ইতিহাস পড়ার পূর্বে আমাদের জানা প্রয়োজন ইতিহাস কী? ইতিহাস কেন পড়বো? ইতিহাসের জনক কে? তাই পাঠকদের জ্ঞানপিপাসা নিবারণে আজকের আর্টিকেলে আমরা এসব নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই বর্তমানে ইতিহাস নামে সন্মোধন করা হয়। ইতিহাস হলো অতীতের কাহিনী, ঘটনা, ফলাফল, গবেষণা ইত্যাদি। সমাজ ও দেশে নিরন্তর ভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রবাহকে ইতিহাস বলা যায়। এক কথায় বলা যায়, আজ যেটা অতীত আগামীদিনের জন্য সেটাই ইতিহাস।
ইতিহাস বড় একটি বিষয় হওয়ার পরেও, এটা কখনও সামাজিক বিজ্ঞান এবং কখনও মানবিক বিজ্ঞানের একটি শাখা হিসাবে প্রাধান্য পেয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ ইতিহাসকে মানবিক এবং সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যকার একটি সেতুবন্ধন হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এর গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হচ্ছে- ইতিহাস এই দুইটি মাধ্যম থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও বিভিন্ন উপাদান নেয়া হয়। একটি গ্রন্থ হিসাবে ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করার সময় বেশকিছু উপবিভাগের নাম চলে আসে। যেমন- বর্ষপঞ্জি, ইতিহাস-লিখন, কুলজি শাস্ত্র, পালিওগ্রাফি এবং ক্লায়োমেট্রিক্স।
ইতিহাস কি?
অতীতের কোনাে ঘটনার নিরন্তর সত্যানুসন্ধান বা গবেষণা হলাে ইতিহাস। ইতিহাস হচ্ছে মানবসভ্যতার অতীতের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলির বিবরণ। মানবজাতির অতীত কর্মকান্ডই মূলত এর বিষয়বস্তু।এই পৃথিবীর মানবজাতি এবং সভ্যতার বিবর্তনের সবচেয়ে নির্ভর দলিল হচ্ছে ইতিহাস এবং এই কারণে জ্ঞান অর্জনের শাখা হিসাবে ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মানবজাতির কর্মকান্ড, সমাজ এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কিত বিশ্লেষণাত্মক লিখিত বিবরণ হচ্ছে ইতিহাস। এই বিবরণে অতীতের মানবজাতির উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ডের ধারা এবং আচরণের সহজ ও সরলীকৃত ব্যাখ্যা দেওয়া থাকে।
স্মরণাতীত কাল থেকে মানুষের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড জুড়ে রয়েছে ইতিহাস। কিভাবে কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানবজাতি অতীত থেকে বর্তমানে উপনীত হয়েছে সেটাই হলো ইতিহাসের প্রধান জিজ্ঞাসা।একজন ঐতিহাসিক যেমন ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা বিশ্লেষণ করেন, তেমনিভাবে ঘটনার নেপথ্যে থাকা ঘটনা নিয়েও আলোচনা করেন।
ইতিহাসের এই বিচার বিশ্লেষণ মূলক আলোচনা থেকেই জানা যায়, মানুষ জন্মগত ও পরিবেশগত ভাবেই সংগ্রামী। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়েছে। এভাবেই মানবজাতি তাদের কর্মদক্ষতার গুণে নিজেদেরকে উন্নত সভ্যতার সৃষ্টিকারক হিসাবে প্রতিপন্ন করেছে।
ইতিহাস কাকে বলে?
ইতিহাস কি অথবা ইতিহাস কাকে বলে তা এক কথায় বলা খুব কঠিন। বিভিন্ন পণ্ডিতগণ এর ব্যাখ্যা বিভিন্নভাবে বলেছেন। তাঁদের মতামতের উপর ভিত্তি করে বলা যায়- “অতীত উপাদানসমূহ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে মানব সমাজের সমুদয় ঘটনার বিবরণকে ইতিহাস বলে।” আবার এটাও বলা যায়, ইতিহাস হলো মানব সমাজের জীবন বৃত্তান্তের দলিল, যেসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে তার স্মারক। যেমন- ধ্যান/ধারণা ও কর্মকান্ড নির্ধারণ করেছে এবং যে সকল বস্তুগত অবস্থা সে সকল সমাজের উন্নতির সহায়ক অথবা প্রতিবদ্ধক হিসেবে কাজ করছে তার সংকলন।
ইতিহাস শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ
ইতিহাস শব্দটি “ইতিহ” শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। ইতিহাস শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে হয়- ইতিহ + আস। এর অর্থ এইরকমই ছিল অথবা এমন ঘটেছিল। এখানে ‘ইতিহ’ শব্দের অর্থ ‘ঐতিহ্য’। অতীতের অভ্যাস, শিক্ষা, মানুষের দৈনন্দিন জীবন, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি যেগুলো ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত হয়ে থাকে তাকেই ঐতিহ্য বলে। সাধারণত ঐতিহ্য হলো অতীতের ঘটনা, অভ্যাস, শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি, যা ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত থাকে।
অপরদিকে, ইংরেজি ‘history’ শব্দের বাংলা অর্থ ইতিহাস। এই শব্দের উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘historia’ থেকে। সাধারণভাবে যার অর্থ, অতীতের কোন কিছুর অনুসন্ধান বা গবেষণা। মূলত, অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনাকে আমরা ইতিহাস বলি। যার অর্থ- সত্যানুসন্ধান অথবা গবেষণা। এই Historia শব্দ হেরােডােটাস সর্বপ্রথম ব্যাবহার করেছিলেন তাঁর গবেষণাকর্মের নামকরণে।
সুতরাং, ইতিহাস হলাে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিক বিবরণ যেটা, অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনার অন্তরালের পারিপার্শ্বিক অবস্থাও অন্তর্ভুক্ত করে। ইতিহাস নিয়ে যারা পড়াশোনা করে, তাদেরকে historian বলা হয়।
ইতিহাসের সংজ্ঞা
পূর্বেই বলেছি, এক কথায় ইতিহাসের সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন! বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ নিজেদের মতো করে ইতিহাস সম্পর্কে সংজ্ঞা দিয়েছেন। ইতিহাস কি, এই বিষয়ে কয়েকটি ঐতিহাসিক ও ইতিহাস বিশ্লেষকদের সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো-
ইতিহাস সম্পর্কে বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের সংজ্ঞা :
* গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস বলেছেন, ‘ইতিহাস হলো অতীতের ঘটনাবলি অনুসন্ধান করে তা লেখা’।
* আরেকজন গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের মতে- ‘অতীতের কাহিনী ও ঘটনা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করাকেই ইতিহাস বলে’। উল্লেখ্য, হেরোডোটাস ও থুসিডাইডিসের দেখানো পথেই খ্রিষ্টিয় অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাস রচনা হয়েছিল। পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ইতিহাসের সংজ্ঞা আবার নতুন করে তৈরি হয়েছিল।
তখনকার সময়ের বেশিরভাগ ঐতিহাসিকগণ একমত পোষণ করেন- বিজ্ঞানেরই একটি শাখা ইতিহাস। কারণ, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষাগারে প্রমাণ করতে হয়, তেমনি ইতিহাস রচনা করতেও প্রমাণের প্রয়োজন হয়। অতীতের বহু বিষয়বস্তু পরীক্ষা করে ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।
* ১৯ শতকে জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ফন র্যাংকে বলেছেন, “প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল তার অনুসন্ধান ও বিবরণই ইতিহাস”। তিনি আরও বলেছেন, কোনরকম ধারণা অথবা মতামত নয়, একজন ঐতিহাসিকের দায়িত্ব, অতীতের ঘটনা হুবহু পরিপূর্ণরুপে প্রকাশ করা। তাঁর এই ধারণা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এইভাবে পুরনো ইতিহাস পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ সহকারে নতুনরুপে লিখিত হতে থাকে। কিন্তু ইংরেজ ঐতিহাসিক হেনরি টমাস বাকল, রাঙ্কের ইতিহাস রচনার এই মতবাদে দ্বিমত প্রকাশ করেন। তিনি ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নতুন সংজ্ঞায় ইংল্যাণ্ডের সভ্যতার ইতিহাস রচনা করেন। তিনি বিজ্ঞানসম্মত মতে ইতিহাস রচনা পক্ষে থাকলেও, রাঙ্কের চেয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন।
* হেনরি টমাস বাকল এর মতে, অতীতের ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করলেই ইতিহাস হিসাবে বলা যায় না। এসব ঘটনা পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণের আলোকে বিচার/বিশ্লেষণের পথ গিয়ে যাচাই করে নিতে হয়।
* ইতিহাস প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ই. জে. র্যাপসন (Edward James Rapson) বলেছেন, ‘বিজ্ঞানসম্মতভাবে অতীতের ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ উপস্থাপন করাকে ইতিহাস বলে’।
* এই মতবাদ আরও পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেন, ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার হিল। তাঁর মতে, ‘মানব সমাজের অতীতের ঘটনার প্রাচীন দলিলপত্র পরীক্ষা করে প্রকৃত তথ্য লিপিবদ্ধ করাই হলো ইতিহাস’।
* বিখ্যাত ঐতিহাসিক ই এইচ কার (Edward Hallett Carr ), তাঁর রচিত ‘What is History’ গ্রন্থে বলেছেন, “মূলত সভ্যতার সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু করে মানুষ এবং তাঁর যাবতীয় চিন্তা, কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য হচ্ছে ইতিহাস।” তিনি আরও বলেছেন, “ইতিহাস হলো ঐতিহাসিক ও তথ্যের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এক অব্যাহত প্রক্রিয়া। অতীতের সাথে বর্তমানের যোগসূত্র তৈরি করার দক্ষতাকে ইতিহাস বলে”। তাঁর মতে- বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপকে ইতিহাস বলে।
* বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আর্নল্ড জোসেফ টয়েনবির মতে, ‘মানব সমাজের ঘটনা প্রবাহ কে ইতিহাস বলে’। তাঁর মতে, “সমাজের জীবনই ইতিহাস। ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার, আর্নল্ড টয়েনবির বক্তব্যে সহমত প্রদান করেছেন।
* ডঃ মজুমদারের মতে, ‘মানব সমাজের অতীত কার্যাবলীর বিবরণকে ইতিহাস বলে’।
*ডঃ জনসনের এর মতে, ‘ইতিহাস হলো ঘটে যাওয়া ঘটনা’। অর্থাৎ তাঁর মতে, যা কিছু ঘটে সেটাই ইতিহাস। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, “অতীতের কাহিনী মাত্রই ইতিহাস“।
* ঐতিহাসিক আর জি কলিংউডের এর মতে, “বৈরতত্ত্ব ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো ইতিহাসও এক প্রকার বিশেষ জ্ঞান।” তিনি আরাে বলেছেন, “ইতিহাস হচ্ছে সফল গবেষণালব্ধ অনুসন্ধান, যার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের অতীতের কর্মকাণ্ড।”
* ঐতিহাসিক স্যার জন সিলি বলেছেন, “কোনো দেশের ইতিহাস পাঠে সে দেশের অতীতকেই শুধু জানা যায় না, তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়।” এজন্য তিনি মত প্রকাশ করেন, ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করার জন্যই ইতিহাস পড়া বেশি প্রয়োজনীয়।
* G. J. Renier এর মতে, সভ্য সমাজে বসবাসকারী মানুষদের অভিজ্ঞতার কাহিনীই হলো ইতিহাস।
* ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার হিল বলেন, “প্রাচীন দলিলপত্র পরীক্ষা করে রচিত মানব সমাজের অতীত কাহিনিই হলো ইতিহাস।”
* আর. সি. মজুমদার বলেছেন, “ইতিহাস মানব সমাজের অতীত কার্যাবলির বিবরণ।”
* অক্সফোর্ড ইংরেজি ভাষার অভিধান অনুযায়ী, “ইতিহাস মানব জ্ঞানের ঐ শাখা, যেটা অতীত ঘটনাবলির বর্ণনা করে। ঐসব ঘটনাবলি লিখিত হয়ে থাকে অথবা অন্য কোনভাবে সত্য হিসেবে স্বীকৃত হয়। এটা অতীতের আনুষ্ঠানিক রেকর্ড, যা মানুষের কাজ ও বিষয়াবলির সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং কিভাবে বিভিন্ন দেশ ও জাতি গঠিত ও বিকশিত হয়েছে এসবের বিবরণ।”
যদিও ইতিহাস নিয়ে এত সহজে একটি নির্দিষ্ট বাক্যে সহমত প্রদান করা যায় না। তবে পণ্ডিতদের মতামত বিশ্লেষণ করে, একটি সাধারণ সংজ্ঞা তৈরি করা যায়। সংক্ষেপে সেটা হলো- ‘অতীতের উপাদানগুলো বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানব সমাজের সমুদয় ঘটনার বিবরণকে ইতিহাস বলে’।
ইতিহাসের জনক কে?
গ্রিকের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস ইতিহাসের জনক হিসাবে পরিচিত। গ্রিক ও পারসিকদের মধ্যকার সামরিক সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে রচিত গ্রন্থের নামকরণ করেছিলেন Historia. ৪৮৪ খ্রিস্টপূর্ব আধুনিক তুর্কিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার পিতা ছিলেন লেক্সেস এবং মাতা ছিলেন ডারউউটাম। বিভিন্ন সুত্র মতে, হেরোডোটাস প্রথম ব্যক্তি যিনি ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর নিয়ে একটি বিশেষ পদ্ধতির অনুসন্ধান করেন।
এই পদ্ধতিতে তিনি ঐতিহাসিক ধাতব ও প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করেন এবং ইতিহাস লিখনধারা অনুযায়ী সাজান। এজন্য তাকে ইতিহাসের জনক বলা হয়। উল্লেখ্য, রোমান ওরেটর সিসোরা হেরোডোটাসকে সর্বপ্রথম এই উপাধি প্রদান করেছিলেন। আরেকজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক থুসিডাইডিস, বিজ্ঞান সম্মতভাবে ইতিহাস রচনা করতেন। এজন্য থুসিডাইডিসকে বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের জনক বলা হয়।
থুসিডাইডিস ধারণা করতেন, অতীতের বর্ণনা থেকে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভিত্তি মজবুত করবে। এই বিষয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁর ইতিহাস ছিল উপদেশমূলক ও ছিল। এই কারণে অনেকেই থুসিডাইডিসকে উপদেশমূলক ইতিহাসের জনক হিসাবেও আখ্যা দিয়েছেন।
আধুনিক ইতিহাসের জনক কে?
আধুনিক ইতিহাসের জনক লিওপোল্ড ফন র্যাংক। তাকে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসের জনকও বলা হয়।
ইতিহাসের উৎস
ইতিহাস উৎসভিত্তিক। কোন অপ্রামাণিক বিষয় নিয়ে ইতিহাস রচিত হয় না। ইতিহাসে কোন অযৌক্তিকতা বা কুসংস্কারের স্থান নেই। ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সাধারণত ইতিহাসবিদগণ তিনটি উৎস গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন।
এগুলো হলো–
১. লিখিত
২. মৌখিক
৩. শারীরিক বা প্রত্যক্ষকরণ।
তবে সবার নিকট সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উৎস হিসেবে লিখিত উপাদান বেশি নির্ভরযোগ্য, যদিও শুধুমাত্র লিখিত উৎস থেকে ইতিহাসে সকল তথ্য উদ্ধার করা অসম্ভব।
ইতিহাস কেন পড়বো?
ইতিহাস পড়ার মাধ্যমে কোনো দেশের অতীতের ঘটনা সমসাময়িক প্রাকৃতিক অবস্থা এবং পরিবেশ, মানব সমাজের ক্রমবিকাশ, জাতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে বর্তমানে সঠিক পদক্ষেপ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়তা পাওয়া যায়।
যুগ-যুগান্তর ধরে প্রবাহমান মানব সভ্যতার চলমান জীবনধারাই ইতিহাস, আর এই জীবনধারার চক্রতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে আছে শত শত ভাঙা-গড়ার অর্ধলুপ্ত অবশেষ। আছে বহু রক্ত-রঞ্জিত দৃশ্যপটের পরিবর্তন। মানব সভ্যতার উত্থান-পতন ও সামাজিক বিবর্তন।
ইতিহাস কেন পড়বো অথবা ইতিহাসের গুরুত্ব কি? এই বিষয়ে বলতে গেলে এক কথায় বলা যায়- যে জাতি তাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস, তাদের সভ্যতার ইতিহাস জানে না, সেই জাতি কখনোই কাঙ্ক্ষিত সফলতায় পৌঁছতে পারেনা।
ইতিহাস পড়ার ফলে নিজের জ্ঞানকে অনেক ঋদ্ধ করে সমৃদ্ধ ভবিষ্যত তৈরী করা যায়। বর্তমানে আমরা এক ধরনের নিরন্তর অস্তিত্তের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ যুদ্ধে তিনিই বিজয়ী হবে, যার রয়েছে পর্যাপ্ত ইতিহাসের জ্ঞান।
ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা
ইতিহাস পাঠ মানুষকে অতীতের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অবস্থা বুঝতে, ভবিষ্যৎ অনুধাবন করতে সাহায্য করে। ইতিহাস পাঠের ফলে মানুষের পক্ষে নিজের ও নিজদেশ সম্পর্কে মঙ্গল-অমঙ্গলের পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব।
আরো পড়ুনঃ রাজা মিহির ভোজ
ইতিহাস পড়ার মাধ্যমে পৃথিবী ও মানবজাতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করা যায়। সুতরাং দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং ব্যক্তির প্রয়োজনে ইতিহাস পাঠ অত্যন্ত জরুরি।
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত এই উপমহাদেশের মানব সমাজ; বিচিত্র তাদের রীতি, নিয়ম, আচার/ব্যবহার, পোশাক এবং খাদ্য। এই বিভিন্নতার মাঝেও মনের ভেতর থেকে মানুষের মধ্যে একটি ঐক্যের বন্ধন রয়েছে।
ইতিহাস পাঠের কল্যাণে মানবের মধ্যে এই ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়, আর এভাবেই মানুষের মাঝে আন্তর্জাতিক মৈত্রী প্রতিষ্ঠার পথ তৈরী হয়। ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আমরা মানবজাতির শুরু থেকে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড, চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাত্রার অগ্রগতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। এজন্য ইতিহাসকে মানব জাতির দর্পণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, আদিকালের মানবজাতি কিভাবে অসহায় অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে সভ্য ও শক্তিশালী হয়ে সর্বদিকে উন্নতি লাভ করেছে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গৌরবময় প্রতিভার বিষয়ে জানতে পারি ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে।
এভাবে ইতিহাস পাঠ করার মধ্য দিয়ে আমরা মানবজাতির শুরু থেকে তাদের উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড, চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাত্রার অগ্রগতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারি। বিভিন্ন মহাদেশের মানুষের সভ্যতার পরিবর্তন, আগ্রাসন, উত্থান, পতন এসব কিছুই জানা যায় ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে। তবে, ইতিহাস গ্রন্থ শুধুমাত্র মানবজাতির অতীতের কর্মকাণ্ড উল্লেখ করে না, ঐ কর্মকান্ডের অন্তরালের উদ্দেশ্য খুঁজে বেড় করে।
এভাবে, আমরা ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে অতীতের মানুষের চিন্তাভাবনা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পেয়ে থাকি। একটি জাতির চেতনা জাগিয়ে, ভবিষ্যতে ভিত্তি মজবুত করতে ইতিহাসের ভূমিকা অপরিসীম। ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হলে, ভবিষ্যতে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়। একটা জাতির ঐতিহ্য ও গৌরবময় ইতিহাস সেই জাতিকে সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গঠনে উৎসাহিত করে।
ঐতিহ্য এবং গৌরবময় ইতিহাস থেকে একটা জাতি, একটা সভ্যতার সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়। এ ধরনের ইতিহাস পড়ার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়, এবং এই জাতীয়তাবাদ থেকেই দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি হয়। ইতিহাস একটা জাতি এবং একটা সভ্যতার ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে। এজন্যই ইতিহাসের জ্ঞানের মাধ্যমে সমাজ ও জাতি, অগ্রগতির লক্ষ্যে পৌঁছায়।
একমাত্র ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে একজন মানুষ জাতীয় চেতনাবোধে জাগ্রত হয়ে, আত্মপরিচয়ের সন্ধান পায়। এভাবেই ইতিহাসের মাধ্যমে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে যোগসূত্র তৈরী হয়। অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনার সঠিক বিবরণ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয় ইতিহাসের মাধ্যমে। এটা পাঠের কল্যাণে মানুষের মনের দিগন্ত প্রসারিত হয়।
অতীতের সত্যনিষ্ঠ বর্ণনা মানুষের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। আর এই বিবরণ যদি হয় নিজ দেশ জাতির সফল সংগ্রাম, গৌরবময় ঐতিহ্যের তাহলে তা মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।
একই সেইসঙ্গে আত্মপ্রতায়ী, আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করে। এজন্য জাতীয়তাবোধ, জাতীয় সংহতি তৈরীতে ইতিহাস পাঠের বিকল্প নেই।কারণ একমাত্র ইতিহাসের জ্ঞানের আলোকে বিভিন্ন মানবজাতি ও সভ্যতার উত্থান/পতন সম্পর্কে জেনে, মানুষ সচেতন হতে পারে।
পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু করে বর্তমান উন্নত সভ্যতা পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবেশের মধ্য দিয়ে এসে পৌঁছেছে মানবজাতি। আদিম যুগের অবস্থা থেকে বতর্মান পযর্ন্ত মানব সভ্যতার উন্নতি, অগ্রগতি, বেশকিছু সভ্যতার উত্থান পতন এসব ইতিহাস পড়ার মাধ্যমে জানতে পারা যায় এবং সেইসাথে অতীতের সাফল্য, গৌরব ও ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করা যায়৷
অতীতের মানব সভ্যতা সম্পর্কে জ্ঞানলাভে ইতিহাস পড়ার বিকল্প নেই। অতীতের ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে সাফল্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণে সহায়ক হয়৷ অতীতের বহু বিষয় বর্তমানের সঙ্গে অতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে।
অতীতের ব্যর্থতা- ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা এবং সাফল্য হলো অনুপ্রেরণা, যেটা একমাত্র ইতিহাস পড়ার মাধ্যমে জানা যায়৷ ইতিহাস সব সময়ই মানুষকে আগামীর জন্য নিরাপদ পৃথিবী বিনির্মানে প্রেরণা দেয়। একটি জাতির ঐতিহ্য ও অতীতের গৌরবময় ইতিহাস সেই জাতিকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে অনেক মর্যাদাপূর্ণ কর্মতৎপরতায় উদ্দীপিত করে।
একটি জাতির পূর্ববর্তী সভ্যতার সামাজিক ব্যবস্থা, দার্শনিক চিন্তা ও কর্মকান্ডের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন প্রতিফলিত হয় সেই জাতির ইতিহাসে। অতএব; একটি জাতিকে বোঝার জন্য তার ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলো জানার জন্য ইতিহাস পড়ার বিকল্প নেই। ইতিহাস বিভিন্নভাবে আমাদের জাতি গঠনের মূল ভূমিকা বহুভাবে শেখায়। এটা এমন একটি বিষয়, যেটা সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে সম্পর্কে শিক্ষার্থী ও পাঠকদের জ্ঞানার্জন সমৃদ্ধ করে।
ইতিহাস পাঠের ফলে মানব সমাজের ক্রমবিকাশ জানা যায়, সচেতনতা বৃদ্ধি করে, জাতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, ইতিহাস জ্ঞান ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করে, সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গঠন করা যায়।ইতিহাস পড়ার মাধ্যমে জানা যায়- প্রাচীনকালের মানুষ কিভাবে জীবনযাপন করত, তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা… এই জ্ঞান বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিভিন্ন বিষয়ে সুবিধা প্রদান করে। এভাবেই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টিতে সহায়ক করে ইতিহাস।
ইতিহাস পড়লে মানুষের জ্ঞানলাভ হয় এবং মনের দিগন্ত প্রসারিত হয়। মানুষ বিভিন্ন সমাজে বাস করে। প্রতিটি সমাজের রীতিনীতি, আইনকানুন, আচার/আচরণ, খাদ্য, পোশাক… ভিন্ন ভিন্ন। তবে এই ভিন্নতার মধ্যেও রয়েছে ঐক্যের বন্ধন। ইতিহাস পড়ার মাধ্যমে এসব জানা যায়। এভাবেই মানুষের মধ্যে আন্তজার্তিক মৈত্রী প্রতিষ্ঠার পথ প্রসারিত হয়।
অতএব, বলা যায় মানুষের ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জাতিগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এটা পড়লে বিচার/বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায় এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহ জন্মে। যেসব জ্ঞান পিপাসুদের মধ্যে সবসময় নিজের শেকড়কে জানার জন্য একটি টান থাকে, তাঁর সমাজের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত দিকে যেতে পারে- এসব নিয়ে যাদের কৌতূহল, একমাত্র তাঁদেরই ইতিহাস পড়ার আগ্রহ আগ্রহ থাকে।
এটা মুখস্থ বিদ্যার কোনো গ্রন্থ না, বরং সৃজনশীলতার জায়গা যেখান থেকে অনেক কিছু অনুধাবন করা যায়। ইতিহাস পড়ার সবচেয়ে বড় দিক হলো, এটা একজন সফল মানুষ গড়ে তোলে, যাঁর চিন্তা চেতনায় থাকে- তাঁর রাষ্ট্র, জাতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
ইংরেজিতে একটি বাক্য আছে- “History Repeats its Self”. অর্থাৎ- “ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে”। এই কথা বলার কারণ, ইতিহাসকে জেনে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য।
এ ছাড়াও ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে মানবসভ্যতার প্রধান প্রধান স্তর, সভ্যতার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের কথা জানা যায়। ইতিহাস আমাদেরকে অতীত সম্পর্কে জ্ঞান দান করে এবং এই অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমানে সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠন ও ভবিষ্যতের ভিত্তি মজবুত করতে পারি।
ইতিহাসের বিষয়বস্তু
ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়বস্তু অনেক ব্যাপক। ইতিহাসের পথচলার শুরু, জীবন সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে। ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে- প্রাচীনকালের মানুষের জীবনধারা, সমাজ ও পরিবেশ। অর্থাৎ ইতিহাসের বিষয়বস্তু হলো- প্রাচীনকালের মানবজাতির সভ্যতা। ইতিহাসের সংজ্ঞা থেকে এটা পরিষ্কার- অতীতের সব ঘটনার বিবরণ ইতিহাস না।
প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণের পরীক্ষা ও পর্যাপ্ত বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলো ইতিহাসে স্থান লাভ করে। মূলত ইতিহাসের বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষ, তার পারিপার্শ্বিকতা এবং সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ, পরিবর্তন, উত্থান ও পতন। এক কথায় মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধানই হলো ইতিহাসের মূল বিষয়বস্তু।
দীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেয়ে মানবজাতির জয়/পরাজয়, এসব কিছুই ইতিহাস আলোচনার বিষয়বস্তু। ইতিহাসের বিষয়বস্তু অথবা মূল আলোচ্য বিষয়ের পরিধি ব্যাপক। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই ইতিহাসের যাত্রা শুরু। তবে, অতীতের সবকিছুই ইতিহাস নয়। পর্যাপ্ত পরীক্ষা ও বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলো ইতিহাসে স্থান পায়।
এই প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবনযাত্রা, সমাজ, পরিবেশ, সভ্যতা… ইত্যাদি বিষয় ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে পরিচিত। মানবজাতির অতীতের আলোচনা/বর্ণনাকে মূলত ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসাবে ধরা হয়।
ইতিহাসের উপাদান কী কী?
অতীতে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাস রচিত হয়। ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিষয়গুলো বহু ধরণের হয়। অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাস রচিত হয়। এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বহু বিষয় রয়েছে। খুব সহজেই অতীত সম্পর্কে জানা যায় না। অতীতকালের মানুষের রেখে যাওয়া লেখনী ও বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী, গ্রন্থ, দলিল, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা… ইত্যাদির ভিতরে ইতিহাস লুকিয়ে থাকে।
এজন্য এসব বস্তু ইতিহাসের উপাদান নামে পরিচিত। আর এসব উপাদানের উপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনা করা হয়। অতীতে মানবজাতির রেখে যাওয়া পাথর ও ধাতব বস্তুর উপর লেখা ও বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা… এসবের মধ্যেই ইতিহাস লুকিয়ে থাকে।
এজন্যই এসব বস্তুকে ইতিহাসের উপাদান বলা হয়, আর এইসব উপাদানের উপর নির্ভর করে বিচার/বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাস রচনা করা হয়। ইতিহাস রচনার জন্য অথবা প্রকৃত ইতিহাস জানার জন্য সব সময় লিখিত উপাদান পাওয়া যায় না। কারণ, মানবজাতির জীবন সংগ্রাম আদিকাল থেকে শুরু হলেও লিখতে শিখেছে বহু সময় পরে।
তাছাড়াও লিখে মনের ভাব প্রকাশ করা শিখলেও, তৎকালীন যুগে ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ছিল না। এজন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ লিখে রাখে নাই। তাই ইতিহাস রচনার জন্য অন্যান্য উপাদনের উপর নির্ভর করতে হয়।
এজন্য ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসের উপাদানগুলোকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন।
১. লিখিত উপাদান
২. অলিখিত উপাদান।
ইতিহাসের লিখিত উপাদান :
সমকালীন ধর্মীয় গ্রন্থ সহ বিভিন্ন গ্রন্থ, পর্যটকদের বিবরণী, সরকারি দলিলপত্র, রাজা রাণীদের জীবনী… এগুলো ইতিহাসের লিখিত উপাদান। লিখিত ইতিহাসের বয়স প্রায় ২৫০০ বছর।
ইতিহাসের অলিখিত উপাদান :
ধর্মীয়সহ বিভিন্ন স্থাপত্য ও ভাস্কর্য অথবা মূর্তি, মুদ্রা, ধাতব/শিলালিপি, প্রাচীনকালের মানুষের ব্যবহৃত তৈজস পত্র, চিত্রকলা, পাহাড়/গুহায় অংকিত চিত্র… এগুলো ইতিহাসের অলিখিত উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
এভাবে লিখিত এবং অলিখিত উপাদানগুলো বিচার/বিশ্লেষণ করে, ইতিহাস রচনা করা হয়।
ইতিহাস কত প্রকার ও কি কি?
পড়া, আলোচনা ও গবেষণার সুবিধার জন্য ইতিহাসকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো –
* ভৌগোলিক অবস্থানগত ইতিহাস
* বিষয়বস্তুগত ইতিহাস
ভৌগোলিক অবস্থানগত ইতিহাস
ইতিহাসে স্থান পাওয়া কোনো বিষয়, কোনো প্রেক্ষাপটে রচিত; যেমন স্থানীয়, জাতীয় নাকি আন্তর্জাতিক… এসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে যেই ইতিহাস রচিত তাকে ভৌগোলিক অবস্থানগত ইতিহাস বলে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে বোঝার সুবিধার জন্য ইতিহাসকে আরও তিনভাগে বিভক্ত-
* স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস
* জাতীয় ইতিহাস ও
* আন্তর্জাতিক ইতিহাস
বিষয়বস্তুগত ইতিহাস
কোনো বিশেষ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে যেই ইতিহাস রচিত, তাকে বিষয়বস্তুগত ইতিহাস বলে। বিষয়বস্তুগত ইতিহাসের পরিধি ব্যাপক। সাধারণত এটা পাঁচভাগে ভাগে বিভক্ত। এগুলো হলো-
* রাজনৈতিক ইতিহাস
* সামাজিক ইতিহাস
* অর্থনৈতিক ইতিহাস
* সাংস্কৃতিক ইতিহাস
* কূটনৈতিক ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ইতিহাস
ইতিহাসের উদ্দেশ্য কি?
ইতিহাসের উদ্দেশ্য কি এটা এক কথায় সহজে বলা কঠিন। এটার উত্তর একেকজন বিভিন্নভাবে দেয়। কেউ কেউ বলেন- ইতিহাস শুধু অনুসন্ধানের বিষয় নয়, এটি বেঁচে থাকার লড়াইয়ের একটা হাতিয়ার।আবার অনেকেই বলে থাকেন- ইতিহাসের উদ্দেশ্য হল বর্তমানের স্বপ্ন, আশা/আকাঙক্ষা, দ্বিধা/দ্বন্দ্ব সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে প্রভাবিত করা।
অনেকেই মত প্রকাশ করেন- ইতিহাসের উদ্দেশ্য একটাই, সেটা হলো মানুষ কীভাবে মানুষ হলো, এবং কীভাবে মানুষ ভবিষ্যতে আরাে বড়াে হয়ে উঠবে এবং কীভাবে সমাজের সাথে এবং সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলবে… ইত্যাদি।
মজা করে অনেকেই বলে থাকেন- ইতিহাস পড়লে ‘পাতিহাঁস’ হওয়া যায়। এই কথার উৎপত্তি, বিভিন্ন সময় বিকৃত শাসক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ইতিহাস পরিবর্তন করে।বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বাক্য সত্যতা প্রমাণ করে। কারণ, বর্তমানে এই মহাদেশের কয়েকটি দেশের/বড় দেশের কয়েকটি রাজ্যের রাষ্ট্রনায়কগণ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মের অনূভুতি কাজে লাগিয়ে জনমত ভাড়ী করে সংখ্যালঘু দমন করছে এবং গৌরবময় প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস বিকৃত করে প্রচার করছে।
ইতিহাস কি? ইতিহাস কাকে বলে, ইতিহাস কেন পড়বো, ইতিহাসের জনক কে.. এসব কৌতূহল নিশ্চয়ই আপনাদের নিবারণ হয়েছে এবং মানবজীবনে ইতিহাসের অপরিসীম গুরুত্ব নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পেছেন!
Pingback: চাণক্য নীতি | চাণক্য শ্লোক
Pingback: কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র | কৌটিল্য কে ছিলেন?
Pingback: রাজতরঙ্গিনী পিডিএফ