরেজদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন। কিন্তু ১৬৬০ সালে পানহালার দূর্গ দখলের সময় ইংরেজরা বিজাপুর সালতানাতকে সহায়তা করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৬৭০ সালে ইংরেজরা তাঁকে যুদ্ধের সামগ্রী বিক্রি করতে অস্বীকার করলে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ক্ষুব্ধ হন।
এই ক্ষোভের কারণে শিবাজী রাজাপুরে ব্রিটিশ কারখানাগুলি লুঠ করেছিলেন।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের সাহিত্য

 

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজকে প্রথম শিশু সাহিত্যিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। মাত্র 14 বছর বয়সে, বুধভূষণম (সংস্কৃত ভাষায়), নায়কিকাবেদা, সাতসাতক, নাখশিখ (হিন্দি ভাষায়) প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি দাশবোধ নামে একটি বইও রচনা করেছিলেন, যা মারাঠি ভাষায় রয়েছে। তার মারাঠি, হিন্দি, ফার্সী, সংস্কৃত, ইংরেজি সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় দক্ষতা ছিল।
তিনি যে গতিতে কলম চালিয়েছিলেন, তিনি তরোয়াল ও ব্যবহার করেছিলেন।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের গুরুভক্তি


গুরু রামদাসএকদিন তিনি দরজার বাইরে থেকে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের কাছে ভিক্ষা চাইলেন। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ বললেন, ভিক্ষা চেয়ে আপনি আমাদের লজ্জায় ফেলেছেন।

গুরু রামদাস বললেন, আজ আমি এখানে ভিক্ষা চাইতে এসেছি, তাই গুরু হিসেবে নয়, ভিক্ষুক হিসেবে এসেছি। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ একটি কাগজে কিছু লিখে গুরুর কমুণ্ডলে রাখলেন।
তাতে লেখা ছিল – গোটা রাজ্য গুরুদেবকে উৎসর্গীকৃত।
গুরু রামদাস কাগজ ছিঁড়ে বললেন, আমি তোমার ভিতরের অহংকার বোধ দূর করতে পারিনি! তুমি ভূলে গিয়েছ তুমি রাজা নও, তুমি দাস। তিনি যা দিচ্ছেন তা আমাকে দিচ্ছেন।
গুরুদেব আরও বললেন, এটা কি করছ তুমি! এই রাজত্ব, ধন -সম্পদ সবই মানুষের কঠোর পরিশ্রমের ফসল। তাই তাদেরই প্রথমে এর উপর অধিকার। তুমি একজন শক্তিশালী দাস, একজন দাসের উচিত নয় অন্যের জিনিস দান করা, এটা রাজধর্মও নয়।

 

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ গুরুদেবের অনুভূতি বুঝতে পেরে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন, গুরুদেব! আর কোন দিন এমন ভুল যাওয়া যাবে না।
ছত্রপতি শিবাজী তাঁর গুরু নীতি ও জ্ঞান সম্পর্কে মাঝেমাঝে ব্যাখ্যা করতেন! একবার শিবাজি গর্বিত হয়ে যায় এবং গুরু রামদাস জিকে বললেন – আমি মানুষের রক্ষক এবং প্রজাপালক।
গুরু রামদাস অনুমান করেছিলেন যে সম্ভবত শিবাজী রাজা হওয়ার জন্য গর্বিত।
রামদাস শিবাজীকে একটি বড় পাথর দেখিয়ে বললেন – বৎস! এই পাথর ভেঙে দেখাও তো!
শিবাজী যখন পাথরটি ভেঙে ফেলেন, তখন তিনি পাথরের মাঝখানে একটি জীবন্ত ব্যাঙ দেখতে পান। গুরু রামদাস বললেন, এখন বলো এই পাথরের মাঝখানে ব্যাঙকে কে বাতাস, জল এবং খাবার দিচ্ছে?

এই কথা শুনে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ গুরুর সামনে প্রণাম করলেন। তখন রামদাস বললেন যে রক্ষণাবেক্ষণ কারীর অহংকার আমাদের মধ্যে আসা উচিত নয়!

 

রামদাসজি ছত্রপতি মহারাজ শিবাজীকে গ্রেট শিবাজি হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ তাঁর গুরুর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই কিছু করতেন।
তিনি গুরু রামদাসের ধর্মীয় সংস্পর্শে এসেছিলেন, যা তাকে তার মাতৃভূমির জন্য গর্বিত করেছিল।

শিবাজী হিন্দু রীতি অনুযায়ী শাসন করতেন। ভারতের সাধু ও বিদ্বান সমাজে শিবাজী নাম সুপরিচিত।
কাশ্মীর থেকে শুরু করে সমগ্র ভারতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত তিনি 1100 মঠ এবং আখরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি হনুমানের উৎসর্গীকৃত ভক্ত ছিলেন।
সেই হিসাবে তাঁকে হনুমানের অবতার হিসাবে বিবেচনা করা হত।

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার 


কথিত আছে যে তার জীবনের শেষ দিনগুলিতে ত্রপতি শিবাজী মহারাজ তার অবস্থা সম্পর্কে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন যার কারণে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে এবং তিনি টানা 3 সপ্তাহ উচ্চ জ্বরে ছিলেন তারপরে 1680 সালের 3 এপ্রিল তিনি মারা যান।

সেই সময় সম্ভাজী শিবাজীর উত্তরাধিকার লাভ করেন। সম্ভাজী ছিলেন শিবাজীর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর থেকে রাজারাম নামে দ্বিতীয় পুত্র ছিল।
তখন রাজারামের বয়স ছিল মাত্র 10 বছর তাই মারাঠারা শাম্বাজীকে রাজা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ভারতের পবিত্র মাটিতে জন্ম নেওয়া ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ঐতিহাসিক চরিত্রের এক নবজাগরণ, হিন্দুত্বের গর্ব। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ছিলেন- সাহস, রাজত্ব এবং দক্ষ প্রশাসকের চিরন্তন মূর্ত প্রতীক।
তার মতো পরিকল্পনাকারী কোথাও দেখা যায় না।

 

তিনি অনেক উত্থান পতনের মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিন্তু কখনও তার সীমা ভঙ্গ করেননি। তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সাথে শাসন করেছিলেন।
এই গুণাবলীর কারণে, তিনি এখনও সমগ্র ভারত এবং ভারতের মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী।
আধুনিক ভারত গঠনে তাঁর অভূতপূর্ব অবদান রয়েছে।

কিছু ইতিহাসবিদরা ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ সম্পর্কে অনেক ভুল কথা বলেছেন। তিনি কট্টর ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এটি একটি মিথ্যাচার।

 

ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ প্রত্যেক মতাদর্শ এবং সম্প্রদায়কে সম্মান করতেন। শিবাজির শাসনামলে, সব সম্প্রদায়ের উপাসনা স্থানগুলিই সুরক্ষিত ছিল।
তিনি তার শাসনামলে সকল সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন।

শিবাজীর সেনাবাহিনীতে ছিল বহু মুসলিম বীর যোদ্ধা, মুসলিম সরদার ও সুবেদারদের মতো অনেক লোকও ছিলেন। আসলে, শিবাজির সংগ্রাম ছিল, ঔরঙ্গজেবের মতো শাসকরা এবং তাঁদের ছায়ায় বড় হওয়া ধর্মান্ধ ও অত‍্যাচারী দের বিরুদ্ধে।

 

তিনি ভারতের প্রাচীন হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং মারাঠি ও সংস্কৃত ভাষার ব্যবহারকে জনপ্রিয় করেন। দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের মতো মহান দেশপ্রেমিক যোদ্ধাদের গল্প আমাদের মধ্যে শুধু অনুপ্রেরণা দেয় না, ত্যাগ, সাহসিকতার এবং সমৃদ্ধ একটি দেশের আলোকজ্বল পথ প্রদর্শন করে! এমন মহান ব্যক্তিত্ব কখনও একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না! সমগ্র মানবতার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস তিনি। তাঁর অতুলনীয় প্রতিভা, অদম্য সাহস ও বীরত্ব এবং নিবেদিত সেবা আগামী প্রজন্মকে শক্তিশালী ও সার্বভৌম দেশ গঠনে উদ্বুদ্ধ করে!

10 thoughts on “ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ | মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা | শিবাজী মহারাজের ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *