এই উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রাচীন, কালজয়ী, অমর কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অন্যতম প্রধান। কৌটিল্য কে ছিলেন এবং এই মহান গ্রন্থ নিয়েই আজকের আর্টিকেল।
পৃথিবীর অন্যতম সেরা দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও জ্ঞানবান এই পন্ডিত কৌটিল্যের রচিত মহান গ্রন্থ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির পথ বদলে দিয়েছে!
কৌটিল্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
কৌটিল্যের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না, কারণ এই ইতিহাস প্রায় ২৩০০ বছর পূর্বের এবং ধারণা করা হয় বিশুদ্ধভাবে এই ইতিহাস কিছুটা লিখিত থাকলেও আব্রাহামিক আগ্রাসনে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাছাড়াও প্রায় প্রতিটি বিষয়ে ইতিহাসবিদগণের মধ্যে মতপার্থক্য এবং বিতর্ক রয়েছে। তারপরও এখানে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত তথ্যগুলো সংগ্রহ করে পাঠকদের জন্য এই আর্টিকেলে তুলে ধরা হয়েছে।
ধারণা করা হয়, দার্শনিক প্রজ্ঞা এবং অসাধারণ কূটনৈতিক পরিকল্পনায় সিদ্ধহস্ত রাজ উপদেষ্টা, অসাধারণ প্রতিভাবান কৌটিল্যের জন্ম ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন ভারতবর্ষের গোল্লা এলাকার চানাকা নামের একটি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল চানিন এবং মাতার নাম ছিল চানেশ্বরী। তিনি আচার্য চাণক্য, চাণক্যনীতির রচয়িতা হিসাবে এই উপমহাদেশে বিখ্যাত হয়ে আছেন।
যতটুকু জানা যায়, কৌটিল্যের পিতা একজন মুনি ও মাতা ব্রাহ্মণ ছিলেন। এজন্য কৌটিল্য জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ বংশগত ছিলেন। তাঁর জন্মস্থান নিয়ে ইতিহাস বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকের মতে, তাঁর জন্মস্থান ছিল পাটলিপুত্রের কুসুমপুরে।
বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস থেকে জানা যায়, কৌটিল্য মগধের মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পিডিএফ পড়তে এখানে ক্লিক করুন!
কৌটিল্যের কূটনীতি
মৌর্য রাজবংশের প্রথম রাজা চন্দ্রগুপ্ত মগদ রাজ্যের রাজক্ষমতা অর্জন ও শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পেছনে কৌটিল্যের ভূমিকা অপরিসীম ও অবদান অনস্বীকার্য। চাণক্য নীতি ও পরামর্শের গুণে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিলেন। ভারতীয় ইতিহাসে বিখ্যাত বিন্দুসার এই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যেরই দ্বিতীয় পুরুষ এবং তৃতীয় প্রজন্ম ছিলেন সম্রাট অশোক। যিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান অর্জন করেছেন।
মগধ রাজ্যের পতন এবং মৌর্য্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করেছিলেন।
পরাক্রমশালী নন্দ রাজবংশকে সিংহাসনচ্যুত করে পাটালিপুত্রে মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা ও ভারতবর্ষে শক্তিশালী সাম্রাজ্য তৈরী করতে তাঁর অবদান অপরিসীম। এজন্য রাজা চন্দ্রগুপ্তের রাজ সভায় প্রধান পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মূলত কোন বিষয়ক গ্রন্থ?
আচার্য চাণক্য তথা কৌটিল্যের রচিত ‘কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থ রচিত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি যদিও নামে অর্থশাস্ত্র কিন্তু এটি মূলত শাসকের রাজ্যশাসন ও কূটনীতিবিষয়ক বিশেষ কৌশলের বহু পরামর্শের ভান্ডার। অত্যন্ত চমৎকারভাবে তিনি এই গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, একটি রাষ্ট্র কীভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে গড়ে ওঠে এবং পূর্ণতা লাভ করে। তি
নি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন, কীভাবে একজন রাজাকে নিজ রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে প্রতিবেশী ভূখণ্ড ও মূল্যবান সম্পদ নিজের রাজ্যের অধীনস্থ করতে হয়। সেইসঙ্গে সম্পদ ও সাম্রাজ্য বর্ধনের মাধ্যমে নিজ প্রজাদের নিরাপত্তা, উন্নতি ও নাগরিক জীবন উন্নত করতে করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব
মূলত কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি হলো কৌটিল্য অথবা চাণক্যের রচিত সনাতনী রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্যের একটি প্রাচীনতম গ্রন্থ। ‘অর্থ’ শব্দটি আমাদের মাঝে পরিচিত সাধারণত টাকা, সম্পদ হিসাবে। অপরদিকে ‘শাস্ত্র’ শব্দের অর্থ বিদ্যা অথবা জ্ঞান। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে অর্থশাস্ত্র গ্রন্থের অর্থ সম্পদের শাস্ত্র অথবা জ্ঞান।
কিন্তু কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে গ্রন্থে শুধু সম্পদ সম্পর্কে আলোচনা লিপিবদ্ধ না করে একটি রাষ্ট্রের সব বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন, যেগুলো অনুসরণ করলে একটি রাষ্ট্র সবদিকেই শক্তিশালী হবে। বিখ্যাত এই ঐতিহাসিক ও দার্শনিক চাণক্য তথা কৌটিল্যের রচিত এই কালজয়ী গ্রন্থ অর্থশাস্ত্রের রচনার সময় অর্থাৎ গ্রন্থটির রচনাকাল সম্পর্কে বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে।
১. কালজয়ী বিখ্যাত গ্রন্থ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র শুধু অর্থ সম্পদের বিষয়ে সম্পর্কিত নয়, এই মহামূল্যবান গ্রন্থে রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, দণ্ডনীতি, আইন, প্রশাসন, সামাজিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ইত্যাদি সকল বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
২. এই অমূল্য গ্রন্থের রচয়িতা অস্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা ও দণ্ডনীতি এই চার প্রকার বিদ্যায় তাঁর বিশেষ জ্ঞান ও প্রতিভার দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
৩. এই গ্রন্থে তিনি অংক শাস্ত্র, বাস্তু বিদ্যা, ধাতু বিদ্যা, রসায়ন শাস্ত্র, উদ্ভিদ বিদ্যা, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর অসীম জ্ঞান ও বিশাল প্রতিভার অসামান্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
কৌটিল্যের লেখা গ্রন্থের নাম কি?
হাজার বছর অতিক্রম হলেও, আজও কৌটিল্যের লেখা গ্রন্থ কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব আজও অপরিসীম। এই গ্রন্থ নিয়ে অনেক কৌতূহল ও আলোচনা বিদ্যমান এবং ভবিষ্যতেও এই অমূল্য গ্রন্থের ব্যাপক চাহিদা থাকবে। এই গ্রন্থকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বকোষ বললেও হয়তো অনেক কম বলা হবে।
কৌটিল্যের এই অর্থশ্রাস্ত্র গ্রন্থে দর্শনশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি, বাজেট ব্যবস্থা, আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সরকার পরিচালনার নীতি, বাজার ব্যবস্থা, বাণিজ্য, যুদ্ধনীতি, খনিজ সম্পদের ব্যবহার, পরিবেশ প্রকৃতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, কৃষি ব্যাবস্থা সহ রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনীয় সব বিষয় এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তাঁর গবেষণালব্ধ শ্লোক গুলো তিনি অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন, কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র নামে যে গ্রন্থ আমাদের মাঝে পরিচিত। তাঁর অসীম জ্ঞান ও গবেষণা থেকে এই সমস্ত নীতি গুলো প্রবর্তিত হয়েছে, এবং এই শ্লোক গুলো সম্পূর্ণরূপে বাস্তব বিন্দুমাত্র আবেগতাড়িত নয়। রাষ্ট্রের শাসক ও প্রশাসনের দিক নির্দেশক গ্রন্থ এটি। আজও ভারতবর্ষ কূটনীতির দিকে এই গ্রন্থকে প্রথমে রাখে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পিডিএফ পড়তে এখানে ক্লিক করুন!
কৌটিল্য কে ছিলেন?
অর্থশাস্ত্র গ্রন্থের শ্লোকে কৌটিল্য এবং একটি শ্লোকে বিষ্ণুগুপ্ত নাম আছে। বেশিরভাগ ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে কৌটিল্য এবং বিষ্ণুগুপ্ত আচার্য চাণক্যের ছদ্মনাম ছিল। ঐতিহাসিকগণের ধারণা, এই নামগুলোর মধ্যে কৌটিল্য তাঁর গোত্রের নাম ছিল। মূলত ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থের জন্যই তাঁর এই কৌটিল্য নামটি ব্যাপক প্রচারিত হয়ে আসছে।
আবার সেই গ্রন্থের এক জায়গায় লেখককে বিষ্ণুগুপ্ত নামে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়াও বিষ্ণুগুপ্ত যে চাণক্যের নাম ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় অব্দের বিষ্ণু শর্মা নামক এক পন্ডিতের ‘পঞ্চতন্ত্র’ নামের সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি লেখায়। খুব কমসংখ্যক ইতিহাসবিদই মনে করেন যে চাণক্য এবং কৌটিল্য আলাদা ব্যক্তি। আবার কেউ কেউ মত প্রকাশ করেন, চাণক্য ও কৌটিল্য একই ব্যক্তি হলেও অর্থশ্রাস্ত্র গ্রন্থের সম্পাদক বিষ্ণুগুপ্ত আলাদা ব্যাক্তি।
কৌটিল্যের অপর নাম কি?
বেশিরভাগ ইতিহাস বিশ্লেষক ও পন্ডিতদের মতে, চাণ্যকের ছদ্মনাম ছিলো কৌটিল্য ও বিষ্ণুগুপ্ত। আবার কিছু ঐতিহাসিকের মতে, বিষ্ণুগুপ্ত নাম তাঁর পিতা দিয়েছিলেন।
গবেষক থমাস ট্রটম্যান (Thomas R. Trautman) এর মতে, বিখ্যাত “অর্থশাস্ত্র” গ্রন্থের সম্পাদক বিষ্ণুগুপ্ত এবং চাণক্য তাঁর গোত্রনাম ছিলো। আবার বিষ্ণুশর্মার রচিত “পঞ্চতন্ত্র” অনুযায়ী চাণক্য ও বিষ্ণুগুপ্ত এই দুইটি নাম একই ব্যক্তির।
অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তার ব্যাখ্যা
১. রাজতন্ত্র
ধর্মনিরপেক্ষ – প্রশাসনিক তত্ত্ব: অর্থশাস্ত্র গ্রন্থ হলো ধর্মনিরপেক্ষ, প্রশাসনিক তত্ত্ব। ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসন পরিচালনার বিষয়ে শিক্ষা দেয় অর্থশাস্ত্র। কৌটিল্য রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনার কথা উল্লেখ করেছেন।
রাজার ক্ষমতা: অর্থশাস্ত্র। গ্রন্থ অনুযায়ী রাজ্যের রাজা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গ এবং এই পার্থিব জগতে চূড়ান্ত সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। তার কর্তৃত্বকে অবহেলা অথবা অমান্য করার সাধ্য কারও নেই। যদিও রাজার ক্ষমতার বিষয়ে কিছু নিয়ন্ত্রণ আরােপের কথাও অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে।
কারণ, রাজা রাষ্ট্র নয়, তিনি রাষ্ট্রের একটি অংশ মাত্র। একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বহু ব্যাক্তিদের সহায়তা রাজার প্রয়ােজন হয়। এদের মধ্যে মন্ত্রীগণ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কৌটিল্য তাঁর রচিত এই গ্রন্থে তিন ধরণের রাজস্ব আয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো—সীতা, ভাগ এবং বলি।
রাজ্যের শাসনকার্যে পুরােহিতদের গুরুত্বহীনতা: ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে পুরােহিতের আধিপত্য থাকলেও, রাজ্যে রাজার ক্ষমতাকে কোনভাবেই পুরােহিত প্রভাবিত করতে পারেন না। যদি কোনো পুরােহিত শাস্তিযােগ্য অপরাধ অথবা এমন কোনো কর্মকাণ্ড করে, তাঁর জন্য কৌটিল্য বিনা সংকোচে চরম শাস্তির দেওয়ার কথা বলেছেন।
২. রাষ্ট্রনীতি
রাষ্ট্রদর্শন
শাসকের নীতি: কৌটিল্য উল্লেখ করেছেন, রাজ্যের শাষক অথবা রাজাকে কুটনীতি পরায়ণ হতে হবে এবং রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় শুধুমাত্র রাজা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। রাজাই রাজ্য, রাজা যদি দুর্বল হয় তাহলে রাজ্য অবশ্যই দুর্বল হবে।
রাজার কর্তব্য: কৌটিল্যের রচিত তাঁর অর্থশ্রাস্ত্র গ্রন্থে রাজাকে কঠোর পরিশ্রম করতে বলেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, রাজার সর্বময় ক্ষমতা থাকা সত্বেও তিনি যেন কখনও স্বেচ্ছাচারী না হয়।
নৈতিকতায় গুরুত্বহীনতা: কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যেকোনাে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তাঁর মতে, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে তখন একমাত্র যুদ্ধই শ্রেয়। রাষ্ট্রের নীতিতে নৈতিকতার বিন্দুমাত্র স্থান থাকা উচিত নয় বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।
মণ্ডলতত্ত্ব: কৌটিল্যের মতে, রাজ্যের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশ স্বাভাবিকভাবেই শত্রু রাজ্য এবং ঐ দেশের পরবর্তী রাজ্য স্বাভাবিকভাবেই মিত্র দেশ। এইভাবে দেশের শত্রুদেশ ও মিত্রদেশ নির্ণয় করতে হবে। তাঁর এই তত্ত্বকে ‘মণ্ডলতত্ত্ব’ বলা হয়।
প্রজাকল্যাণ: রাজার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রজাদের অর্থাৎ দেশের জনসাধারণের মঙ্গলময় কাজ করা। কৌটিল্যের মত অনুযায়ী, রাষ্ট্রপ্রধান প্রধানত দুইটি উপায়ে দেশের জনসাধারণের কল্যাণের জন্য দায়িত্ব পালন করতে পারে। যথা-
দুর্গত নাগরিকদের কল্যাণ: প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা দুর্ভিক্ষের সময় নাগরিকদের সহায়তা দেওয়া, কৃষকদের শষ্য বীজ প্রদান করা, মহামারি প্রতিরােধে কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহণ করা, দুর্দশাগ্রস্ত, পীড়িত, অসহায়, বৃদ্ধ ও বিধবাদের ভরণ পােষণের মাধ্যমে দুর্গত নাগরিকদের কল্যাণ করার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন।
সর্ব জনসাধারণের কল্যাণ: রাজ্যের সব জনগণের কল্যাণের প্রয়োজনে রাষ্ট্র বেশকিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করবে, যেমন- অসাধু ব্যবসায়ী, অপরাধীদের সাজা দিয়ে সাধারণ জনগণকে রক্ষা করা, সামাজিক ও জনকল্যাণ কাজে সবাইকে উৎসাহিত করা ইত্যাদি।
দুর্গ ও নগর তৈরী: বিদেশী শত্রুদের আক্রমণ থেকে প্রতিরােধ ও দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বজায় রাখতে রাজ্যের রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে ও বিভিন্ন স্থানে দুর্গ ও নগর নির্মাণের জন্য রাষ্ট্রের এই বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করার বিষয়ে কৌটিল্য মত প্রকাশ করেছেন।
কৌটিল্য তাঁর অর্থশ্রাস্ত্র গ্রন্থে চার প্রকার দুর্গের কথা বলেছেন। যথা- পার্বত্যদুর্গ, অরণ্যদুর্গ, জলদুর্গ ও মরুদুর্গ।
জলদুর্গ
চারপাশে জলবেষ্টিত এলাকা নিয়ে তৈরী করা দুর্গকে জলদুর্গ বলা হয়।
পার্বত্য দুর্গ
চারপাশে পাহাড় দিয়ে আবৃত অথবা পাহাড়ের মধ্যে তৈরি করা দূর্গকে পার্বত্য দুর্গ বলা হয়।
মরুদুর্গ
মরুভূমির সীমান্তে অথবা মরু প্রান্তর সংলগ্ন অঞ্চলে তৈরী করা দুর্গগুলোকে দুর্গ বলা হয়।
বনদুর্গ
বনাঞ্চলে অথবা অরণ্যের মাঝে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে তৈরী করা দুর্গকে বনদুর্গ বলা হয়।
এসব দুর্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ সম্পদ, খাদ্যশস্য, ঔষধ, সেনাবাহিনী, যুদ্ধের প্রয়োজনীয় অস্ত্র, হাতি ও ঘােড়া রাখতে বলেছেন এবং আহত সেনাদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে বলেছেন।
নগর
রাজ্যের নগরগুলো বড় বাজার এবং নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ভূমিকা পালন করবে এবং এসব নগর থেকে রাষ্ট্র যথেষ্ট পরিমাণে রাজস্ব আয় করতে পারবে।
রাজকোশ
কৌটিল্যের মত অনুযায়ী রাজ্য অথবা রাষ্ট্রের শক্তি রাজকোশের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের শক্তি রাজা অথবা শাষকের আর্থিক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।
লেখক এখানে কোশ বলতে অর্থভাণ্ডার হিসাবে বুঝিয়েছেন। একজন রাজা রাজস্ব সংগ্রহ অথবা অন্য যেকোনো সৎ ভাবে রাজকোশ বর্ধিত করবেন।
রাজার অর্থ সংগ্রহের কয়েকটি উৎস-
প্রজাদের থেকে ভূমিরাজস্ব সংগ্রহ, কৃষকদের থেকে প্রাপ্ত শস্যকর, সেচকর, ব্যাবসায়ীদের থেকে সংগৃহীত পণ্যকর ইত্যাদি।
মিত্র
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে রচিত মিত্র শব্দের অর্থ অথবা সুহৃদ। লেখকের মতে, যার নিকট থেকে কোনরকম বিপদের কোনো সম্ভাবনা থাকে না তিনিই মিত্র। কৌটিল্য এই গ্রন্থে দুই প্রকার মিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। তারমধ্যে এক প্রকার মিত্র- অর্জিত মিত্র। এই মিত্রদের মিত্রতা ধন সম্পদ, স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পিডিএফ পড়তে এখানে ক্লিক করুন!
কৌটিল্য রচিত তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থ অনুযায়ী একজন শাসকের কর্তব্য
* রাজা এবং রাজ্যের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো বিশ্বাসঘাতক কোনো ষড়যন্ত্র করছে নাকি, এই বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করতে হবে।
* শত্রুরাজ্যে গুপ্তচর নিয়োগ করে বিভেদ, বিশেষ কৌশলে শত্রুদের প্রলোভন দেখানো, অধীনস্থ অঞ্চলে শান্তিস্থাপন বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।
* রাজ্যের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে রাজ্যের শাষককে। তাঁর কর্মচারীদের এই বিষয়ে নির্দেশনা দিতে হবে। চাণক্য রচিত ভুবনবিখ্যাত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে একজন শাসকের দৈনন্দিন কাজের বিভিন্ন ভাগ এবং সময়কে নির্দিষ্ট করে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
* রাজ্য ও নিজের শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করতে শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য শাষককে প্রয়োজনে নিষ্ঠুর পথ অবলম্বন করতে হবে। এজন্য পরিস্থিতির প্রয়োজনে যে কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শাষককে দ্বিমত প্রকাশ করা যাবে না।
* প্রজাদের সুশাসন নিশ্চিত করা একজন শাষকের প্রধান লক্ষণ। প্রজাদের সুশাসন নিশ্চিত করতে শাষককে শপথ গ্রহণ করতে হবে।
অধ্যাপক ড. শ্যামশাস্ত্রী ১৯০৫ সালে ভারতের মহীশূর রাজ্য এই দুর্লভ অর্থশাস্ত্র গ্রন্থ উদ্ধার করে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র নামে প্রকাশিত করেছিলেন।
এন. সি. বন্দোপাধ্যায় এর মতে- “চাণ্যকের বিরোধীগণ রাজনীতিতে কিছু অমানবিক বিষয় সমর্থনের কারণে তাঁকে অভিযুক্ত করলেও, মূলত তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে উচ্চতর আদর্শ তৈরীর পরিকল্পনা করেছিলেন।
যুদ্ধ পরিচালনা ও রাজনীতিতে সাফল্য অর্জনের জন্য বেশকিছু বিষয়ে অমানবিক কৌশলের উল্লেখ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে, কিন্তু এসব বিষয় তাঁর নিজস্ব আবিষ্কার ছিল না বরং এসব ছিল তৎকালীন সময়ের যুদ্ধনীতি।”