ইতিহাসআলোচিত সংবাদ

গজনির সুলতান মাহমুদ এর ভারত আক্রমণ | সোমনাথ মন্দির ধ্বংস

Spread the love
20221129 235605
সুলতান মাহমুদ

গজনির সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণ | সোমনাথ মন্দির ধ্বংস

আরব থেকে আসা মুসলিম লুটেরাদের ভারতবর্ষ আক্রমণের তালিকা অতি দীর্ঘ হলেও,
নির্মমতার তালিকায় যে কয়েকজন আছে, তাদের মধ‍্যে সুলতান মাহমুদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য! সোমনাথ মন্দির ধ্বংসকারী গজনির সুলতান মাহমুদের মত এমন নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ করেছেন খুব কম আক্রমণকারী!

নির্বিচারে ব্যাপক হিন্দু হত্যা, হিন্দু স্থাপত্য ধ্বংস ও ইসলামে ধর্মান্তর করে ভারতবর্ষে ইসলামী ভিত শক্ত করার জন‍্য গজনির সুলতান মাহমুদকে একশ্রেণীর মুসলমানের নিকট গৌরব ও শ্রদ্ধার হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

গজনির সুলতান মাহমুদের ভারতবর্ষে এই অভিযান নিঃসন্দেহে মন্দির এবং মন্দিরে অবস্থিত দেব দেবীদের বিগ্রহ ধ্বংস করতেই পরিচালনা করা হয়েছিল।

শুধু গজনির সুলতান মাহমুদ নয়, সকল মুসলিম শাসকদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল সকল বিধর্মী রাজ‍্য দখল, স্থাপত্য ধ্বংস ও ধর্মান্তকরণ নয়তো হত‍্যা।

কারণ এই কাজে ইসলামের মহিমা প্রচার হয়, হয় অগ্রগতি আর নির্মূল হয় কাফেরের ধর্ম।

হিন্দুস্থান তথা ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রত্যেকটি মুসলিম আক্রমণকারীর লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব মন্দির ধ্বংস করা এবং হিন্দু হত্যা করে হিন্দুস্থানকে পৌত্তলিকতার পাপ থেকে মুক্ত করা।

আর ঠিক এই কারণেই সচেতন হিন্দুদের মধ‍্যে দেখা দেয় ঘৃণার প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়া।

গজনির সুলতান মাহমুদের সভার ঐতিহাসিক উত্তী (Utbi) বলেন, ‘নিজ বিশ্বাস ও ধর্মের প্রতি মামুদ মহৎ কর্তব্য পালন করে গেছেন।

একাদশ শতকে যখন আরবীয় ইসলামের সেনারা ভারতে আসে তলোয়ার হাতে বিজয়ীর ছদ্মবেশে তখনই সৃষ্টি হয় প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়া।

প্রজ্বলিত মশাল ও তলোয়ার হাতে এলেন গজনীর সুলতান মাহমুদ।
প্রতিবছর ভারত আক্রমণ করে তিনি হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব সৃষ্টি করতেন।

তারপর দেশে ফিরে যেতেন বিপুল ধন সম্পদ ও লক্ষ বন্দী নরনারী নিয়ে।
শুধু কাশ্মীর অভিযানে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। উত্তর ভারতে তিনি ছিলেন ভয়ংকর বিভীষিকা।

থানেশ্বর আক্রমণ করে তিনি ২,০০,০০০ বন্দি ও প্রচুর সম্পদ নিয়ে দেশে ফিরে যান। 

ভারতের ইতিহাসে তিনি একজন উল্লেখযোগ্য নির্মম শোষক।
কারণ, ১৭ বার তিনি ভারত আক্রমণ করেন।

গজনির সুলতান মাহমুদ ভারত অভিযানে আসতেন সম্পদ লুন্ঠন করতে। বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির তার লক্ষ্য ছিল।

সে সময়ে টাকা,পয়সা নিরাপদে রাখা হতো মন্দিরের প্রতিমার নিচের গোপন ঘরে।

গজনির সুলতান মাহমুদ কয়েক বছর পর পর আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে মন্দিরে জমাকৃত সোনা, দানা, সম্পদ নিয়ে যেতেন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ‍্যমে।

গজনির অপশাসন মধ্য এশিয়া, ইরান, আফগানিস্তান ও চীনের সামান্য অংশ এবং ভারতবর্ষের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।


গজনির সুলতান মাহমুদের জন্ম 

 

আফগানিস্তানের ইরান সংলগ্ন গজনির শাসক ইয়ামিনউদ্দৌলা আবুল কাসিম মাহমুদ, যিনি গজনির সুলতান মাহমুদ নামে পরিচিত ছিলেন।

গজনির সুলতান মাহমুদের জন্ম ৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২ নভেম্বরে বর্তমান আফগানিস্তানের (সাবেক জাবালিস্তান) গজনি শহরে।

তার পিতা সবুক্তগিন ছিলেন তুর্কি ক্রীতদাস এবং সেনাপতি, যিনি ৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে গজনভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

ইতিহাস গ্রন্থে গজনির সুলতান মাহমুদের শৈশব সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি।
ভ সুলতান মাহমুদের মাতা একজন সম্ভ্রান্ত ইরানি পরিবারের কন্যা ছিলেন।
এই সুবাদে ফার্সি সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন তিনি।

মাহমুদ কাওসারি জাহান নামে এক আমিরজাদিকে বিয়ে করেন তিনি এবং মোহাম্মদ ও মাসুদ নামে তার দুই পুত্র ছিল।

পর্যায়ক্রমে এরা মাহমুদের উত্তরাধিকারী হিসেবে শাসন পরিচালনা করেন।
পরবর্তীতে মাসুদের পুত্র মওদূদ গজনভি সাম্রাজ্যের শাসন কর্তা হয়।

মালিক আইয়াজ নামে এক জর্জিয়ান দাস গজনির সুলতান মাহমুদের একজন সার্বক্ষনিক সঙ্গী ছিল।
ইতিহাসে পাওয়া যায়, আইয়াজ শুধু সঙ্গী ছিল না, বন্ধু, সহযোগী ও পরামর্শদাতা ছিলেন।

৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে পিতা সবুক্তগিনের খোরাসান অভিযানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গজনির সুলতান মাহমুদের রাজকার্যে অংশগ্রহণ শুরু হয়।

সামানি শাসক দ্বিতীয় নূহের সহায়তায় তিনি খোরাসান অধিকার করতে সমর্থ হন।
বিভিন্ন অভ্যন্তরীন দ্বন্দে এই সময় সামানি রাজবংশ খুব সংকটময় সময় পার করছিল।

ফলে গজনি ক্রমে প্রভাবশালী ক্ষমতায় পরিণত হতে থাকে।
৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সবুক্তগিন মারা যান এবং তার সন্তান ইসমাইল গজনভির সুলতান হিসাবে সিংহাসনে বসেন।

 

গজনির সুলতান মাহমুদের ক্ষমতা দখল 

তবে গজনির সুলতান মাহমুদ তার ভাই ইসমাইলের থেকে বড় এবং অভিজ্ঞ হলেও সৎ মায়ের প্রভাবে তিনি প্রথমে ক্ষমতার লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়েন।

মাহমুদের বৈমাত্রেয় মাতা ছিলেন সবুক্তগিনের পৃষ্ঠপোষক আলাপ্তগিনের কন্যা এবং প্রভাবশালী রাজমাতা, আর তার সুবাদে ইসমাইল ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পান।

কিন্তু গজনির সুলতান সুলতান মাহমুদ খুব দ্রুত রাজ্য ও শাসন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
১৯৭ খ্রিঃ মাহমুদ বিদ্রোহ করেন
এবং তার আরেকটি ভাই আবুল মুজাফ্ফারের সহায়তায় ইসমাইলকে পরাজিত করে গজনভি সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব লাভ করেন।

তিনি তার আরেক সহযোগী আবুল হাসান ইসফারাইনিকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গজনি থেকে পশ্চিমে কান্দাহারে অভিযানের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন।

গজনির সুলতান মাহমুদ দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী তৈরী করে নিজের শক্তি ও প্রাধান্য চারদিকে ক্রমাগত বৃদ্ধি করতে থাকেন।

গজনির সুলতান মাহমুদের বাহিনী
গজনির সুলতান মাহমুদের বাহিনী

১০৩০ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ এপ্রিল মৃত্যুর পূর্বে তিনি পূর্ব ইরানের ভূমি এবং ভারত উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশ
(বর্তমান’আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) দখল করেন
এবং ভারতে বার বার আক্রমণ করে নারকীয় তান্ডব করেন।

গজনির সুলতান মাহমুদের শাসনামলে ক্ষুদ্র গজনী এক বিশাল শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

 

গজনির সুলতান মাহমুদের ভারতবর্ষ আক্রমণের ইতিহাস 

ঐতিহাসিক নেহেরুর মতে, প্রাচীন কাল থেকে বহির্বিশ্বে ভারতবর্ষ পরিচিতি হিন্দুস্থান নামে।

সকল মুসলমান ঐতিহাসিক ও বিজেতাগণ এদেশকে হিন্দুস্থান নামেই অভিহিত করেছে।

বৃহত্তর খুলনা জেলা যেভাবে হিন্দু শূণ্য হল!

“India” বা “ভারত” নামের প্রচলন হয় ইংরেজ শাসনামলে।
“সিন্ধু” ভাষা ও উচ্চারণগত কারণে পারসিকদের নিকট হয় “হিন্দু” গ্রিকদের ইন্দু ও সর্বশেষ ইংরেজদের কাছে India. সিন্ধু-হিন্দু-ইন্দু-ইন্ডিয়া।

ঐতিহাসিক Will Durant এর মতে, প্রতি শীতে গজনির সুলতান মাহমুদ হিন্দুস্থানে (ভারতবর্ষে) আক্রমণ করতেন।
হিন্দুস্থানের সম্পদ লুণ্ঠন করে পূর্ণ করতেন তাঁর কোষাগার।

(রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর) চিত্ত বিনোদনের জন্য লুণ্ঠন ও হত্যায় সৈন্যদের দিতেন অবাধ স্বাধীনতা।

তারপর পূর্বের থেকে আরও ধনী হয়ে বসন্তে ফিরে যেতেন স্বদেশে।
ভারতবর্ষ থেকে লুণ্ঠিত মণিরত্নের প্রদর্শনী করে তিনি বিদেশী রাজদূতদের চমৎকৃত করতেন।

এই সকল রত্নগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল,
পরিস্ফুত হিমায়িত মদ অথবা অগ্নিকণার মত প্রদীপ্ত মুক্তা ও পদ্মরাগ মণি,
চিরহরিৎ গুল্মের সবুজ সতেজ পত্ররাজির ন্যায় পান্না এবং আকার ও ওজনে পক্ক দাড়িম্বের মত বৃহৎ হীরকখণ্ড।

রেফারেন্সঃ
1. পণ্ডিত নেহেরু ভারত সন্ধানে (Discovery of India) পৃ.২০০

মামুদের ঐতিহাসিক Al Utbi লিখেছেন, তিনি বিধর্মীদের মন্দির ধ্বংস করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন।

 

নগরের পর নগর গজনির সুলতান মাহমুদ অধিকার করেছেন;
মুসলমানদের অভিলাষ পূর্ণ করতে নীচ কাফেরদের হত্যা করেছেন
এবং ভাঙচুর করেছেন তাঁদের দেবতার বিগ্রহ।

তারপর স্বদেশে ফিরে গিয়ে গর্বে প্রচার করেছেন ইসলামের বিজয় কাহিনি!
খোদার নামে শপথ নিয়েছেন প্রতি বছর তিনি হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধ পরিচালনা করবেন।

ভারত অভিযানে তিনি এমন হিংস্র বর্বর পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন, যা হিন্দুদের মনে ভয়ের সঞ্চার করত।

উদ্দেশ্য যাতে মনোবল হারিয়ে হিন্দুরা প্রতিরোধের চেষ্টা না করে।
১০০১ খ্রিঃ গজনির সুলতান মাহমুদ রাজা জয়পালের রাজ্য আক্রমণ করেন।

যুদ্ধে জয়পাল পরাজিত ও বন্দি হন। মাহমুদ নির্দেশ দিলেন, ‘বন্দী জয়পালকে রাজপথে ঘোরানো হবে।

রাজার এই চরম দুর্গতি ও অপমান রাজপুত্রগণ ও রাজ কর্মচারীগণ স্বচক্ষে দেখবে।
সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে ইসলামের আতঙ্ক’!

you may also like…

মুঘলদের কট্টর শত্রু ছিলেন বাপ্পা রাওয়াল!

বিক্রমাদিত‍্যের বিক্রমী ইতিহাস!

সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন!

ভারতীয় ইতিহাসে কুখ্যাত তৈমুর লঙ!

১০১৯ খ্রিষ্টাব্দে চান রাই যুদ্ধে গজনির সুলতান মাহমুদের নিকট পরাজিত হয়। অসংখ্য হিন্দু নিহত এবং বন্দি হয়।
রাজধানী অরক্ষিত, লুণ্ঠনের সুবর্ণ সুযোগ।

ইসলামের বীর ধর্মযোদ্ধাদের সেদিকে কিন্তু খেয়াল নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁরা সূর্য ও অগ্নির উপাসক কাফেরদের রক্তে পরিতৃপ্ত – হচ্ছেন।

“কাফের হত্যা” গজনির সুলতান মাহমুদ ও তাঁর সৈনিকদের দিত অপার আনন্দ!

রেফারেন্সঃ
1. Will Durant – The Story of Civilization, P-460 2.
Quoted by Dr. Ambedkar – Writings and Speeches, P-56 3. Dr. B. R. Ambedkar-Writings and Speeches. Vol-8, P-57

আল-উৎবি লিখেছেন, ১০০১-১০০২ খ্রিষ্টাব্দে রাজা জয়পালকে আক্রমণ করলে,
আল্লাহ তার বন্ধুদেরকে এমন বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠনদ্রব্য প্রদান করেন যা সীমাহীন ও বর্ণনার অতীত;
এবং সেই সঙ্গে পাঁচ লক্ষ ক্রীতদাস নারী ও পুরুষ।

বন্দীদের মধ্যে ছিলেন রাজা জয়পাল নিজেও। তার সন্তানগণ, নাতি ও ভাতিজারা  তার গোষ্ঠীর প্রধান বর্গ এবং তার আত্মীয় স্বজন।

 

গজনির সুলতান মাহমুদ তাদেরকে বিক্রির জন্য গজনিতে  নিয়ে যান।
আল-উৎবি আরও লিখেছেন,
এক হাজার চৌদ্দ সালে নিন্দুনা (বর্তমান পাঞ্জাব) আক্রমণের ফলে ক্রীতদাসের দাম একেবারে সস্তা হয়ে পড়ে।

ভারতের বিশিষ্ট ও সম্মানিত হিন্দুগণ গজনীর সাধারণ দোকানদারের ক্রীতদাস হয়ে অপমানিত হতে থাকে।

গুরু তেগ বাহাদুরের স্বেচ্ছা বলিদান!

পরের বছর থানেসার হরিয়ানায় আক্রমণে মুসলিম বাহিনী ২ লক্ষ বন্দিকে গজনীতে  নিয়ে আসে।
এর ফলে গজনি ভারতের একটা নগরীর মত দেখায়।

সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিকের কয়েকজন করে ক্রীতদাস পুরুষ ও বালিকা ছিল।
১০১৯ সালের ভারত অভিযান থেকে তিনি ৫৩ হাজার বন্দিকে নিয়ে যান।

মাহমুদের ১৭ বার ভারত আক্রমণের মধ্যে কেবলমাত্র কাশ্মীর অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল।

তারিখ ই আলফি গ্রন্থটি উল্লেখ করে, তিনি খলিফার জন্য এক পঞ্চমাংশ আলাদা করে রাখেন,
যার মধ্যে ছিল ১ লক্ষ ৫০ হাজার ক্রীতদাস।

তার অর্থ দাঁড়ায় গজনির সুলতান মাহমুদ কমপক্ষে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার ক্রীতদাস বন্দী করে এনেছিলেন ভারত থেকে।

গজনির সুলতান মাহমুদ জানতে পারেন, হিন্দুস্থানে থানেশ্বর নামে একটি রাজ্য আছে। সেখানে রয়েছে জাগরসম (Jagarsom) দেবের বিশাল মন্দির।

হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি সংগ্রহ করেন এক বিশাল সেনাবাহিনী।
তারপর হিন্দুস্থান তথা ভারতবর্ষের দিকে অগ্রসর হন।

জয়পালের পুত্র গুপ্তচরের মাধ্যমে এ সংবাদ শুনে মামুদের নিকট প্রস্তাব করেন, 
সুলতান যদি এ অভিযান থেকে বিরত হন তবে তাঁকে ৫০টি হাতি “নজরানা” বাবদ দেওয়া হবে।

গজনির সুলতান মাহমুদ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। থানেশ্বর পৌঁছে তিনি দেখেন শহর জনশূন্য।
সৈন্যরা রাজধানী ধ্বংস করে লুণ্ঠনে মত্ত হয়।

ভাঙচুর করে অগণিত দেবমূর্তি ও মন্দির। গজনী সুলতানের নির্দেশে জাগরসম দেবের মূর্তি নিয়ে,
মসজিদের সোপানে বসানো হয়, যাতে বিশ্বাসীগণ ঐ মূর্তি পা দিয়ে মাড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে পারে।

 

 

গজনির সুলতান মাহমুদের মথুরা আক্রমণ 

মথুরা, হিন্দুদের ভগবান কৃষ্ণের জন্মস্থান। তাই হিন্দুদের অন‍্যতম একটি পুণ্য তীর্থক্ষেত্র।
বৈরাগী, সাধু-সন্ন্যাসীর বাস ও পুণ্যার্থী ভক্তদের সমাগম।

মথুরাকে বলা যায় প্রাসাদ নগরী, বিস্ময়কর অনবদ্য তার স্থাপত্য।
বিনা বাধায় গজনির সুলতান মাহমুদ মথুরা আক্রমণ করলেন। কে তাঁকে বাধা দেবে?

রেফারেন্সঃ
1. Thid, P-57

2. Khwajah Nizamuddin Ahmad-The Tabaqat-l-Akbari. Vol-I, P-7

মথুরা দেখে গজনির সুলতান মাহমুদ মুগ্ধ বিস্মিত হলেন।
তিনি হিসাব করে বললেন, এরকম একটি সুন্দর নগর তৈরি করতে ২০০ বছরের পরিশ্রম ও ১০ কোটি দিনার (আরবীয় মুদ্রা) প্রয়োজন হবে।

বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতেই মথুরাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন।

মথুরার বিস্ময়কর স্থাপত্যশৈলী যে সুলতান মাহমুদকে মুগ্ধ করেছিল, পণ্ডিত নেহেরু তাঁর Glimpses Of World History গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

গজনির সুলতান মাহমুদ গজনীতে তাঁর প্রতিনিধিকে লিখছেন,
এখানে আছে এক সহস্র দেবতার মূর্তি। যা বিশ্বাসীদের ধর্মের মতই অটল, মজবুত ও সুদৃঢ়।

কোটি কোটি দিনার ব্যায় করে নগরীর এমন বিকাশ সম্ভব হয়েছে এবং ২০০ বছরেও এমন আর একটি নগর নির্মাণ করা সম্ভব নয়।

কিন্তু গজনির সুলতান মাহমুদ যে এমন সুন্দর নগরটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছেন, পণ্ডিত নেহেরু সেই ইতিহাস সযত্নে পরিহার করেছেন।

খাজা নিজামুদ্দিনের বিবরণ অনুযায়ী, সুলতান তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে বিনা বাধায় মথুরা প্রবেশ করেন।

তাঁর নির্দেশে সকল মন্দির ভস্মীভূত হয়, ধ্বংস হয় বিশাল বিশাল অট্রালিকা; লুণ্ঠনের মাধ্যমে সংগ্রহ হয় অপর্যাপ্ত রত্নভাণ্ডার।

মথুরায় নিখাদ সোনার একটি বড় প্রতিমা ছিল, যাঁর ওজন ৯৮৩০০ মিসকাল।
সুলতানের আদেশে প্রতিমাকে ভাঙা হয়।

একটি বহু মূল্যবান রত্ন ছিল, যার ওজন ৪৫০ মিসকাল, সেটা সুলতানের রত্নভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে।

উল্লেখ্য, এক মিসকাল এক সেরের ভাগ 600, আর মহার্ঘ রত্নটি পদ্মরাগ / নীলকান্ত মণি

রেফারেন্সঃ
I. Will Durant –The Story of Civilization,
P-460 2. Pt. Nehru Glimpses of World History, P-155-156

গজনির সুলতান মাহমুদের সোমনাথ মন্দির আক্রমণ :

সোমনাথ মন্দিরের ধ্বংসের ছবি
সোমনাথ মন্দিরের ধ্বংসের ছবি

তখনকার সময় যেমন মন্দিরে সম্পদ ছিল, তেমনি বড় কয়েকটি মসজিদেও ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ।

কিন্তু শুধু গজনির সুলতান মাহমুদ কেন, কোনো মুসলমান আক্রমণকারী কখনও কোনো মসজিদ আক্রমণ করেনি।
তাই, স্বাভাবিক ভাবেই এটা পরিষ্কার যে, লুটেরাদের লক্ষ ছিল বিধর্মীদের সম্পদ ও স্থাপত্য!

বিশিষ্ট ঐতিহাসিক Lane Poole বলেন, ‘মামুদের প্রতিজ্ঞা ছিল প্রতিবছর তিনি হিন্দুস্থানের কাফেরদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করবেন।

যতদিন পর্যন্ত সোমনাথ মন্দির অক্ষত থাকবে ততদিন পযর্ন্ত তিনি মূর্তিভাঙার অভিযান থেকে বিরত হবেন না।

মুলতান থেকে মাহমুদ বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সোমনাথের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন।

যতটুকু জানা যায়, ঐসময় মন্দিরে ছিল এক হাজার ব্রাহ্মণ, শত শত নর্তকী ও গায়িকা।
অর্ধ লক্ষাধিক নরী পুরুষ আশ্রয় নিয়েছিল মন্দির চত্বরে।

আশা ছিল দেবতার অলৌকিক শক্তি তাদের রক্ষা করবে।
কিন্তু ভক্তদের কল্পজগৎ বার্তীত অলৌকিক লীলা কদাচিৎ ঘটে।

গর্ভগৃহের মাঝখানে ছিল মণি-মাণিক্য খচিত কষ্টিপাথরে নির্মিত বিশাল শিবলিঙ্গ।

চারিদিকে অতি সুন্দর কারুকার্য করা নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল বিচিত্র বিবিধ রত্নখচিত ঝুলন্ত দীপাধার।

সেই রত্নদীপের বর্ণময় বিচ্ছুরিত দীপ্তিতে আলোকিত হত বিগ্রহ।
আল্লাহ্ হো আকবর ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে আসে ইসলামের ধর্মযোদ্ধারা।

গজনির সুলতান মাহমুদ এর আক্রমণ

 

শোনা যায় তাঁদের রণহুঙ্কার। ভয়ার্ত অসহায় নরনারীর আকুল আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয় দিক হতে দিগন্তরে।
পৈশাচিক উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ে গজনির সুলতান মাহমুদ এর সৈন্যদল।

সুন্দর মন্দির প্রাঙ্গণ মুহুর্তেই রক্তস্নাত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। লুণ্ঠিত হয় সোমনাথ মন্দিরের অতুল ঐশ্বর্য, ধ্বংস হয় সোমনাথ মন্দির।

নিহত হয় কমপক্ষে ৫০০০০ হিন্দু। খাজা নিজামুদ্দিনের বর্ণনায়, দুর্গ জয় করে মূর্তিটিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয়।

বিগ্রহের ভাঙা অংশগুলি ও মন্দিরের বিশাল ফটক গজনীতে মাহমুদের প্রাসাদে বসানো হয় শোভা বর্ধনের জন্য।

মূর্তির ভাঙা একটি টুকরো গজনীতে জামা মসজিদের দরজায় সিড়ি হিসাবে স্থাপন করা হয়।

খাজা নিজামুদ্দিন আহম্মদের বিবরণ থেকে আরও জানা যায়, মন্দিরে অনেক স্বর্ণের তৈরি বিগ্রহ ছিল।

তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিগ্রহের নাম ছিল মানত। মন্দির থেকে এই বিগ্রহ এনে কাবায় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

রেফারেন্সঃ
1. Khwajah Nizamuddin Ahmed – Tabaqat- 1 – Akbari, Vol I, P-11

2. Dr. Titus-Indian Islam. P-22-23 Quoted from Dr.B.R. Ambedkar-Writings and Speeches. Vol-8, P-58

ঐতিহাসিক Minhaj as-Siraj লিখেছেন, এক হাজার মন্দির ভেঙ্গে গজনির সুলতান মাহমুদ ইসলামিক জগতে বিখ্যাত হয়েছিলেন।

সোমনাথ মন্দিরের প্রতিমা ধ্বংস
সোমনাথ মন্দিরের প্রতিমা ধ্বংস

 

তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ছিল সোমনাথ মন্দির ধ্বংস। সোমনাথের প্রতিমা নিয়ে যান গজনীতে।

প্রতিমাকে ভেঙে চার টুকরো করা হয়। এক ভাগ শোভা পায় গজনীর জামা মসজিদে আর এক ভাগ রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকে।

অবশিষ্ট দুই ভাগ পাঠিয়ে দেওয়া হয় মক্কা ও মদিনায়।
ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের পূর্বে মক্কাবাসীরা যে সকল দেবতার পূজা করত, তাঁদের মধ্যে অন‍্যতম প্রধান ছিল ‘মানত’।

রেফারেন্সঃ
1. Quoted from Dr. B. R. Ambedkar-Writings and Speeches, Vol-8, P-58 2.
Khwajah Nizamuddin Ahmed-The Tabaqat-l-Akbari, Vol-8, P-15
3. Ibid, P-15

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের (AMU) অধ্যাপক প্রয়াত মহম্মদ হাবিব
(ইরফান হাবিবের পিতা) Sultan Mahmud of Ghazni বইতে ভারতবর্ষে গজনির সুলতান মাহমুদের জেহাদের বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।

তাঁর মতে ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় না, বিপুল পরিমাণ সম্পদের লোভেই মাহমুদ সোমনাথ মন্দির ও ভারতবর্ষ আক্রমণ করতেন।

গজনির সুলতান মাহমুদের বিজয় বার্তা পেয়ে বাগদাদের তৎকালীন খলিফা বিশাল উৎসবের আয়োজন করেন।
সেখানে মাহমুদের প্রশংসা করা হয়।

তাঁকে তখন তুলনা করা হয় পয়গম্বরের ঘনিষ্ঠ সহচর বীর মুসলিম যোদ্ধাদের সঙ্গে!
যাঁদের কাছে পরাজিত হয়েছে আরবিয়া, সিরিয়া, ইরান ও ইরাক।

মোহাম্মদ হাবিবের বর্ণনা অনুযায়ী, গজনির সুলতান মাহমুদ তৎকালীন ভারতবর্ষের “বেথেলহেম” প্রাসাদনগরী মথুরার বিস্ময়কর স্থাপত্যে মুগ্ধ হয়েও প্রায় ১০০০ মন্দির ধ্বংস করেন।

রেফারেন্সঃ
1. Pt. Nehru – Glimpses of World History, P-154 155
2. Arun Shourie and others – Hindu Temples What Happened to Them, P-20.

ঐতিহাসিক নেহেরু বলেছেন, মন্দিরের প্রতিমা ভেঙে গজনীর,
মক্কা ও মদিনার মসজিদের সিড়িতে বসানোর উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দুদের ধর্মবোধকে চূড়ান্ত অপমান করা।

মুসলিম ঐতিহাসিক সুপণ্ডিত আলবেরুনী গজনির সুলতান মাহমুদের সমসাময়িক।
মাহমুদের অত্যাচার সম্পর্কে তিনি বলেন,
হিন্দুদের যেন ধূলিকণার মত, পুরাতন জনশ্রুতির মতো চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল,
তাঁদের বিক্ষিপ্ত অবশেষ মুসলমানদের উপর গভীর ঘৃণা পোষণ করে।

রেফারেন্সঃ
1. Pt. Nehru Glimpses of World History, P-155

2. পণ্ডিত নেহেরু ভারত সন্ধানে, পৃঃ ১৯৮।

গজনির সুলতান মাহমুদ ১০১৭ খ্রিষ্টাব্দে কনৌজ আক্রমণ করে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও যুদ্ধ বন্দী গজনীতে নিয়ে গিয়েছিলেন,  তা গুণে শেষ করা যায়নি!

মধ্যযুগীয় যুগে হিন্দুদের পরাজয়ে প্রাণীদের ভূমিকা! 

এই সকল বন্দীদের দাস বাজারে (Slave market) বিক্রি করা হত।
কিন্তু তাঁদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, ক্রেতার অভাব দেখা দেয়।
তখন তাঁদের নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা হত।

সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণী উল্লেখ করে Dr. Titus বলেছেন, যুদ্ধ বন্দীদের বিক্রি করা হত ২-১০ দিনারে।
এর থেকেই যুদ্ধ বন্দীর সংখ্যা সম্পর্কে একটা ধারণা করা সম্ভব।

এই বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হত গজনীতে! তাদের কেনার জন্য দূরদেশ থেকে আসত বণিকের দল।

সাহিবে কমলের লেখক দৌলত রায়ের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, গজনির সুলতান মাহমুদ লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করে।

আরও লক্ষ লক্ষ হিন্দু দাস-দাসী করে গজনীর বাজারে বিক্রি করে মাথা পিছু মাত্র ২ দিনার মূল্যে!

Dr. Titus এর মতে, শুধু হত‍্যা ও মন্দির ধ্বংস নয়, পরাজিতদের জন্য ছিল কঠিনতম শাস্তি দাসত্ব!

ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে জেহাদে আকৃষ্ট করার জন্য সেনাপতি ও সাধারণ সৈন্যদের মধ‍্যে লুণ্ঠনের ভাগ দেওয়া হত।

প্রথমবার ভারত আক্রমণেই গজনির সুলতান মাহমু ৫০,০০০ হিন্দুকে বন্দী করে গজনীতে নিয়ে যান।

প্রতিবার অভিযানের পূর্বে মাহমুদ নতজানু হয়ে আল্লাহর দোয়া প্রার্থনা করতেন।

রেফারেন্সঃ
1. Dr. Titus Indian Islam, P 24 Quoted from Dr. B. R. Ambedkar-Writings and Speeches Vo.-8, P-61

ভারতে গজনির সুলতান মাহমুদের শেষ অভিযান ছিল জাঠদের বিরুদ্ধে।
সোমনাথ থেকে ফেরার পথে গজনির সুলতান মাহমুদ জানতে পারেন জাঠ সম্প্রদায় সম্পর্কে।

তখন জাঠ সম্প্রদায় ইসলামের নাম পর্যন্ত জানত না, তাই মাহমুদ সিদ্ধান্ত নেন জাঠদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার।

জাঠদের বিরুদ্ধেও চরম নির্মমতার পরিচয় দেন।
অবশেষে কুখ্যাত এই নির্মম শাষক ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু বরণ করে।

আরবের মরু সমাজ থেকে দস‍্যু হয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণকারী দের মধ‍্যে গজনির সুলতান মামুদ ইসলামের প্রচার নয়, লুন্ঠনে মত্ত ছিলেন, এজন্যই সচেতনদের মধ‍্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া!

নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, নির্বিচারে ব্যাপক হিন্দু হত্যা, নারী ও শিশুদের ক্রীতদাসে রুপান্তর,
হিন্দু স্থাপত্য ধ্বংস ও ইসলামে ধর্মান্তর করে ভারতবর্ষের ইতিহাসে একজন ঘৃণ্য শোষক হিসাবে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন!