চাণক্য
Spread the love

এই উপমহাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকা জ্ঞানী প্রাচীন পণ্ডিত, দার্শনিকদের নাম স্মরণ করলে অনেকেরই নাম উঠে আসে। কিন্তু যদি বলা হয়- পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ কে? বিজ্ঞ ব‍্যাক্তিগণ তখন ভাবনাচিন্তা করে একজনের নামই উল্লেখ করবে। তিনি আর কেউ না, স্বয়ং আচার্য চাণক্যতাঁর রচিত চাণক্য নীতিচাণক্য শ্লোকের গুণে এই উপমহাদেশ ছাড়াও সমগ্র বিশ্বে তাকে অন্যতম প্রাচীন এবং বাস্তববাদী ও জ্ঞানী পণ্ডিত হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

তাঁর রচিত এক অর্থশাস্ত্র ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির পথ বদলে দিয়েছে! রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির মতো বিষয়গুলোতে কনফুসিয়াস আর মোজির মতো দার্শনিকের থেকেও উচ্চপর্যায়ের ভাবা হয় তাকে। একজন প্রকৃত শিক্ষক হিসাবে তিনি সবসময়ই শিক্ষার গুরুত্ব দিতেন। তাঁকে ভারতের সর্বপ্রথম অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলে উল্লেখ করা হয়।

চাণক্য নীতি এর রচয়িতা আচার্য চাণক্য
চাণক্য নীতি এর রচয়িতা আচার্য চাণক্য

বিখ্যাত মহাকবি কালিদাসের ও বহু সময় পূর্বে জন্মগ্রহণ করা এই পণ্ডিত তার সময় থেকেই ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন এবং লিখে গেছেন অমর সব তত্ত্বগাথা বাণী যেগুলো চাণক্য নীতিচাণক্য শ্লোক নামে আজও আমাদের মধ‍্যে পরিচিত। ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে- তিনি দীর্ঘদিন রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ও তাঁর পুত্র বিন্দুসারের শিক্ষক ও রাজ উপদেষ্টা হিসাবে পরিচিতি লাভ করলেও, মূলত তিনি তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন।

প্রাচীন ভারতের গুরু, বিখ্যাত পন্ডিত ও দার্শনিক হিসেবে খ্যাতি অর্জনকারী এই চাণক্য কৌটিল্য ও বিষ্ণুগুপ্ত নামেও আমাদের মাঝে পরিচিত। রাজনৈতিক দর্শনের সদূরপসারী পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় কৌশল বাস্তবায়নের সঠিক নির্দেশনা প্রদানে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম ইতিহাসে জ্ঞানবান বুদ্ধিদীপ্তদের তালিকায় অনেক উচ্চ স্থান তাঁর।

চাণক্য নীতি ও চাণক্য শ্লোক পিডিএফ পড়তে এখানে ক্লিক করুন!

আচার্য চাণক্য সম্পর্কে জানার উৎস

গবেষক থমাস ট্রটম‍্যান, আচার্য চাণক্য সম্পর্কে জানার জন‍্য ৪টি উৎসের প্রতি দৃষ্টি দিতে বলেছেন। সেগুলো হলো-

১. সিংহলী বৌদ্ধ গ্রন্থ “মহাবংশ” এবং পালি ভাষায় লিখিত তাঁর টিকা “বংসটঠপ্পকাসিনি”।
২. পন্ডিত হেমচন্দ্রের রচিত জৈনগ্রন্থ “পরিশিষ্টপর্ব”।
৩. সোমদেব ভট্টের লিখিত “কথাসরিৎসাগর” ও ক্ষেমেন্দ্র রচিত “বৃহৎ কথামঞ্জরী”
৪. বিশাখদত্ত রচিত সংস্কৃত নাটক “মুদ্রারাক্ষস‌”।

আচার্য চাণক্যের জন্ম, বিদ‍্যালাভ ও কর্ম জীবন

ধারণা করা হয়, দার্শনিক প্রজ্ঞা এবং অসাধারণ কূটনৈতিক পরিকল্পনায় সিদ্ধহস্ত রাজ উপদেষ্টা, অসাধারণ প্রতিভাবান এই বিশেষ ব‍্যাক্তি চাণক্যের জন্ম ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন ভারতবর্ষের গোল্লা এলাকার চানাকা নামের একটি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল চানিন এবং মাতার নাম ছিল চানেশ্বরী। যতটুকু জানা যায়, চাণক্যের পিতা একজন মুনি ও মাতা ব্রাহ্মণ ছিলেন। এজন্য চাণক্য জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ বংশগত ছিলেন।

বৌদ্ধ গ্রন্থ “মহাবংশ” -এর বর্ণনা অনুযায়ী চাণক্যের জন্ম তক্ষশীলাতে। জৈন গ্রন্থ “অদ্বিধন চিন্তামনি” অনুযায়ী চাণক্য দক্ষিণ ভারতের ব‍্যাক্তি। হেমচন্দ্রর রচিত “পরিশিষ্টপর্ব” অনুযায়ী চণক নামের গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে চাণক্যের জন্ম। তাঁর পিতার নাম চণিন এবং মাতার নাম চণেশ্বরী। আচার্য চাণক্য বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন।

তাঁর জন্মস্থান নিয়ে ইতিহাস বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকের মতে, তাঁর জন্মস্থান ছিল পাটলিপুত্রের কুসুমপুরে।

কিছু গ্রন্থে পাওয়া যায় তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুখের দুই পাটিতে বত্রিশটি দাঁত নিয়ে, কিন্তু তাঁর মা/বাবা খারাপ লক্ষণ ভেবে কয়েকটি দাঁত ভেঙে দিয়েছিলেন। কিছুটা বেঁটে ও কালো চেহারা ছিল তাঁর। তাঁর ব‍্যাক্তিগত বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ‍্য পাওয়া যায় না। যাইহোক তাঁর চেহারা, জ্ঞান ও গুণের দিক থেকে তিনি তাঁর জন্মসময় থেকে আজও তিনি প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানবানদের মধ‍্যে অন‍্যতম প্রধান।

ঐতিহাসিকদের মতে, চাণক্যের পিতা একজন গুণবান শিক্ষক ছিলেন, এজন্য তিনি নিজ সন্তানের শৈশব সময়েই বিদ‍্যা লাভের জন‍্য যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তৎকালীন সময় সনাতনীদর প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে শিক্ষাক্ষেত্রে কঠিনতম বিদ্যা হিসাবে উল্লেখ করা হতো। ছোটবেলাতেই চাণক্য সম্পূর্ণ বেদ অর্থসহ মুখস্থ করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু প্রাচীন ভারত অথবা এই উপমহাদেশ নয়, উচ্চতর জ্ঞান আহরণ ও শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চার জন‍্য পৃথিবীর অন‍্যতম শীর্ষস্থানীয় একটি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল।

চাণক্যের পড়াশোনা সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল। বেদ শিক্ষা সম্পন্ন হলে রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই প্রখর জ্ঞানের অধিকারী চাণক্য রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতি অধ্যয়ন আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করতেন। শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করেই অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তাঁর প্রতিভা তক্ষশীলার শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ক্রমান্বয়ে সাহিত্য, যুদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন চাণক্য।

গ্রিক এবং ফারসি ভাষায়ও তাঁর দক্ষতা ছিল বলে জানা যায়। তাঁর বিশেষ রাজনৈতিক জ্ঞানের কারণে কতিপয় ব‍্যাক্তি তাকে অসৎ মানুষ বলে আখ্যায়িত করলেও, মূলত চাণক্য স্বচ্ছ একজন জ্ঞানী ও বাস্তববাদী ব‍্যাক্তি ছিলেন। এক পরিব্রাজকের বর্ণনা অনুযায়ী, লোকমুখে অনেক প্রশংসা শুনে তিনি চাণক্যের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করার জন‍্য।

তিনি পৌছাতে বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। গিয়ে দেখেন প্রদীপ জ্বালিয়ে লেখার কাজ করছেন চাণক্য। তিনি দেখা করতে এসেছেন বলার পরে চাণক্য জ্বালিয়ে রাখা প্রদীপ নিভিয়ে অন‍্য প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে আসেন দেখা করতে। অন‍্য প্রদীপ জ্বালানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে, চাণক্য উত্তর দিয়েছিল- রাজসভার কাজ করছিলাম এজন্য রাজার অর্থের তেলে প্রদীপ জ্বালিয়ে কাজ করছিলাম। আপনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন, এটা আমার ব‍্যাক্তিগত কাজ। এজন্য নিজের অর্থের তেলে আরেকটি প্রদীপ নিয়ে এসেছি।

কথাটি শুনে চাণক্য সম্পর্কে সমস্ত কৌতূহল দূর হয়ে যায় ঐ পরিব্রাজকের। চাণক্যের আত্মার বন্ধন ছিল ভারতের দর্শনের সঙ্গে। এই বাক‍্যের সত্যতা পাওয়া যায় তাঁর রচিত চাণক্য নীতিচাণক্য শ্লোক গ্রন্থে। এই গ্রন্থগুলোতে তিনি প্রকৃত ভারতীয় ভাবধারায় জীবন পরিচালনার বিষয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন।

চাণক্য

সেই সময়ে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় সম্ভ্রান্ত, মেধাবী এবং রাজবংশীয় শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকতো। তক্ষশীলার অধ্যাপকগণ ও ছিলেন অনেক উচ্চ মানের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করা ছিল যে, সেখানে পড়াশোনার জন‍্য যাওয়া শিক্ষার্থীগণ অবশ্যই জ্ঞানার্জন করবে। রাজা সন্তানদের সঙ্গে একসাথে পড়াশুনা করার ফলে চাণক্যের মধ‍্যেও কিছুটা সৌখিন মনোভাবের সৃষ্টি হলেও, তিনি, জ্ঞানার্জন সম্পন্ন করে সঠিক পথেই গ্রহণ করেছিলেন।

তাঁর মতে, বিদ‍্যালাভ করে সেই বিদ‍্যা প্রচার করতে না পারলে সে জ্ঞান বিদ‍্যা, ক্ষুধার্ত থাকা অবস্থায় হাঁড়িতে খাবার সংরক্ষণ করার মতো। এজন্য তিনি নিজের পেশা হিসাবে শিক্ষকতাকে গ্রহণ করেন।আচার্য চাণক্য শুধু শিক্ষকতার মধ‍্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, নিজের উজ্জল প্রতিভা বিস্তার করে তৎকালীন ভারতে লেখক, দার্শনিক, শাসক, কূটনীতিবিদ, রাজ উপদেষ্টা সহ বহু গুণে গুণী হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময়ে সমাজ ও মানবজীবন সম্পর্কিত তাঁর রচিত চাণক্য নীতিচাণক্য শ্লোকের বাণীগুলো বর্তমান সময়ে মানবজীবন বদলে দিতে পারে! চাণক্য প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম প্রবক্তা ছিলেন।

তাঁর রচিত বিখ্যাত কয়েকটি গ্রন্থ হলো- চাণক্যনীতি, চাণক্য শ্লোক, অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র প্রভতি। তাঁর রচিত ‘কৌটিল‍্য অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন, একটি রাষ্ট্র কীভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে গড়ে ওঠে এবং পূর্ণতা লাভ করে। তিনি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন, কীভাবে একজন রাজাকে নিজ রাজ‍্যের সীমানা অতিক্রম করে প্রতিবেশী ভূখণ্ড ও মূল্যবান সম্পদ নিজের রাজ‍্যের অধীনস্থ করতে হয়। সেইসঙ্গে সম্পদ ও সাম্রাজ্য বর্ধনের মাধ্যমে নিজ প্রজাদের নিরাপত্তা, উন্নতি ও নাগরিক জীবন উন্নত করতে করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।

তাঁর রচিত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি যদিও নামে অর্থশাস্ত্র কিন্তু এটি মূলত শাসকের রাজ‍্যশাসন ও কূটনীতিবিষয়ক বিশেষ কৌশলের বহু পরামর্শের ভান্ডার।
তখনকার সময়ে রাজা সম্রাটগণ তাদের রাজসভায় কয়েকজন জ্ঞানবান পণ্ডিতদের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী, রাজ পরামর্শ সহ কিছু বিষয়ে এসব পণ্ডিতের অনেকটা ভূমিকা ছিল।

রাজা চন্দ্রগুপ্তের মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় চাণক্যের ভূমিকা

মৌর্য রাজবংশের প্রথম রাজা চন্দ্রগুপ্ত মগদ রাজ‍্যের রাজক্ষমতা অর্জন ও শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পেছনে চাণক্যের ভূমিকা অপরিসীম ও অবদান অনস্বীকার্য। চাণক্য নীতি ও পরামর্শের গুণে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিলেন। ভারতীয় ইতিহাসে বিখ্যাত বিন্দুসার এই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যেরই দ্বিতীয় পুরুষ এবং তৃতীয় প্রজন্ম ছিলেন সম্রাট অশোক। যিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান অর্জন করেছেন।

মগধ রাজ‍্যের পতন এবং মৌর্য্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করেছিলেন। চাণক্যের পরামর্শে চন্দ্রগুপ্ত মগধ রাজ‍্য জয় করার জন্য একটি সামরিক বাহিনী তৈরি করেন এবং সেইসাথে পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি তৈরি করেন। মৌর্য্য সাম্রাজ্যকে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যের রুপ দিতে চন্দ্রগুপ্তকে বহু পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছেন চাণক্য।

পরাক্রমশালী নন্দ রাজবংশকে সিংহাসনচ‍্যুত করে পাটালিপুত্রে মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা ও ভারতবর্ষে শক্তিশালী সাম্রাজ্য তৈরী করতে তাঁর অবদান অপরিসীম। এজন্য রাজা চন্দ্রগুপ্তের রাজ সভায় প্রধান পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং ইতিহাসের সবচেয়ে প্রখর বুদ্ধি ও জ্ঞানী মন্ত্রীদের একজন ছিলেন। রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে চাণক্যের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য বলা যায়। একসঙ্গে দীর্ঘদিন জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে দুজনের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে নীতিশাস্ত্র জ্ঞান শেখানোর পাশাপাশি একজন সুদক্ষ বীর যোদ্ধা হিসাবে গড়ে তোলেন। গুরুর পরামর্শে চন্দ্রগুপ্ত বেশকিছু আঞ্চলিক শাসকদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। চাণক্যের প্রখর বুদ্ধি ও দূরদর্শী পরামর্শে এই মৌর্য সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে পশ্চিমে সিন্ধু নদী থেকে শুরু করে পূর্বে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত।

সেই সময় মগধ রাজ্যে ক্ষমতায় ছিলেন, পরাক্রমশালী বিতর্কিত শাসক হিসাবে পরিচিত নন্দ বংশের শেষ রাজা ধনানন্দ। অন্যায় ও অপশাসনের জন্য প্রজাদের কাছে তিনি ঘৃণার পাত্র ছিলেন। একসময় রাজা ধনানন্দ, পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্য ভালো একজন ব্রাহ্মণ সন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর মন্ত্রীকে। মন্ত্রী আচার্য চাণক্যকে ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধের পুরোহিত হওয়ার অনুরোধ করেন। চাণক্য সময়মতো রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে পুরোহিতের আসন গ্রহণ করেন।

কিন্তু চাণক্যের চেহারা ভালো না হওয়ার কারণে, ধনানন্দ রেগে গিয়ে চাণক্যকে অপমান করেন এবং চলে যেতে নির্দেশ দেন। প্রথমে চাণক্য রাজা ধনানন্দকে সুন্দর ভাষায় বোঝানোর প্রচেষ্টা করেন। কিন্তু রাজা ধনানন্দ এই বিষয়ে কর্ণপাত না করে, উল্টো অন্য রাজ কর্মচারীদের দিয়েও অপমান করেন। ফলে রাগন্বিত হয়ে চাণক্য সেই স্থান ত‍্যাগ করেন এবং এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিজ্ঞা করেন।

এই বিষয়ে মতানৈক্য আছে। কিছু পন্ডিতদের মতে, নিষ্ঠুর রাজা ধনানন্দের ইচ্ছে অনুযায়ী জ্ঞানী পণ্ডিতদের একটি দল রাজদরবারে এসেছিলেন শ্রাস্ত্র আলাপ ও তাঁদের কথা আলোচনা করতে। তক্ষশীলা থেকে আচার্য চাণক্য এসেছিলেন এই সন্মেলনে এবং তিনি অজান্তেই রাজপুরোহিতের জন‍্য নির্দিষ্ট করা আসনটি শূন্য দেখে বসেছিলেন। ধনানন্দ দেখে প্রচন্ড রেগে অপমানিত করেন চাণক্যকে এবং সেইসাথে রাজ কর্মচারিদের দিয়েও অপমান করেন।

এভাবে অপমানিত হওয়ার পর চাণক্য আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর মাথার শিখা খুলে ফেললেন এবং রাজসভায় প্রকাশ‍্যে প্রতিজ্ঞা করেন, এই রাজার পতন না হওয়া পর্যন্ত তিনি আর মাথার শিখা বাঁধবেন না। এরপর প্রহরীরা তাঁকে ধরতে আসলে সেখান থেকে গোপন সুড়ঙ্গপথে চাণক্যকে পালাতে সহায়তা করেন ধনানন্দের পুত্র পর্বত।

অপরদিকে এই মগদের রাজা ধনানন্দের সৎ ভাই চন্দ্রগুপ্ত (তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন পিতা মহাপদ্মের ঔরসে দাসী মুরা’র গর্ভে) মগদ রাজ‍্যের সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা করছিলেন। কারণ, পিতা মহাপদ্মের মৃত্যুর পরে রাজা ধনানন্দ, তাঁর মাতা সহ তাঁকে মগদ রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। এজন্য চন্দ্রগুপ্ত, ধনানন্দকে পরাজিত করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বিফল হয় এবং প্রাণ বাঁচাতে চন্দ্রগুপ্তকে বিন্ধালের জঙ্গলে অজ্ঞাতবাস গ্রহণ করতে হয়।

 

চাণক্য শ্লোক
চাণক্য শ্লোক

এই সময়ে কাকতলীয়ভাবে আচার্য চাণক্যের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের পরিচয় হয় এবং এই সাক্ষাৎ চন্দ্রগুপ্তের জীবনের ইতিহাসের পথ পরিবর্তন করে দেয়! চন্দ্রগুপ্তের মনের মধ‍্যে থাকা প্রতিশোধ এবং সিংহাসন আহোরণের ইচ্ছা কাজে লাগাতে চাইলেন চাণক্য। অপমানের বদলা নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ হয়তো মনে করেছিলেন তিনি। অপরদিকে চন্দ্রগুপ্তও চাণক্যের পাণ্ডিত্য গুণে মুগ্ধ হয়ে নিজ জীবনের লক্ষ্যে পৌছাতে চাণক্যকে গুরু, উপদেষ্টা ও প্রধান মন্ত্রণাদাতা হিসেবে গ্রহণ করেন।

তারপর চাণক্যের সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করেন। পরিকল্পনাকে সফল বাস্তবায়ন করতে বুদ্ধি ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করেন চাণক্য। চাণক্য নীতি ও পাণ্ডিত্যের কারণে এবং চন্দ্রগুপ্তের বীরত্বে অবশেষে নন্দরাজা পরাজিত হয়। মগধ রাজ‍্যের সিংহাসনে আরোহণ করে ক্ষমতা দখল করে রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এই বংশই ভারতীয় ইতিহাসে শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

চন্দ্রগুপ্ত বিজয় অর্জনের পরে নিষ্ঠুর রাজা ধননন্দকে নির্দেশ দেন- একটি রথে যতটা ধনসম্পদ নেওয়া যায়, ঠিক ততটুকু নিয়ে নিজ পরিবারসহ রাজ‍্য ছেড়ে চলে যেতে। সেই সময় চাণক্যের নির্দেশে ধনানন্দের কন‍্যা দুর্ভারাকে চন্দ্রগুপ্ত বিয়ে করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধের রাজসিংহাসন আহোরণ করার পরে চাণক্যকে তাঁর প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেন এরপর মাথার শিখা বেঁধে নিজ প্রতিজ্ঞা পূরণ করেন চাণক্য।
অপরদিকে কিছুদিন পর খবর আসে, পথে আততায়ীদের হাতে অত‍্যাচারী রাজা ধনানন্দ নিহত হয়েছে।

চাণক্যের জীবনের সবচেয়ে বড় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

পন্ডিতদের মতে, অর্থশ্রাস্ত্র গ্রন্থ রচনা আচার্য চাণক্যের জীবনের সবচেয়ে বড় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রায় ২ হাজার বছরের বেশি সময় অতিক্রম হলেও, আজও অর্থশাস্ত্র গ্রন্থ নিয়ে অনেক কৌতূহল ও আলোচনা বিদ‍্যমান এবং ভবিষ্যতেও এই অমূল্য গ্রন্থের ব‍্যাপক চাহিদা থাকবে। এই গ্রন্থকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বকোষ বললেও হয়তো অনেক কম বলা হবে।

আচার্য চাণ‍্যকের এই অর্থশ্রাস্ত্র গ্রন্থে দর্শনশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি, বাজেট ব্যবস্থা, আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সরকার পরিচালনার নীতি, বাজার ব্যবস্থা, বাণিজ্য, যুদ্ধনীতি, খনিজ সম্পদের ব্যবহার, পরিবেশ প্রকৃতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, কৃষি ব‍্যাবস্থা সহ রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনীয় সব বিষয় এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তাঁর গবেষণালব্ধ শ্লোক গুলো তিনি অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন, কৌটিল‍্য অর্থশাস্ত্র নামে যে গ্রন্থ আমাদের মাঝে পরিচিত। তাঁর অসীম জ্ঞান ও গবেষণা থেকে এই সমস্ত নীতি গুলো প্রবর্তিত হয়েছে, এবং এই শ্লোক গুলো সম্পূর্ণরূপে বাস্তব বিন্দুমাত্র আবেগতাড়িত নয়। রাষ্ট্রের শাসক ও প্রশাসনের দিক নির্দেশক গ্রন্থ এটি। আজও ভারতবর্ষ কূটনীতির দিকে এই গ্রন্থকে প্রথমে রাখে।

আবার কয়েকজন ঐতিহাসিক মনে করেন, তাঁর কিছু লেখার সংকলন হলো এই “অর্থশাস্ত্র” গ্রন্থ। তবে “অর্থশাস্ত্র” গ্রন্থের শ্লোকে “কৌটিল‍্য” এবং একটি শ্লোকে “বিষ্ণুগুপ্ত” নাম আছে। বেশিরভাগ ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে কৌটিল্য এবং বিষ্ণুগুপ্ত তাঁর ছদ্মনাম ছিল। ঐতিহাসিকগণের ধারণা, এই নামগুলোর মধ্যে কৌটিল্য তাঁর গোত্রের নাম ছিল। মূলত ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থের জন্যই তাঁর এই কৌটিল্য নামটি ব‍্যাপক প্রচারিত হয়ে আসছে। আবার সেই গ্রন্থের এক জায়গায় লেখককে বিষ্ণুগুপ্ত নামে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাছাড়াও বিষ্ণুগুপ্ত যে চাণক্যের নাম ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় অব্দের বিষ্ণু শর্মা নামক এক পন্ডিতের ‘পঞ্চতন্ত্র’ নামের সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি লেখায়। খুব কমসংখ্যক ইতিহাসবিদই মনে করেন যে চাণক্য এবং কৌটিল্য আলাদা ব্যক্তি। আবার কেউ কেউ মত প্রকাশ করেন, চাণক্য ও কৌটিল্য একই ব্যক্তি হলেও অর্থশ্রাস্ত্র গ্রন্থের সম্পাদক বিষ্ণুগুপ্ত আলাদা ব‍্যাক্তি। তবে বেশিরভাগ ইতিহাস বিশ্লেষক ও পন্ডিতদের মতে, চাণ‍্যকের ছদ্মনাম ছিলো কৌটিল‍্য ও বিষ্ণুগুপ্ত। আবার কিছু ঐতিহাসিকের মতে, বিষ্ণুগুপ্ত নাম তাঁর পিতা দিয়েছিলেন।

গবেষক থমাস ট্রটম‍্যান (Thomas R. Trautman) এর মতে, বিখ্যাত “অর্থশাস্ত্র” গ্রন্থের সম্পাদক বিষ্ণুগুপ্ত এবং চাণক্য তাঁর গোত্রনাম ছিলো। আবার বিষ্ণুশর্মার রচিত “পঞ্চতন্ত্র” অনুযায়ী চাণক্য ও বিষ্ণুগুপ্ত এই দুইটি নাম একই ব‍্যক্তির।

চাণক্যের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না, কারণ এই ইতিহাস প্রায় ২৩০০ বছর পূর্বের এবং ধারণা করা হয় বিশুদ্ধভাবে এই ইতিহাস কিছুটা লিখিত থাকলেও আব্রাহামিক আগ্রাসনে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাছাড়াও প্রায় প্রতিটি বিষয়ে ইতিহাসবিদগণের মধ্যে মতপার্থক্য এবং বিতর্ক রয়েছে।

তারপরও এখানে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত তথ্যগুলো সংগ্রহ করে পাঠকদের জন‍্য এই আর্টিকেলে তুলে ধরা হয়েছে। রাজা চন্দ্রগুপ্তকে শত্রুরা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত‍্যা করতে পারে, এই আশঙ্কায় চন্দ্রগুপ্তের খাবারে তাঁর অজান্তে একটু একটু করে বিষ মিশিয়ে দিতেন চাণক্য, গৃহপরিচারিকার সহায়তায়। ইতিহাসে এই ঘটনা হয়তো প্রথম, মানুষের দেহে বিষের প্রতিরোধক তৈরির সফল প্রচেষ্টা যেটা করেছিল চাণক্য।

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় চাণ‍ক‍্য নীতির কৌশলী বিজয়

যখন আলেকজান্ডার ভারতভূমি আক্রমণ করে বহু এলাকা দখল করতেছিলেন, সেইসময় চাণক্য আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর যুদ্ধকৌশল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। মৌর্যরাজ চন্দ্রগুপ্ত গ্রিকদের অধীনস্থ থেকে সমগ্র উত্তর ভারত মুক্ত করে নিজ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন চাণক্য নীতির প্রভাবে। মূলত এই বিজয়ের জন‍্য আড়ালে থেকে নিখুঁত পরিকল্পনা করতেন চাণক্য।
পন্ডিতদের মতে, যদি চন্দ্রগুপ্ত ও তার সেনাবাহিনীকে একটি মানবদেহ হিসাবে দেখা হয় তবে, তার মতিষ্ক ছিলেন চাণক্য

প্রত‍্যক্ষভাবে যুদ্ধ করে গ্রিকদের পরাজিত করে বিতাড়িত করা সম্ভব না এটা বুঝতে পেরে, চাণক্য পরামর্শ দেন আলেকজান্ডারের নিয়োগ কৃত প্রাদেশিক শাসক একজন একজন করে পরাজিত করে বধ করার। এর ফলে ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর আগেই তৎকালীন ভারতের উত্তর গান্ধারা অঞ্চলে (বর্তমান আফগানিস্তান) আলেকজান্ডারের ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাছাড়াও আলেকজান্ডারের মৃত্যুবরণের ২ বছরের মধ্যে গ্রিকরা ভারতবর্ষ শাসনের আশা পরিত‍্যাগ করে।

জৈন উপকথায় চাণক্য

জৈন উপকথায় চাণক্যের বিষয়ে একটি জনপ্রিয় উপকথা প্রচলিত আছে। সেই উপকথা অনুযায়ী – চাণক্য ধারণা করতেন শ্রত্রুরা যেকোনো দিনে চন্দ্রগুপ্তকে খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করতে পারে। এজন্য চন্দ্রগুপ্তের শরীরে প্রতিরোধক তৈরি করার জন‍্য তিনি প্রতিদিন চন্দ্রগুপ্তের খাবারের মধ‍্যে সামান্য পরিমাণে বিষ মিশ্রিত করে দিতেন। রাজা চন্দ্রগুপ্ত এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। একদিন চন্দ্রগুপ্ত তাঁর সেই বিষ মিশানো খাবার তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী দুর্ধরাকে নিয়ে ভাগাভাগি করে খেতে থাকেন। দুর্ধরা সন্তান প্রসব থেকে অল্প কয়েকদিনের দূরত্বে ছিলো।

অজান্তে খাওয়া সেই বিষের খাবারের প্রতিক্রিয়ায় দুর্ধরা মৃত্যুশয্যায় উপনীত হলে, তাঁর গর্ভের সন্তানকে বিষের প্রভাব থেকে রক্ষা করতে চাণক্য দুর্ধরার পেট কেটে সন্তানকে রক্ষা করেন। এই সন্তানই বিন্দুসার, পরবর্তীতে তিনি চাণক্যকে গুরু হিসাবে গ্রহণ করেন এবং চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পরে তিনি সিংহাসন আহোরণ করেন এবং চাণক্যকে নিজের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ করেন।

চাণক্য নীতি ও চাণক্য শ্লোকের রচয়িতা আচার্য চাণক্যের মৃত্যুবরণ

চাণক্য নীতিচাণক্য শ্লোকের রচয়িতা এই মহান পন্ডিত ও দার্শনিক ২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যু নিয়ে অনেক মতপার্থক্য আছে। অনেকের মতে স্বেচ্ছামৃত্যু, কেউ কেউ বলেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। এই বিষয়ে কিছু গ্রন্থে পাওয়া যায়-

রাজা চন্দ্রগুপ্তকে শত্রুরা বিষ প্রয়োগ করে হত‍্যা করতে পারে এই ধারণার কারণে, চাণক্য রাজার রান্নার কাজে নিযুক্ত গৃহপরিচারিকার সহায়তায় প্রতিদিন সবার অজান্তে চন্দ্রগুপ্তে খাবারে একটু একটু করে বিষ মিশিয়ে দিতেন শরীর বিষ প্রতিরোধক তৈরী করতে। কাকতলীয়ভাবে একদিন ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। অজান্তে একদিন মগদরাজ চন্দ্রগুপ্ত নিজের খাবার থেকে কিছু অংশ রাণী দুর্ভারাকে দেন।
সেই বিষযুক্ত খাবারের প্রভাবে রাণী দুর্ভারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

সংবাদ পেয়ে চাণক্য দ্রুত ছুটে এসে দুর্ভারার পেট কেটে বের করেন তাঁর পুত্রকে। ততক্ষণে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর শরীরে কিছুটা বিষের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। শিশুটিকে বাইরে বের করার পরে দেখা যায়, তাঁর কপালে বিষক্রিয়ার প্রভাবে একটি নীল বিন্দু। এজন্যই শিশু পুত্রটির নাম রাখা হয় “বিন্দুসার।”

বিন্দুসার যুবক বয়সে পদার্পণ করার পরে বৃদ্ধ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নিজ পুত্র বিন্দুসারের হাতে রাজ ক্ষমতা হস্তান্তর করে তীর্থস্থানে গিয়ে উপবাসে দেহত্যাগ করেন। চাণক্য তখনও বিন্দুসারের রাজ উপদেষ্টা ছিলেন কিন্তু হেমচন্দ্রের “পরিশিষ্টপর্ব” অনুযায়ী বিন্দুসারের মন্ত্রী সুবন্ধু চাণক্যকে অপছন্দ করতেন। তিনি রাজা বিন্দুসারকে তাঁর মায়ের মৃত্যুর জন্য চাণক্যকে দায়ী করে কুমন্ত্রণা এবং সাজা দিতে প্ররোচনা দেন। এই কারণে বিন্দুসারের মনে চাণক্যর প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন মনোভাব তৈরি হয়।

দুই জনের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টির কারণে চাণক্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন রাজ দায়িত্ব ত‍্যাগ করে স্বেচ্ছামৃত্যুর। অপরদিকে রাজার ভুল ধরিয়ে মনে থেকে বিদ্বেষ দূর করেন রান্নার কাজে নিযুক্ত সেই দাসী। তিনি বিন্দুসারকে সব ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করে বুঝিয়ে দেন, তাঁর মায়ের মৃত্যুর জন্য আচার্য চাণক্য কখনোই সরাসরি দায়ী না। এটি শুধুমাত্র একটি দুর্ঘটনা ছিল এবং তাঁর পিতা চাণক্যের জন‍্যই বনবাস থেকে মগদের ক্ষমতায় গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করতে পেরেছিলেন।

ভুল বুঝতে পেরে বিন্দুসার দ্রুত মন্ত্রীকে প্রেরণ করেন চাণক্যকে ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু এরমধ্যেই চাণক্য স্বেচ্ছামৃত‍্যু গ্রহণ করতে চলে গিয়েছেন। মন্ত্রী গিয়ে চাণক্যকে জানায়- রাজা বিন্দুসার ক্ষমাপ্রার্থী, তিনি পুনরায় আচার্যের সান্নিধ্য চেয়েছেন। এসব শুনে কিছুটা মৃদু হাসলেন চাণক্য।

তারপর হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠে চাণক্যের বেদিতে। অনেকেই দেখেছিলো, সেই বেদীতে আগুন লাগিয়ে দ্রুত প্রস্থান করেন মন্ত্রী সুবন্ধু। এরপর অগ্নিগ্রাস থেকে চাণক্যকে যখন উদ্ধার করা হয়, ততক্ষণে চাণক্য পৃথিবীর মায়া ত‍্যাগ করেছেন।

একজন মহান জ্ঞানবান পন্ডিতের আলোকজ্বল জীবন এভাবেই শেষ হয়, কিন্তু পৃথিবীতে চাণক্য নীতিচাণক্য শ্লোকের মাধ্যমে আজও তিনি অমর! পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের উল্লেখযোগ্য এক ভান্ডার হিসেবে তিনি ভারতীয় ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন! চাণ‍ক‍্য নামের এক অসাধারণ ব‍্যক্তি এভাবে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এই ভূবনের মানসভূমিতে আজও তাঁর অসাধারন জ্ঞানের প্রভাবে দ্বিপ্তিময় হয়ে বিচরণ করছেন।

হাজার বছর অতিক্রম হলেও, আজও তাঁর রচিত চাণক্য নীতি ও চাণক্য শ্লোক বর্তমান সময়েও সমৃদ্ধ মানব জীবন ও দেশ গঠনে অতুলনীয়। পাঠকদের জন‍্য কয়েকটি নীতি ও শ্লোক উল্লেখ করা হলো-

মানুষ চেনার উপায় চাণক্য নীতি

* প্রতিটি মানুষেরই শতভাগ সৎ হওয়া অনুচিত। কারণ একেবারে সোজা গাছ যেভাবে সবার প্রথমে কাটা হয়, সৎ মানুষ সেভাবেই সহজে বিপদগ্রস্ত হয়।

* ভৃত্যের যথার্থ স্বরূপ তাঁর কাজের মাধ্যমে জানবে, বন্ধুর যথার্থ স্বরূপ সংকট বিপদের সময়ে জানবে। মিত্রের যথার্থ স্বরূপ উপদ্রব উপস্থিত হলে জানবে এবং ধনসম্পত্তি নাশের কালে স্ত্রীর যথার্থ স্বরূপ জানবে।

* একশত মূর্খ সন্তানগণের থেকে একটি গুণীপুত্র অনেক ভালো। একটি চাঁদ যতটা অন্ধকার দূর করে, আকাশের সব তারা একসঙ্গেও সেটা করতে পারে না।

 

চাণক্য নীতি
চাণক্য নীতি

* জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো শৈশব থেকে শ্রবণ করা এই বিখ্যাত নীতিবাক্য চাণক্য প্রণীত।

* অপরের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো।

* সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গুরুমন্ত্র হচ্ছে নিজের গোপনীয়তা অন‍্য কারুর কাছে প্রকাশ না করে গোপন রাখা।

* ফুলের সৌরভ শুধু বাতাসের দিকে ছড়ায়। কিন্তু একজন ভালো মানুষের গুণ সর্বদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

* মূৰ্খ ব‍্যাক্তি উত্তম পোশাকে আবৃত হয়ে দূর থেকেই শোভা প্রকাশ করে, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই মূর্খ ব‍্যাক্তি কোন কথা না বলে। কথা বললেই তাঁর প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

* যে ব্যক্তি আনন্দ অনুষ্ঠানে, বিপদ সময়ে, শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ সময়ে, বিচারালয়ে এবং শবদাহ সময়ে নিকটে উপস্থিত থাকেন একমাত্র তিনিই প্রকৃত বন্ধু।

চাণক্য নীতি শত্রু দমন

* যে ব্যক্তি সামনাসামনি মিষ্টি কথা বলে কিন্তু পরোক্ষভাবে ক্ষতি করে, এমন মুখে মধু অন্তরে বিষ টাইপের বন্ধুকে পরিত্যাগ করা উচিত।

* যে ব্যক্তি একবার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে এমন বন্ধুর সঙ্গে পুনরায় বন্ধুত্ব যে করে সে প্রকৃতপক্ষে নিজের মৃত্যু ডেকে আনে।

* দুর্বল ব‍্যাক্তির একমাত্র ভরষা রাজা, শিশুর একমাত্র শক্তি কান্না, মূর্খ ব‍্যাক্তির শক্তি নীরবতা, এবং চোরের একমাত্র শক্তি মিথ্যা বলা।

* খারাপ স্ত্রী, প্রতারক বন্ধু, দুর্মুখ চাকর এবং সর্প গৃহে বাস করা মৃত্যুর ঘরে থাকা একই কথা।

* হাতের কাঁটা দিয়ে যেমন পায়ে গেথে যাওয়া কাঁটা তোলা হয় তেমনি শত্রু দিয়ে অন্য শত্রুকে উচ্ছেদ করবে।

* অপ্রয়োজনে কেউ কারো বন্ধু হয় না, শত্রুও হয় না কোনো কারণবশতঃ কেউ কারো বন্ধু অথবা শত্রু হয়ে থাকে।

* দুর্জন ব্যক্তি মিষ্টভাষী হলেও তাকে বিশ্বাস করা যা না, কারণ তাঁর মুখে মধু থাকে আর অন্তরে বিষ থাকে।

* দুর্জন ব্যক্তি বিদ্বান হলেও তাকে পরিত্যাগ করা উচিত। কারণ কোনো সাপ মণিতে আলোকিত হলেও সেটা ভয়ংকর সাপই থাকে।

* সাপের স্বভাব নির্মম দুর্জন ব‍্যাক্তিরও তাই। তবে দুর্জন ব‍্যাক্তি সাপের থেকেও বেশি ক্রূর। কারণ সাপকে মন্ত্র অথবা ওষধের মাধ্যমে বশে আনা যায়, কিন্তু দুর্জনকে কে নিবৃত্ত করবে?

* বুদ্ধিমান ব্যক্তি একপায়ে চলেন, আরেক পায়ে স্থির থাকেন পরের জায়গা না দেখে আগের জায়গা ছাড়া উচিত নয়।

* লোভী ব‍্যাক্তিকে অর্থ দিয়ে, রাখন্বিত ব‍্যাক্তিকে হাত জোড় করে, মূর্খকে তার মন জুগিয়ে এবং পণ্ডিতকে যথার্থ কথা বলে বশীভূত করবে।

* সম্পত্তি এবং শস্য প্রভৃতির ক্রয়-বিক্রয় অথবা এই সব জিনিস ধার দিয়ে সুদের আদান-প্রদানের সময়, বিদ্যার্জনের সময়, খাওয়ার সময় এবং মামলা-মোকদ্দমার সময় সর্বদা লজ্জাশূন্য হওয়া উচিত।

* কাজের পরিকল্পনা মনে থাকবে, তা মুখে যেন প্রকাশ না পায়। কারণ যে কাজের কথা অন্য লোক আগেই জেনে ফেলে- সেই কাজে সাফল্য আসে না।

* বিচক্ষণ ব্যক্তি রোগে আক্রান্ত দেশ, অপরাধীদের দেশ, নিন্দনীয় জীবিকা অর্জন, দুশ্চরিত্রা স্ত্রী, খারাপ নদী, খারাপ দ্রব্য এবং খারাপ খাবার বর্জন করবেন।

* যেহেতু ঋণের অবশেষ অংশ, আগুনের অবশেষ অংশ, এবং রোগের অবশেষ অংশ পুনরায় বৃদ্ধি পায়, এজন্য এগুলোর অবশেষ রাখবে না।

* ঋণী পিতা, দুশ্চরিত্রা মাতা, অতিরূপবতী স্ত্রী এবং মূর্খ পুত্র শত্রুরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে।

* বিদ্যাহীনের জীবন শূন্য, বন্ধুহীনের সবদিক শূন্য, পুত্রহীনের গৃহ শূন্য আর দরিদ্রের সবই শূন্য।

* পরাধীন জীবিকা নির্বাহ কষ্টকর, নিরাশ্রয় ব্যক্তির অন‍্যের বাড়িতে বসবাস কষ্টকর, ধনহীনের পক্ষে ব্যবসা বাণিজ্য করা কষ্টকর আর দারিদ্র্য সকল কষ্টের কারণ।

* অধমেরা ধন চায়, মধ্যমেরা ধন ও মান চায়। উত্তমেরা শুধু মান চায়। মানই মহতের ধন।

চাণক্য নীতি ও চাণক্য শ্লোক পিডিএফ পড়তে এখানে ক্লিক করুন!

One thought on “চাণক্য নীতি | চাণক্য শ্লোক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *